মার্জিনের লেখা
তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে এই বাড়ির
বাকি আত্মকথা কীভাবে লেখা হবে ?
তোমার প্রস্থান বন্ধ করো, এই তোমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরলাম, যাও দেখি কী করে?
তুমি অপরিহার্য অঙ্গ এই বাড়ির, এর আঙ্গিনার সীমারেখা অতিক্রম করে তুমি
উড়ে চলে যাবে পরিযায়ী পাখির মতো
দূর ছায়াপথে, তা কী করে হয়?
এই তোমার দুই বাহু বক্ষে টেনে নিলাম, উড়ে যাও তো দেখি কী করে?
তুমি যেদিন প্রথম পা রেখেছিলে উঠোনে
সেই পদচিহ্ন এখনও আছে, উঠোনের উপরের আকাশ এখনও খালি -
আমরা দেখতাম নীল আকাশ, মাদুর পেতে বসে উপভোগ করতাম তারাভরা রাত্রি,
দেখতাম কত চন্দ্র কিরণের আবীর মাখা মায়াবী অন্ধকার!
বাঁশঝাড়টা এখনও আছে,
এখনও সন্ধ্যা রাত্রিতে জোনাক জ্বলে, মিটিমিটি করে আলো জ্বলে তোমার নামে,
রবি ঠাকুরের গান থামিয়ে দিয়ে আমরা শুনেছি ঝিঁঝি পোকাদের গান -
উঠোনে বসে আর দেখা হবেনা নীলআকাশ, শোনা হবেনা ঝিঁঝি পোকাদের গান -
তাই কী হয়? এই তোমার যাবার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ালাম, আমার দেহ মাড়িয়ে তুমি যাও তো দেখি কী করে?
কত কথা মনে পড়ে -
বালিকা তখনও শাড়ি পরা শেখেনি, পিঠের উপরে এলমেল পড়ে থাকত আঁচল -
খোলা অলিন্দে দাঁড়িয়ে এই বাড়িতে প্রথম যেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তা দেখে ফেলেছিল আকন্দ গাছে বসে থাকা দুটি দাঁড়কাক,
লজ্জাবতীর লজ্জার মতো তুমি লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলে বেতসের ঝাড়ে...
আরও কত কথা মনে পড়ে -
আমি তখন উঠতি অখ্যাত এক কবি, ঋষির মতো মাথাভর্তি চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আঁতেলদের মতো কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে পথ চলতাম, এসব প্রশ্রয় দিতে তুমিও।
যে আমি দিনরাত জীবনানন্দ দাশ, ওমর খৈয়াম আর গালিবের কবিতা পড়তাম ,
সেই আমি কবিতার বদলে তোমাকে পেলাম,
কবির পরিবর্তে হয়ে গেলাম প্রেমিক স্বামী,
আর তুমি হয়ে গেলে আমার কবিতা, যত পাঠ তোমাকেই করতাম।
তুমি কখন অলক্ষ্যে এই বাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলে তা তুমিও জানোনা,
এই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিন্ন করে তুমি চলে যাবে, তা হয়না- প্রফেসর ডাক্তার রোকনুজ্জামান যতই রিপোর্ট দেখাক - 'তোমার রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে।'
কিন্তু তা যেন মিথ্যা হয়,
আমি জানি - তোমার শরীরে আবার রক্তের প্রবাহ বইবে।
কুসমপুরের পথে পথে আমরা আবার দুজন হাঁটব, আলপথ ধরে ধানের গন্ধ শুকে
হেঁটে হেঁটে চলে যাব যমুনা কূলে, নদীও দেখবে তোমাকে, নদী তার জলের শব্দ শোনাবে তোমার কানে কানে, স্রোত বক্ষে দেখবে তুমি তোমার আরক্ত সুন্দর মুখ, দেখবে বালিহাঁস উড়ছে মেঘের নীচ দিয়ে - দেখবে বালুচরে ফুটে আছে অজস্র কাশফুল।
মনে আছে তোমার!
একদিন এক অবসন্ন বিকেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা ভেবে রেখেছিলাম -
কোনও একদিন শ্রাবণ দুপুরে ক্রিস্টাল ধবধবে শিলাবৃষ্টি হবে, বরফের স্তুপ জমবে উঠোনে,
তুমি সেই স্বচ্ছ শিলা কুড়িয়ে এনে জল করে পান করবে,
দু'জনে আরও ভেবে রেখেছিলাম -
একদিন এক শরতরাতে আকাশে মস্ত বড়
একটি চাঁদ উঠবে,
ধবল জোছনায় ভাসবে এই বাড়ির উঠোন, দার্জিলিং থেকে আনা সাদা জর্জেট শাড়িটি পরে হাঁটবে তুমি উঠোনে..
যে শাড়িটি তুমি সযত্নে তুলে রেখেছ তোরঙ্গে --
সেই ঝুম শিলাবৃষ্টি এখনও হয়নি,
সেই মস্ত বড় চাঁদ আজও আকাশে ওঠেনি,
সেই শিলাবৃষ্টি, সেই চাঁদ তুমি না দেখেই চলে যাবে, তাই কী হয়?
কত স্বপ্ন দেখেছি দুজন, কত স্বপ্ন দেখা এখনও রয়েছে বাকি, সেইসব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে তুমি আগে চলে যাবে - তাই কী হয় কখনও ?
~ কোয়েল তালুকদার
______________________
মুখবন্ধ -
উপরের লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি কবিতা। আসলে এটি কবিতা ছিল না। ২০১৯-২০ সালে আমার স্ত্রী যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দুয়ারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, তখন টুকরো টুকরো করে আমার কিছু অনুভূতির কথা খাতার মার্জিনে টুকে রেখেছিলাম। মার্জিনে লেখা সেই সব লেখাগুলি একত্রিত করে এখানে একটি কবিতার রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।