আরক্ত সুন্দর মুখ
বহুবছর আগে কুসুমপুরে সেদিন হিমশীতল সন্ধ্যা নেমেছিল, অস্তমিত সূর্য ডুবে যাচ্ছিল অস্তাচলে
কোনও এক গৃহকোণে পিতলের কুপি জ্বলে উঠেছিল
সেই আলো দেখে এক নবজাতক কেঁদে উঠেছিল।
কত বড়ো পৃথিবীর কত প্রাসাদ কতখানে --
আর সে কী না এল একটি মাটির গৃহকোণে!
কাঁদবেই তো সে!
সেদিন দীপশিখার আলো কার মুখের উপর পড়েছিল?
কার মুখ দেখেছিল সে প্রথম? মা'র নাকি ধাত্রীমা'র?
কেন জানি মনে হয়, জননীকেই দেখেছিল পৃথিবীতে সে প্রথম।
নবজাতক সেদিনের প্রথম ভোরে হয়ত দোয়েলের
শিস শুনেছিল, পাখিটিকে সে কী দেখেতে পেয়েছিল?
জননী খুলে রেখেছিল জানালা,
অতটুকুন ছোট দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিল কী সেদিনের নীল আকাশ?
তারপর কত পাখিদের কলতান শুনেছে সে শৈশবে
আকাশ ভেদ করে কত বৃষ্টি হয়েছে
খোকশা গাছে টুনটুনিদের বাসা বাঁধতে দেখেছে
বাঁশঝাড়ে বসে ডেকেছে ঘুঘু বিষণ্ণ দুপুরে
বর্ষার বকুল সুবাস বিলিয়েছে অকাতরে
ঝরেও পড়েছে সে ফুল মৃদুমন্দ বাতাসে।
বালক হেঁটেছে কত মেঠো পথে পথে
ধানের কচি সজল পাতা ছুঁয়েছে সে
ভিজিয়েছে পা ভোরের শিশিরে
কত রাত্রিদিন কেটে গেছে জননীর স্নেহ ছায়াতলে।
সে কী এপিটাফ লিখতে চেয়েছিল এমন করে কলাপাতার ছিন্ন পাতায় !
'আমি কোয়েল তালুকদার, যার জন্ম শীতের এক মায়াবী সন্ধ্যায়,
সিরাজগঞ্জের যমুনার পাড়ে বড় হতে হতে.......
হতে চেয়েছিলাম নামযশহীন কবি।
মা আমার বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো রাবেয়া খাতুন,
মাটি ও মানুষের আমার পিতা হারুন অর রশিদ তালুকদার।'
নাহ্!
সে কখনোই কবি হতে পারেনি এই বঙ্গের........
এক চন্দ্রালোকিত শীতের রাতে কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে কেউ একজন বলেছিল ---
আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা
নিভে গেছে সেই আলো।
ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন
জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি।
ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত -
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।
সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা জানালা দিয়ে।
ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধূলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায় কিন্তু সে পারেনি।
হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব ,
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।
একটি গ্রাম্য অর্বাচীন ছেলে --
যে তার বুকের ভিতর রিমঝিম বৃষ্টি লুকিয়ে রাখে,
প্রদীপের আলোর বাইরে যে অনির্বচণীয় জোৎস্না থাকে,
তাও সে মুঠোর ভিতর ভরে রাখে
সে বুঝতে পারে এ আলোর নীচে কোনও আঁধার নেই
তারায় তারায় ভরা আকাশ তার
সে সবসময় ভাবে,
এই জগত শুধু মায়ার, এই মায়া থেকে কেউ বের হতে পারে না,
এই মায়া কেউ ছাড়তেও পারে না --
এই মায়াগুলোই কী মানুষের ভালোবাসা তবে?
এই ভালোবাসার মাঝেই থাকতে চায় সে।
এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।
নাহ্ কোনও অভিমান নেই ছেলেটির,
সে একটি আরক্ত সুন্দর মুখের দেখা পেয়েছিল -- নাম তার মায়াবতী।
তপ্ত দুপুরবেলা কিংবা পরন্ত বিকেলে,
সন্ধ্যায়, কিংবা নিশীথ রাত্রিতে
যখনই ঘরে ফিরি না কেন,
দরজার কড়া নাড়লেই এই মায়াবতী এসে দরজা খুলে দেয়,
আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না
টেবিলে খাবার রেডি পাওয়া যায়
পরিপাটি থাকে বিছানা --
ফুলদানিতে ফুলের সুবাস ঝরতে থাকে
শোবার সময় মশারিটাও টানাতে হয় না,
অথচ শুক্লপক্ষ কোনও জ্যোৎস্না রাতে
তার জন্য কখনও আনিনি একটি রজনী গন্ধার বৃন্ত ! কিংবা নীলকন্ঠ পাখির
একটি পালক।
মায়াবতী,
তোমাকে নিয়ে একদিন কুসুমপুরের পথে পথে হাঁটবো, যে পথ চলে গেছে গগনশিরীষ বনে
যেখানে সন্ধ্যা রাতে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো জ্বলে ওঠে
দোয়েলশিসের ভোরে দূর্বাঘাসের শিশিরে পা ধুয়ে নিও তুমি হেঁটে হেঁটে চলে যাবে ধনিদহ বিলে, সেখানে কাদার ভিতর মুক্তা লুকিয়ে থাকে
বসন্তের মধ্য দুপুরের রোদ্রে পুড়বে
ফুটে থাকা অজস্র আম্রমঞ্জরির গন্ধ মেখো,
বাঁশ ঝাড়ের নীচে পড়ে থাকা মরা পাতার মর্মর শুনো
হঠাৎ কোনও দূর্মর বাতাস এসে এলমেল করে দেবে তোমার মাথার চুল
পড়ন্ত বিকালে পাশাপাশি হাঁটবে তুমি
আমার ছায়া পড়বে তোমার উপরে
তুমি বলবে -- 'ছায়া নয় গো, তোমার পাঁজরে জড়িয়ে নাও, যেমন করে ইছামতী নদী জড়িয়ে গেছে মাঠ পেড়িয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে দূরের মোহনায়।'
সেখানে রাতের আকাশ সামিয়ানার মতো ছাতা ধরে রাখে, কত নক্ষত্রবীথি জ্বলে --
কালপুরুষ, বিশাখা, অরুন্ধতীরা দেখবে তোমাকে
সে এক অনন্ত ভালোবাসাবাসির রাত্রি , স্বপ্ন মোড়ানো সে রাত্রি শেষ হয় না।
একদিন মনখারাপ হবে খুব,
অথচ কান্না নেই
সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরোবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না
রয়ে যাবে।
কোন্ আলোয় দেখেছিলাম তার মুখখানি!
ক্ষণকালের দেখায় চিরকালের ভালোবাসা হলো তার সেই আরক্ত সুন্দর মুখ।
কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।
সেই মুখেই --
জীবন থেকে মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।
***