বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়িটা
কাল আশ্চর্য সুন্দর একটি ভোর হবে,
পাখি ডাকবে ফুল ফুটবে, রাঙা আলোয় আলোকিত হবে পূর্ব দিগন্ত --
কাল এমনই উজ্জ্বল আলোর সকাল থেকে
হাজারও মানুষ মিছিল করে যাবে
ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে,
কাল শোকার্ত মানুষের ঢল নামবে রবীন্দ্র সরোবরে।
কাল মিছিল আসবে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে
মিছিল আসবে শীতলক্ষ্যার তীর থেকে
মিছিল আসবে বালু, তুরাগ, বংশী নদীর অববাহিকা থেকে, মিছিল আসবে ধলেশ্বরীর উজান থেকে....
মিছিলে থাকবে কামার কুমার, ধীবর, কৈবর্ত --
মিছিলে থাকবে ছাত্র, শ্রমিক, মুটে, কুলি,ধীবড়, মুচি, রিক্সাচালক ও গৃহিণী...
কাল শহরের সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে
বন্ধ থাকবে কলকারখানা শপিং মল, শিশু পার্ক
বন্ধ থাকবে প্রেক্ষাগৃহ, অফিস আদালত --
কাল স্কুল কলেজের ছাত্ররা কেউ ক্লাসে যাবে না
সবাই শোকমিছিলে যাবে....
কাল সবাই জমায়েত হবে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে
সব মিছিল গিয়ে মিলবে রবীন্দ্র সরোবরে।
ঐ যে সাদা রঙের বাড়িটি দেখছেন, ঐ বাড়িতে থাকতেন এক রাখাল রাজা, লুঙ্গি পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন তিনি তখন--
চিৎকার, কান্না আর গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছিল যাঁর, তিনি হলেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি,
তিনি হলেন আমাদের জাতির জনক,
ঐ বাড়ির সিঁড়িতেই এই জনকের রক্ত ঝরেছিল,
রক্ত ঝরেছিল এক মহিয়সী জননীরও,
পুত্র -পুত্রবধুদের রক্ত ঝরেছিল-
ঝরেছিল শিশু রাসেল ও কর্নেল জামিলের রক্ত.. আরও অনেক স্বজনের রক্ত গড়িয়ে গিয়ে মিশেছিল রবীন্দ্র সরোবরে !
কাল সব মানুষ অশ্রুত নয়নে দেখতে পাবে
সরোবরের সাদা কমলগুলো রক্তকমল হয়ে ফুটে আছে
কাল লক্ষ মানুষের নিযুত অশ্রু ঝরে পড়বে
ঐ ফুলগুলোর উপরে, বাতাসও ভারী হয়ে উঠবে উপস্থিত জনতার ক্রন্দনধ্বনির হাহাকারে ।
সেদিনের শ্রাবণ রাতের শেষ প্রহরে জনক যখন
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন, তখনও তাঁর হাতে ছিল তামাক পাইপ, চোখে ছিল কালো ফ্রেমের চশমা -
তখন কিছু উর্দি পরা দানব বুটের কর্কশ শব্দ তুলে হাঁটছিল তাঁরই বাড়ির আঙ্গিনায়...
তারপর অজস্র গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে শহরের মানুষের, সচকিত হয় ওঠে ঘুমন্ত পাখি,
জেগে ওঠে মায়ের বুক জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা শিশুও...
ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের,
ঘুম ভাঙ্গে শহরের ক্লান্ত বারবনিতার --
তারপর ফের মেশিন গানের গুলির শব্দ!
ঝাঁজরা হয় বাংলাদেশের স্ফীত বুক, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মানচিত্র.. তারপর জনক লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির সোপানে.. স্রোতবেগে রক্ত ভেসে যায় সিঁড়ি বেয়ে
রবীন্দ্র সরোবরে।
আপনি চলে যাওয়ার পর এই জনপদ বিরাণ হলো, ফসলের ক্ষেতগুলো হলো চৈত্রের খরার মতো চৌচির, খাল বিল নদী হলো জলহীন স্রোতহীন --
শকুনেরা তখন আকাশে উড়ছে, শুকুরেরা বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, খুনীরা অট্টহাসিতে উল্লম্ফন করছে আপনার সোনার বাংলায়।
জনক, কাল অসম্ভব সুন্দর একটি সকাল হবে,
হাজারো মানুষ একীভূত হবে বত্রিশ নম্বর সড়কে,
সবার হাতে থাকবে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, কেউই তখন আর ফুলের গন্ধ নেবে না...
কাল মিছিল হবে, শোকসভা হবে... হাজারো মানুষ একিভূত হবে।
এরই মধ্যে কত অশ্রুজল মিশে গেছে পদ্মা মেঘনা যমুনা মধুমতীর জলে, শ্রাবণ বৃষ্টি ধারায় ভিজেছে
কত কদমফুল,
বাংলার পথে ঝোপে ঝাড়ে ফুটেছে কত ভাঁটফুল.. স্বর্ণলতায় ছেয়ে গেছে কত আকন্দ বৃক্ষ, তুমি আছ ঘাসফুল হয়ে এই বাংলার শ্যামল মাঠে...
আপনার মৃত্যু হয়নি, মহামানবদের মৃত্যু হয়না কখনও,
কাল রবীন্দ্র সরোবরে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ ধারণ করবে আপনার হৃদয় থেকে ঝরে পড়া ঝংকৃত হৃদ স্পন্দন! কাল সব মানুষ শোক থেকে নেবে শক্তি --
কাল আর কারোর মৃত্যু হবে না।
ঐ বাড়ি থেকে এখনও বজ্রকণ্ঠ ভেসে আসে এক শ্রেষ্ঠ বাঙালীর--পাইপ হাতে তাঁর , ব্যাকব্রাশ করা চুল, সাদা পাঞ্জাবি পরে দাঁড়ালেন তিনি এসে করিডোরে, বলছেন তর্জনী উঁচু করে বজ্রকণ্ঠে --
'মরতে যখন শিখেছি তখন কেউই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না... '
টুঙ্গিপাড়ার এক ছায়াশীতল গাঁয়ে মৃত্তিকা তলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন, শোনেন কান পেতে নিঝুম রাত্রিতে
বাইগার নদীর শান্ত জলকলধ্বনি --
বৃষ্টি হলে জলাশয়ে আজও সেখানে ব্যাঙ ডাকে,
সন্ধ্যা নামলে ঝিঁঝি পোকাদের নীল আলো জ্বলে ওঠে,
শোনায় ওরা গান আপনাকে গুনগুন করে --
প্রতি ঋতুতে চাঁদের আলোয় ভাসে সমাধি প্রাঙ্গন,
থৈথৈ জোছনার প্লাবন নামে দূরের চরাচরে
আর হিজলতলা ঘাটে...
বঙ্গবন্ধু , তুমি আছ গীতি-গন্ধভরা স্নিগ্ধ বাতাসে -- ধানক্ষেতের কচি পাতার মিহি দোলায়, নৌকার পালে, তুমি আছ চির শস্য শ্যামলে, আকুল করা জোছনার আকাশে..তুমি আছ অনেক তারার ঝিলমিলে...
কাল আর তোমার মৃত্যু হবে না।
~ কোয়েল তালুকদার