ধপধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী, হাতে বই, কালো ফ্রেমের চশমা
আর বুক পকেটে একটি কালো ফাউন্টেন পেন
উনি আমাদের মাস্টারমশাই, অবনী সেন।
বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তখন কলেজে পড়ি,
বাড়ি ফেরার পথে মাস্টারমশাইয়ের সাথে প্রায়ই দেখা হত,
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা যেত ঝুঁকে।
একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করতেন  “কেমন আছো”?  
তারপর এটা সেটা জিজ্ঞাসার পর বলতেন,
‘মনুষ্যত্ব ও আদর্শ বজায় রেখে মাথা উঁচু করে থাকবে চিরকাল,
কোনোকিছুর বিনিময়ে কখনো আদর্শকে বিক্রি হতে দিওনা।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর, জীবন যুদ্ধের ইঁদুর দৌড়ে
অংশ নিয়েছি আমরা, যোগাযোগ কমেছে বন্ধু-বান্ধব এবং
শিক্ষক মহাশয়দের সঙ্গেও, খোঁজ নিয়েছি কখনো কখনো,
প্রায় বছর দশেক পর একদিন দেখা অবনী বাবুর সঙ্গে।
শরীরটা ভেঙ্গে পড়েছে, ছয় ফুট উচ্চতার রাশভারী মানুষটার
চোখে মুখে কেমন বিষণ্ণতার ছাপ, পরনে একটি ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবী,
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলাম
‘কেমন আছেন মাস্টারমশাই’? কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“শিরদাঁড়া সোজা রেখে বাঁচতে চেয়েছি চিরকাল,
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি রাস্তায়, আজকাল আর
অভিভাবকরা এই বৃদ্ধ মাস্টারমশাইকে রাখতে চাননা, এখন
স্পেসালাইজেশনের যুগ, প্রতিটি বিষয়ের আলাদা করে মাস্টার,
আজ আমার কোনো দাম নেই। অভাবে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে অনেকদিন,
স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুই, সন্তানরাও মুখ ফিরিয়েছে
সব শেষ হয়ে গেছে, ৪০ বছরের শিক্ষকতাকে গলা টিপে হত্যা করেছি!
কথাগুলো শুনতে শুনতে বুকের ভিতরটা কেমন হতে লাগলো
হাত চলে গেল পকেটে, মনের কথা কেমন করে বুঝে ফেলে বললেন
“বর্তমানে অর্থই সব, আদর্শের কোন মূল্য নেই।
গাছ বুড়ো হয়ে গেলেও তার মূল্য বাড়ে কিন্তু মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে……..”
বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন, আমি পকেটে
হাত দিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

*******************************************