সবারই জানতে ইচ্ছে করে এই বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? বিশেষ করে মুসলমান হিসেবে আমাদের সবার। তাই আমার আজকের বিষয়: ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা ও কাব্যচর্চা।

পবিত্র আলকুরআনের একটি সূরার নাম হলো 'শূআরা' মানে কবিগণ। এই সূরাতে অনেক নবী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আলোচনা শেষে আমাদের বলা হচ্ছে যে আমাদের নবী যেমন কবি নন তেমনি তিনি কোনো কবিতা আমাদের শুনাচ্ছেন না; তিনি যা বলেন তা হলো ঐশীবাণী-আল্লাহর কালাম। এই সূরার ২২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:-
এবং কবিদের অনুসরণ করে তারাই যারা বিভ্রান্ত। পরের আয়াতে বলা হচ্ছে:- তুমি কি দেখো না তারা বিভ্রান্ত হয়ে (কল্পনার জগতে) প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়।এবং তারা যা বলে তারা তা করে না। (সূরা শুআরা: ২২৫-২২৬)

উপরোক্ত তিনটি আয়াত দেখে মনে হতে পারে, ইসলামে কাব্য চর্চা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, তা হারাম! প্রকৃত পক্ষে তা কখনোই নয়। কেননা স্বয়ং আমাদের রাসূল (স.) ছড়া রচনা করে আবৃত্তি করতেন, পরের মুখে কবিতা শুনতেন। অনেক বড় বড় সাহাবী, তাবেয়ী, বুযুর্গ কবিতা রচনা করতেন, শুনতেন, আলোচনা করতেন।*1 তাই কি মনে হয় কুরআনের সাথে বিষয়টা বৈষম্যমূলক?

তা নয়। আসলে উপরোক্ত সূরায় সব কবিদের এবং সব কবিতার দোষ ধরা উদ্দেশ্য নয়। শুধু যারা এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করে তারাই নিজেরা বিভ্রান্ত এবং অপরকে বিভ্রান্ত করে।*.2

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে:- কিন্তু তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সত্কর্ম করে এবং আল্লাহকে বারবার স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হবার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে( মানে, মুমিন কবিরা বিপক্ষবাদীদের পক্ষ থেকে অত্যাচারিত হয়ে তাদের বিপক্ষে কবিতা দিয়ে আক্রমণ করে) জালেমরা শিগগির জানবে তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়? (সূরা শুআরা: ২২৭)

এখন আমরা বুঝতে পারলাম সব কবিতা খারাপ নয় এবং কাব্য চর্চা করা হারাম নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে কাব্যচর্চার মূল কথা হলো, যা আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: 'কবিতা তো এক প্রকার কথাই, সুতরাং ভালো কবিতা ভালো কথা, আর খারাপ কবিতা খারাপ কথা।' (দারা কুতনী, মিশকাত: ৪৫৯৭)

ইবনে বাত্তাল বলেন, যে কবিতায় আল্লাহর একত্ববাদ, তার স্মরণ ও ইসলামের প্রতি ভালোবাসা বর্ণিত হয় তা কাম্য ও গ্রহণীয়।*3

যে কবিতা দ্বারা আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয়, তার স্মরণ থেকে দূরে রাখে, পরের অধিকার নষ্ট হয়, অন্যায়ভাবে কারো নিন্দা করা হয়, কোনো প্রকার মন্দতা বা অশ্লীলতা প্রকাশ পায় তা নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য। আর যে কবিতায় আল্লাহ ও পরকালকে স্মরণ করা হয়, যা বস্তুনিষ্ঠ, যার দ্বারা মানবতার উপকার সাধিত হয় তাই কাম্য আর তা প্রশংসনীয়।*4

রাসূল সা. বলেছেন: কোনো কোনো কবিতা প্রজ্ঞাময়! (বুখারী, মিশকাত: ৪৫৭৫)
তিনি আরো বলেন: যার কবিতা সবচেয়ে সত্য কথা বলে তা হলো লবীদের কবিতা- 'আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই বাতিল'। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত: ৪৫৭৭)

আমর ইবনে শারিক (রা) একবার রাসূল (সা.)কে উমাইয়া ইবনে সালতের একশত পঙক্তি শুনিয়েছিলেন। (মুসলিম, মিশকাত: ৪৫৭৮)

আমরা সবাই জানি, ইসলামের যুগে সবচেয়ে বড় কবি ছিলেন 'হাসসান'। আয়েশা (রা)নিয়ে কে যারা খারাপ রটনা ছড়িয়েছিল তাদের মধ্যে মুসলমানদের কিছু লোকও ছিল, তাদের অন্যতম হলেন এই কবি হাসসান। তারপরও আয়েশা (রা) তাকে তার দরবার থেকে বিতাড়িত করেন নি এই কারণে যে রাসূল(সা) তাকে ভালোবাসতেন আর সে মুসলমানদের পক্ষ থেকে কাফেরদের জবাব দিতেন কবিতার মাধ্যমে। (বুখারী)।

যুদ্ধ যেমন হাত দ্বারা করা হয়, তেমনি কবিতা দ্বারা করা যায়। তাই তো কবিদের ইসলামে কলম যোদ্ধা বলা হয়।

তাই আমরা বুঝতে পারলাম, যে কবিতা কল্যাণের তা কল্যাণময়। আর যে কবিতা অকল্যাণের তা নিন্দনীয় এবং তা হারাম।
আসুন, আমরা কলম দিয়ে ভালো কথা বলি, খারাপের নিন্দা করি।

তথ্যসূত্র:  আল কুরআন, আল হাদীস
          
           1. মিশকাত শরীফ; বাংলা অনুবাদ, আরাফাত পাবলিকেশন্স, দেখুন: কিতাবুল আদাব (শিষ্টাচার অধ্যায়)
           2.সংক্ষিপ্ত তাফসিরে মারেফুল কুরআন, বাংলা অনুদিত; সৌদি কর্তৃক প্রকাশিত; পৃষ্ঠা: ৯৮৭
           3. তাফসীরে মারেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা: ৯৮৬-৯৮৭
           4. মিশকাত (বাংলা) হাদীস নং: ৪৫৭৫-৪৫৯৯