আমরা পাঁচ বন্ধু গ্রামের এক কলেজে পড়তাম । প্রাইমারী স্কুল থেকে আমাদের বন্ধুত্ব শুরু ।
সেটা এখনো আছে ! যাইহোক, আমারা নিয়মিত আড্ডা মারতাম, ঘুরতাম,
লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতাম (কলেজে এসে)। খুব ই মজায় কাটছিল আমাদের
দিনগুলি। ওহ, আমাদের নাম বলতে তো ভুলে গেছি ! আমি সবুজ, আর আমার বাকি চার বন্ধুর
নাম ছিল সাইফুল, সেলিম, রুবেল ও তানিম। তো দিন কেটে যাচ্ছিল। প্রথম বর্ষ
পরীক্ষা দিয়ে আমরা দ্বিতীয় বর্ষে গেলাম । আর নতুন এক ব্যাচ ডুকলো মানে ভর্তি হোল
আমাদের কলেজে। তো আমরা মেয়েদের দিকে লক্ষ্য রাখতাম একটু বেশি । কারন
তো জানেন ই ! এভাবে আমরা চার বন্ধু মজা করছি ! ভাবছেন চার কেন ? হুম চার। আরেকজন
মজা না, পুরো প্রেমে ডুব মারলেন।
প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল তিশা । খুবই মেধাবি ছিল সে। নিয়মিত ক্লাস আর
পড়াশোনা এই নিয়েই সারাক্ষণ বিজি থাকতো ।তবে গ্রামে তো মেয়েদের পরাশনার
দাম একটু কম ই ছিল। তার বাবার ইচ্ছা ছিল ইন্টারমিডিয়েট পাস করিয়েই
বিয়ে দিয়ে দিবেন। এইটা অবশ্য সে জানত না। কিন্তু অনেক স্বপ্ন দেখত। স্বপ্ন
দেখা ফ্রি তো তাই মনে হয় !!! প্রেম কে সব সময় পাস কাটিয়ে চলতো। কিন্তু
কলেজে এসে আর নিস্তার পায়নি। আর জানেন ই তো প্রেমের ক্ষেত্রে কি হয় । কোথায়
থেকে কিভাবে কি জানি হয়ে যায় !
তো আমাদের যে বন্ধু টি এই তিশার প্রেমে ডুব দিয়েছিলো তার নাম ছিল তানিম।
সেও অনেক মেধাবী ছাত্র ছিল। আমাদের ক্লাসে সেই ছিল প্রথম স্থান অধিকারী।
আমাদের এই বন্ধুটি পড়াশোনার বাইরে আর তেমন কিছু বুজত না । তবে আমাদের
সাথে আড্ডা ফুর্তি করতো অনেক । প্রান চাঞ্চল্লতায় ভরপুর ছিল । তার বাবার স্বপ্ন ছিল
ছেলেকে অনেক শিক্ষিত করবেন ।কিন্তু কি হোল সেই স্বপ্নের ?
আমি সংক্ষেপে ঘটনা শেষ করার চেষ্টা করি কেমন । আপনারা বিজি শহরের ইজি(!!!!!)
মানুষ। আপনাদের সময়ের অনেক দাম আছে। আপনাদের বেশি সময় নষ্ট করতে চাইনা।
তো ঘটনায় ফিরে আসি। তানিম এর তিশার সাথে প্রেম হউয়ার পর কলেজে আমরা চার
বন্ধুই আড্ডা মারি । তানিম তিশার সাথে সময় কাটায় । কখনো কলেজের পাশের পুকুর
পারে। কখনো বা কলেজের পাস দিয়ে যাওয়া রাস্তায় , কখনো বা মাঠে । আমরা আর
তাকে কলজে কাছে পাই না আড্ডা দেওয়ার জন্য। আর কলেজ এর পরে পেলে ও সে শুধু
মোবাইল এ তিশার সাথে কথা বলাতেই বিজি থাকে । আমদের চুপ থাকতে হয় ।
এতে নাকি তার কথা বলায় ডিস্টার্ব হয় । আসতে আসতে এই জন্য আমরাও তাকে আর
সহজে আমাদের আড্ডা তে ডাকি না। কারন সে এলে আমাদের যে চুপ থাকতে হয়। আর চুপ
করে যে তার মোবাইলে কথা বলা শুনবো তার উপায় ও নেই। মানে জানেন ই
তো প্রেমিক প্রেমিকার কথা শুনা কতটা বিরিক্তিকর । যার সাথে কথা বলছে তার
কাছে মধুর মতো লাগে, কিন্তু যে বাইরে বসে তাদের কথা শুনে তার
কাছে বিরক্তি লাগে। যাইহোক, এভাবে আমরা কলেজ জীবন শেষ করলাম।
ঢাকায় চলে আসি আমি, সেলিম ও রুবেল ভার্সিটি তে ভর্তি হবার জন্য।
তো ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হলাম । এই তিন জন কিন্তু এক সাথে থাকিনা। যার যার
সুবিধা মতো যায়গায় উঠেছি আমরা। আমি খালার বাসায় উত্তরায়। রুবেল
যাত্রাবাড়ীতে , সেলিম ধানমণ্ডিতে। পরে সেলিম চার মাসের মাথায়
অ্যামেরিকায় পরতে চলে যায়। ঢাকায় শুধু রুবেল আর আমি।
মোবাইলে মাঝে মাজে কথা হয় আমাদের। দেখা হয় না। আর বাকি দুই বন্ধুর মধ্যে সাইফুল
বাড়িতেই রয়ে গেছে। বিদেশ নাকি যাবে । তানিম তিশার সাথে প্রেম
করে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে । ফেইল না । কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট
পাইনি বলে আবার পরীক্ষা দিবে সে । তা ছাড়া ঢাকায় চলে এলে তিশার সাথে ও
তার দেখা হউয়া মিস হয় । এই জন্য তার বাবাকে বলে কয়ে আবার পরীক্ষা দেবার
বাহানায় গ্রামেই রয়ে গেলো । আগেই বলেছি, তার প্রেমের শুরু হউয়ার পর
থেকে সে ক্রমাগত আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তো সাইফুল আর তানিম একই
গ্রামের ছিল ।তাই মাঝে মাঝে ওর কাছে তানিমের খবর পেতাম। ঢাকায়
এসে গ্রামে আর তেমন যাওয়া হয় না । প্রথম প্রথম যেতাম ঘন ঘন । কিন্তু
ভার্সিটি তে ভর্তি হবার পর আর যাওয়া হয় নি। ধীরে ধীরে সবার সাথে যোগাযোগ
কমে যেতে লাগলো।ঢাকা আসার এক বছরের মাথায় তানিমের মোবাইল বন্ধ পাই ।তার
আর খবর পাই না । সাইফুলের টাও একই অবস্থা।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এবার প্রায় ১ বছর পর(কলেজ জীবন শেষ করার দুই বছর) পর
বাড়িতে এলাম আমরা দুই জন ই। ঈদের পর দিন সবাই একসাথে হলাম। সাইফুলকে লোক
মারফত খবর দিয়ে আনালাম । সে নাম্বার চেঞ্জ করেছে। তিন বন্ধু একসাথে হউয়ার পর
কৌশলাদি বিনিময় করলাম। সাইফুল কে অনেক বকা ঝকা দিলাম নাম্বের বন্ধ থাকায়।
তাকে বললাম তানিমের নাম্বারটাও তো বন্ধ । তোকে না বলে পাঠিয়ে ছিলাম
তাকেও সাথে করে নিয়ে আসতি ? সে কই ? একটু পরে আসবে নাকি ?
তানিমের কথা বলায় সাইফুল চুপ হয়ে রইলো । রুবেল বলল কিরে চুপ করে আছিস কেন ?
সাইফুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোরা কিছু জানিস না !! আমরা বল্লম তুই তো জানিস
ই তার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছি একবচর যাবত । নতুন নাম্বার টাও আমাদের দেই নি ।
সাইফুল বলল কেন দেই নাই আমি বলি শুন ।
তিশা আর তানিম তো এক সাথে পরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। পাস করার পর তিশার
বাবা তিশার বিয়ে ঠিক করে অন্য এক ছেলের সাথে। তিশা তানিমের কথা তার
বাবাকে বলে ।তার বাবা তাকে জানিয়ে দেয় যে ওই ছেলে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট
পাস করেছে। তার প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময় লাগবে । এত দিন আমি তোমার
বিয়ে না দিয়ে রাখবো না । পরে তিশার অমতেই বিয়ে ঠিক ঠাক হয়ে যায় । তিশার
বাবা তিশকে ঘরে আটকে রাখেন এবং তার মোবাইল নিয়ে নেন। তিশার আর
তানিমের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ।তানিমের গ্রাম থেকে তিশার গ্রাম আরও সাত
গ্রাম পরে । তিশা অনেক কষ্ট করে তানিম কে খবর পাঠায় । কিন্তু খবরবাহক তিশার
বাবার হাতে ধরা পরে যায়। এই জন্য তিশার বাবা তিশার বিয়ে নির্ধারিত সময়
থেকে আরও এগিয়ে নিয়ে আসেন । এদিকে তানিম তিশার নাম্বার বন্ধ পেয়ে তার
বাড়িতে চলে আসলে তিশার বাড়ির লোকজন তাকে তাড়িয়ে দেয় ।
তিশা তা জানতে পেরে বিয়ের আগের রাতে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু
ধরা খেয়ে যায় । পরে শেষ রাতের দিকে আত্মহত্যা করে প্রেমের মান বজায় রাখতে ।
এইদিকে ওই দিন বেলা ১ টার দিকে তানিমের নাম্বারে কল আসে । কল করে তিশার এক
বান্ধবি। তাকে এই খবর জানায় সে । তানিম তো তিশার সাথে কথা ও
দেখা না করতে পেরে এমনিতেই আধাপাগলের মতো আছে । যখন তিশার মৃত্যুর খবর পেল
তখন দৌরে গেলো তিশাদের বাড়িতে । সাথে আমাকে নিয়ে যায়। বেলা তখন ৪ টা।
লাস দাফন করা হয়ে গেছে ঘণ্টা খানেক আগে ।
তিশাদের বাড়িতে পৌঁছে দেখি শুনশান নীরবতা। তিশার বাবা ঘরের বাইরে এক
কনায় একটা চেয়ারে বসে আছে ।আর কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে । তানিম
কে দেখা মাত্র তিশার বাবা দৌরে এল। চিৎকার করে বলতে লাগলো, বাবা আমার ভুল
হয়ে গেছে। নিজের ভুলে আমি নিজের মেয়েকে হারিয়েছি । তানিম চুপ
করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো । তিশার বাবা কেঁদে চললেন । তানিম তখনো চুপ।
আমি তানিমের কাঁধে হাত রাখলাম সান্ত্বনা দেবার জন্য । কিন্তু তানিম চুপ । টার
চোখ দুটিতে তে যেন খরা লেগেছে। এত শুষ্ক ।এভাবে মিনিট ১৫ এর মতো পার হোল। একটু
পরে তানিম বলল আমি টার কবর দেখতে চাই। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করিনা।
তিশাদের বাড়ির একটা ১৫-১৬ বছরের ছেলে তানিম কে বলল আসেন আমার
সাথে,আমি নিয়ে যাচ্ছি । আমরা গেলাম ওই ছেলেটির পিছু পিছু। কিছুক্ষণ হাঁটার পর
একটু দূরে গ্রামের প্রধান কবরস্থান দেখতে পেলাম । ওখানে যাওয়ার পর দেখি একটা নতুন
কবর । বুজতে কষ্ট হয় না এইটাই তিশার কবর । ছেলেটি ওই কবরের পাশে গিয়ে বলল, এই
যে এইটা, এইটা আমার আপুর কবর । তানিম কবরের পাশে গিয়ে দাড়ায়। বিড়বিড়
করে কি যেন বলে ।কান পেতে শুনি ও বলছে, ভালই তো স্বার্থপর তুমি । বলেছিলে ককহ্ন
আমায় একা ফেলে যাবে না ।আর আজ ? একাই চলে গেলে ! আকস্মিক ও কবরের পাশের
কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকায় । লাল ফুলে ছেয়ে আছে সেই গাছ । তানিম
দৌরে গিয়ে গাছে উঠে । একটু উঠার পর পরে যায় । আবার উঠে । আমরা বাঁধা দেওয়ার
চেষ্টা করি ।কিন্তু সে মরিয়া হয়ে গাছে উঠে । ফুলে ছেয়ে আছে এরকমএকটা কৃষ্ণচূড়ার
ডাল ভেঙ্গে নিয়ে আসে । এনে তিশার কবরের পাশে এসে দাড়ায় আর
বলে তিশা দেখ, এই যে তোমার প্রিয় ফুল। আমি নিয়ে এসেছি । নেও, নিবে না ! এই
তিশা। এই! এবার দেখি তানিম কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে । আমি বাঁধা দিলাম না।
বললাম না কোন সান্ত্বনার বানি । আমাদের সাথের
ছেলেটা সান্ত্বনা দিতে গেলে তাকে আমি ডেকে নিয়ে এলাম । আমরা একটু
দূরে সরে এলাম । ও কাঁদুক। কেঁদে হালকা হউক ।পরে আমরা চলে আসি । তানিম কে জোর
করে নিয়ে আসতে হয় ।সে আসতে চায়না ।
এর ১৩ দিন পর তানিম ও আত্মহত্যা করে মারা যায় ।
সাইফুল এর কাছে তানিমের এই ঘটনা শুনে আমি আর রুবেল স্তব্দ হয়ে বসে থাকি । সূর্য অস্ত
যেতে থাকে । এক সময় ডুবে যায় । যেভাবে ডুবে গিয়েছিলো আমাদের বন্ধুটি।সূর্য
পরেরর দিন ঠিক ই উঠবে । কিন্তু উঠবে না আমাদের বন্ধুটি।

(সংগৃহীত)