মুরিদানের পুনঃ প্রতিবাদ ও অনুনয়-বিনয়:—
সবাই বললো, হে উজির উহা করিনি অস্বীকৃত
আমাদের কথা নয়তো অন্য লোকের কথার মত ।
বিরহের ফলে চক্ষু হইতে ঝরছে অশ্রুজল
হৃদ হতে ‘আহ’ শব্দ বাহির হচ্ছে অনর্গল ।
শিশুর কখনো ধাত্রীর সাথে ঝগড়া কি আর বাধে
ভালোমন্দ কিছুই বোঝে না কিন্তু তবু সে কাঁদে ।
আমরা হলাম বেহালার মতো সুর তোলো তুমি তার
এ কান্না কভু আমাদের নয় এ কান্না যে তোমার ।
আমরা বাঁশরী তুমি হও যার সুর শব্দের খনি
আমরা পাহাড় তোমার থেকেই এসেছে প্রতিধ্বনি ।
হারজিতে মোরা ব্যস্ত রয়েছি পাশা খিলাড়ীর ন্যায়
ওহে গুণাধার, এই হারজিত তোমার থেকেই পায় ।
ওহে আমাদের হৃদয় রাজ্যে আসন গ্রহণকারী
তোমার সামনে আমরা কি আর ‘আমরা’ বলতে পারি ?
আমরা এবং মম সত্তা তো আসলে সত্তাহীন
কামেল সত্তা কেবলই তুমি মনে হয় যাকে লীন ।
আমরা সিংহ কিন্তু তা শুধু ঝাণ্ডায় অংকন
বায়ুর কারণে হয়ে থাকে সেই মোদের আক্রমণ ।
আক্রমণ তো দৃশ্যত হয় বায়ু যে থাকে গোপন
যাহা দৃষ্টির আড়ালে তা যেন খালি না হয় মন ।
আমাদের কথা এবং সত্তা সব যে তোমার দান
আমাদের এই অস্তিত্বও তোমারই নির্মাণ ।
সত্তাহীনকে সত্তার স্বাদ করালে আস্বাদন
সত্তাহীনকে নিজের দিকেই করো হে আকর্ষণ ।
ফিরিয়ে নিও না নিজ করুণায় ইশকের স্বাদ দিয়া
ইশকের ফল, শরাব, পিয়ালা নিও না গো ফিরাইয়া ।
আর তুমি যাহা ছিনাইয়া লও কে আছে খুঁজবে তারে
চিত্র কি তার শিল্পীর সাথে শক্তি খাটাতে পারে !
দেখবে না তুমি, দৃষ্টি দিবে না কেন আমাদের প্রতি
দৃষ্টি রাখিও স্বীয় করুণায়, করুণা তোমার অতি ।
ছিলাম না মোরা, না ছিল মোদের আকাঙ্ক্ষা অনুনয়
তোমার করুণা শুনত তখনো অযাচিত নিশ্চয় ।
মাতৃগর্ভে শিশুটি যেমন অক্ষম, মজবুর
তেমনি তুলির সামনে চিত্র অক্ষম, ভঙ্গুর ।
তার কুদরতে বিশ্বজগত বিনীত হইয়া আছে
যেমন বিনীত সূচিকর্মের কাপড় সূচের কাছে ।
কুদরতে আঁকে দানব-চিত্র কখনো মানব ছবি
কখনো বা আঁকে আনন্দ কি'বা বিষাদের ছায়া সবি ।
কোন হাত নাই এ কার্যক্রম করবে অপসারণ
কোন মুখ নাই এ বিষয় নিয়ে করে কিছু বর্ণন ।
এর ব্যখ্যায় আল্লাহর কথা কুরআনে দেখিয়াছি
‘তুমি নিক্ষেপ করো নাই আমি নিক্ষেপ করিয়াছি ।’
আমরা হলাম ধনুকের ন্যায় কিংবা ধনুকধারী
মহান আল্লাহ্ প্রকৃতপক্ষে তীর নিক্ষেপকারী ।
তবে এটা নয় মানুষে শক্তি দেয় নাই এক কণা
হয়েছে এখানে শুধু আল্লাহর মাহাত্ম্য আলোচনা ।
আমাদের এই অক্ষমতার প্রমাণ যেমনি হলো
তেমনি পাপের অনুশোচনার ক্ষমতাও কিছু র’লো ।
ক্ষমতাই যদি না থাকে তাহলে এই লজ্জার হেতু
কি জন্য এই অনুতাপ আর অনুশোচনার সেতু ।
সাগরেদেরকে শাসন করেন কেন উস্তাদগন
চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত কেন গো চিকিৎসকের মন ?
যদি তুমি বলো, সে তার পূর্ণ ক্ষমতা অনবগত
তাহলে হকের চাঁদ অজ্ঞাত মেঘে ঢাকা অবিরত । (১৫শ)
যদি তুমি শোনো, এই প্রশ্নের খাঁটি উত্তর পাবে
তাহলে কুফরি ত্যাগিয়া সত্যে আগ্রহী হয়ে যাবে ।
অসুস্থতায় মনে ভয়ভীতি, অনুতাপ, ব্যকুলতা
রোগের সময় রোগীর জন্য পূর্ণ সতর্কতা ।
যে সময় তুমি শঙ্কিত থাকো কিংবা রুগ্ন হও
তখন তোমার পাপরাশি ক্ষমা প্রার্থনা করে লও ।
পাপের কুফল তোমার নিকট প্রকট হইয়া উঠে
তখন নিয়ত করতে থাকো যে সুপথে যাইবে ছুটে ।
অন্তর থেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করতে থাকো যে আজ
এরপর থেকে বন্দেগি ছাড়া করবো না কোন কাজ ।
অতএব এই বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ নেই আর
রোগ এসে করে দেয় যে তোমাকে পুরোপুরি হুশিয়ার ।
ওহে প্রকৃত তথ্যান্বেষী, হাকিকতে বোঝা যায়
অন্তরে যার প্রেমাগুন সে-ই প্রেমাস্পদকে পায় ।
যে ব্যাক্তি যত জাগ্রত তার হৃদয়ে বেদনা তত
নিশ্চুপ হয় এই বেদনার খবর রাখে যে যত ।
যদি বলো তুমি, পুরো অক্ষম বোঝও তা এক্ষণি
তাহলে কোথায় আল্লাহ্ পাকের শৃঙ্খলে ঝনঝনি?
শৃঙ্খলাবদ্ধ সে কি কখনোই উল্লাসে ডুবে মরে
কয়েদি কি কভু স্বাধীনতা আর বিজয় মিছিল করে?
যদি মনে করো, তোমার দু'পায়ে তার শৃঙ্খল পরা
মহান রবের শক্তি তোমার উপরে নিয়োগ করা
দুর্বলদের প্রতি তবে কেন করো তুমি অন্যায়
কেননা এটাতো দুর্বলদের স্বভাবে দেখা না যায় ।
অক্ষমতাকে যদি না দেখলে, দাবী করো কেন তাও
আর যদি দেখো, তাহলে দেখার প্রমাণ এবার দাও ।
যে কাজের সাথে তুমি নিজেকেই জড়িত করিয়া নাও
তখন নিজের সামর্থ্য তাতে স্পষ্ট দেখতে পাও ।
আর যেই কাজে তোমার হৃদয়ে উৎসাহ নাই পাও
সে কাজে নিজেকে অক্ষম বলে, আল্লাহ্'কে দোষ দাও ।
নবীগন হয় দুনিয়ার কাজে একেবারে অক্ষম
কাফেররা হয় আখেরের কাজে ভঙ্গুর একদম ।
নবীদের তরে আখেরের কাজ ইচ্ছার অনুগত
কাফেরের তরে দুনিয়ার কাজ ওদের ইচ্ছা মতো ।
কেননা প্রতিটি পাখি সহজাত পাখির দিকেই উড়ে
তার আগে তার প্রাণ ছুটে যায় এতো আগ্রহভরে ।
কাফিররা ওই জাহান্নামের সহজাত, সক্রিয়
তাই পার্থিব কয়েদখানার সব পছন্দনীয় ।
বেহেশতেরই সহজাত সব নবী ও রাসুলগন ।
এই জন্যই মনেপ্রাণে তারা বেহেশতগামী হন ।
এই আলোচনা খুব সুদীর্ঘ যার কোন শেষ নাই
পুনরায় আমি ওই কাহিনির দিকে ফিরে যেতে চাই ।
(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)