পথভ্রষ্ট বাদশাকে উজিরের ধোঁকাবাজি শিক্ষাদান:—
বাদশার এক উজির ছিল যে ধূর্ত ও ধোঁকাবাজ
পানির উপর গিরা লাগানোই ছিল উজিরের কাজ ।
উজির বললো, নাসারারা যদি ধর্ম গোপন করে
বাদশা হইতে লুকায় কর্ম সবে জীবনের ডরে ।
একেক করিয়া হত্যা করে কি নাসারা-নিধন হবে
এবার তাদের হত্যাকাণ্ড ত্যাগ করে দিন তবে ।
হত্যাকাণ্ড কমাইয়া দিন হত্যার লাভ, ছাই
দ্বীনের মধ্যে মেশকের ঘ্রাণ, আগর কাঠ তো নাই ।
শত পর্দার আড়ালে রয়েছে দ্বীনের সুদৃঢ় ভিত
বাহ্যিকভাবে বাদশার সাথে অন্তরে বিপরীত ।
এতকিছু শুনে বাদশা এবার উজিরকে বলে হায়
তাহলে বলো তো কিরূপে ওদের প্রতিহত করা যায় ।
যাতে দুনিয়ায় কোন নাসারা-ই অবশিষ্ট না থাকে
হোক তা গোপনে কিংবা প্রকাশে দুনিয়ার কোন বাঁকে ।
উজির বললো, করেন একটা কঠিন আদেশ জারি
কাটা হয় যেন হাত-পা আমার, নাক ঠোঁট ফেলে ফাড়ি ।
আমাকে যখন ধরিয়া বাধিয়া শূলে চড়াইতে দিবে
আপনার কোন সুপারিশকারী আমারে বাঁচিয়ে নিবে ।
বিষয়টা যেন জনসাধারণ সবার নজরে পড়ে
কাজটা হইবে জনসম্মুখে চৌরাস্তার মোড়ে ।
তারপরে মোরে তাড়িয়ে দিবেন কোন নগরের পানে
ঘটাবো বিরাট অনর্থ গিয়ে নাসারাগো ওইখানে ।
তাদের নিকটে গিয়ে আমি হবো নাসারা-ধর্মগুরু
এভাবেই আমি করবো আমার ধ্বংসযজ্ঞ শুরু ।
তাদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ বাধবো এমন ছল
শয়তানও যে হতবাক হবে দেখে সেই কৌশল ।
তাদের সহিত করবো যে আমি এমনই আচরণ
কি যে হবে সেথা এখানে নাই-বা করি তাহা বর্ণন ।
যখন আমাকে বিশ্বাস করে নেতা বলে মেনে নিবে
কুবুদ্ধি মোর ওদের সামনে নানা ফাঁদ পেতে দিবে ।
প্রতারণা করে সবাইকে বড় ধোঁকায় ফেলিয়া দিব
তাদের মধ্যে আমি শত শত তাণ্ডব লাগাইবো ।
নিজেদের হাতে নিজেদের খুন করবে যে প্রবাহিত
তাহলেই ব্যাস, আমাদের কাজ হইবে সংক্ষেপিত ।
ওদের নিকটে বলবো আমি তো নাসারা ধর্ম মানি
খোদার কসম, খোদায় জানেন আমি এক নাসারানী ।
বাদশা আমার দ্বীনের বিষয় হয়েছেন অবগত
শত্রুতা নিয়ে এবার আমার প্রাণ নিতে উদ্যোত ।
ইচ্ছে আছিলো নিজের ধর্ম হৃদয়ে গোপন করি
বাদশার যেই ধর্ম তাহাই সামনে মেলিয়া ধরি ।
বাদশা আমার দ্বীন-ধর্মের ঠিকি সন্ধান পেল
কথাবার্তায় সন্দেহ তার যুক্ত হইয়া গেলো ।
বাদশা বলিলো, তোমার কথা যে লাগছে সূচের ন্যায়
অন্তর মাঝে সুবিশাল এক গিরিপথ দেখা যায় ।
সেই গিরিপথে ঠিক অবস্থা দেখছি সত্য কিছু
দেখছি যখন শুনবো কেন যে কথাগুলো সব মিছু ।
ঈসার আত্মা যদি গো আমার সহায়ক না-ই হবে
ইহুদি বাদশা আমাকে টুকরা করিয়া ফেলিত তবে ।
আমি তো ঈসার প্রতি আসক্ত ঈসাই আমার প্রাণ
তার শুকরিয়া আদায় করতে, হোক জান কোরবান ।
ঈসার জন্য জীবন ত্যাগিতে কোন আফসোস নাই
কিন্তু ঈসার দ্বীনের বিষয়ে বহু কিছু জানি ভাই ।
আফসোস হয় এই পবিত্র ধর্মের লাগি তবে
আমি মরলে তো মুর্খের হাতে এ ধর্ম নাশ হবে ।
আল্লাহ্ এবং ঈসার উপরে অফুরান শুকরিয়া
দিয়েছে আমায় সত্য দ্বীনের রাহবর বানাইয়া ।
শুকরিয়া আরো ইহুদি হইতে পাইয়াছি নিস্তার
সুযোগ পাইছি কোমরে আবার পৈতাও বাঁধিবার ।
চলমান যুগ ঈসার ধর্ম যুগ যেন সবে জানে
এই ধর্মের তত্ত্বকথা যা শুনিও তা মনেপ্রাণে ।
এ ধর্মহীন বাদশা জালেম দুশমন নাসারার
শত্রু-মিত্র কিছুই চেনে না সব ভাবে একাকার ।
এই সব কথা বলবে উজির নাসারাগনের সাথে
বাদশার কাছে ধূর্ত উজির বলিতেছে উল্লাসে ।
উজির বললো, বাদশা আপনি একটু ধীরতা ধরি
দেখবেন আমি কেমন করিয়া নাসারা বিনাশ করি ।
যখন উজিরে পরিকল্পনা করে বাদশারে পেশ
দূর হয়ে যায় বাদশার মনে শঙ্কার সব লেশ ।
উজিরের সাথে তাই করা হলো, যাহা বলা হয়েছিল
এই রহস্য সব লোকেদের হতবাক করে দিলো ।
জনসাধারণ সম্মুখে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়
নারী ও পুরুষ সবে উজিরের অবস্থা দেখে লয় ।
তারপর তাকে নাসারাগো দিকে দেওয়া হয় তাড়াইয়া
নাসারা ধর্মে আহবান শুরু করলো সেথায় গিয়া ।
শোনো হে বৎস, বিশ্বের হাল এমনটাই সারাক্ষণ
হিংসাত্মক কারণেই ঘটে যাবতীয় অঘটন ।
অল্প অল্প করিয়া হাজারো নাসারারা এসে যায়
স্বার্থান্বেষী, কুচক্রী এই উজির-আস্তানায় ।
নির্জনে বসে তাদের শোনায় ধর্মের আলোচনা
আরো ইঞ্জিল, পৈতা, নামাজ, বন্দেগির বর্ণনা ।
সে তাদের সাথে খুব মার্জিত ব্যবহারে সাজে জ্ঞানী
উচ্চাঙ্গের ভাষায় শোনাতো নবী ঈসারও বানী ।
এই উজিরের করুণ দৃশ্য দেখে নাসারার দলে
দুঃখ ও ক্ষোভে কান্দনে বুক ভাসায় অশ্রুজলে ।
প্রকাশ্যে যত আদেশাবলীর খুবি নসিয়তকারী
ভিতরে ভিতরে শিকারীর মতো ফাঁদ পেতে বসে ভারি ।
এই জন্যই কিছু সাহাবীরা করে নবীজিরে জিজ্ঞাসা
কিরূপে বুঝিব নফসের ধোঁকা এ বড় সর্বনাশা ।
সাহাবীরা সবে জানিয়া নিতেন, প্রিয় নবীজির কাছে
নফসে কেমন গরয ঢুকায় ইবাদতে, ইখলাসে । (৯শ)
ফজিলত নিয়ে অধিক প্রশ্ন করে নাই সাহাবারা
ইবাদাতে কি-কি ত্রুটি হতে পারে তাই জেনে নিত তাঁরা।
ছোট থেকে ছোট বিষয়ে তাহারা লইতেন সব জানি
জিজ্ঞাসা করে সাহাবীরা হয় এমনি তত্ত্বজ্ঞানী ।
হুজায়ফা যিনি নফস বিষয়ে নবীর তথ্যবাহী
হাসান বসরী পেলো কিছু তাই বয়ান হৃদয়গ্রাহী ।
তত্ত্বের জ্ঞানী সাহাবীরাও যে হইতেন বিস্মিত
হাসান বসরী আলোচনা করে শুনে সবে শিহরিত ।
(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২