এক পসারীর পোষা তোতা কতৃক
তেলের বোতল ঢালা:—
এক পসারীর দোকানে একটি তোতা ছিল সুন্দর
সবুজ রঙের, কথা বলে ও যে মিষ্টি কণ্ঠস্বর ।
সেই তোতা পাখি দোকানে বসিয়া করতো পাহারাদারী
সবার সাথেই মিষ্টি মধুর কথাও বলতো ভারি ।
জ্ঞান বুদ্ধির আলাপ করতে করতো সে আহবান
মিষ্টি কণ্ঠে গাইতে জানতো প্রাণ কাড়া সব গান ।
একদিন সেই মালিক গেল যে কোন কাজে তার ঘরে
তোতাপাখি বসে দোকানের একা সব দেখাশোনা করে ।
হটাৎ দোকানে ইদুর ধরতে বিড়ালের লাফালাফি
তখন বেচারী তোতার প্রাণটা ভয়ে ওঠে খুব কাঁপি ।
পালানোর লাগি গদি হতে উড়ে তোতায় পাখনা খুলি
ঝাপটা মারতে পড়ে গেল হায় তৈলের শিশিগুলি ।
তাহার মালিক ঘর হতে ফিরে ছিল সব বেখবর
নিরিবিলি মনে বসিয়া পড়লো দোকানে গদির পর ।
কিন্তু যখন চোখদুটি করে চারিদিকে ঘোরাফেরা
তোতার মাথায় আঘাত করলো তোতা হয়ে গেল ন্যাড়া ।
তারপর তোতা কথা বললো না কষ্টের অনুরাগে
ইহাতে দোকানী নিজের কর্মে লজ্জিত হতে লাগে ।
দোকানদার সে আফসোস করে ছিঁড়তে লাগলো দাঁড়ি
হায় আফসোস! নেয়ামত রবি ঢেকেছে মেঘেতে ভারি ।
হায় খোদা এই হাতখানা মোর ভাঙলো না কেন আগে
যখন তোতারে আঘাত করেছি সামান্য অভিযোগে ।
দানখয়রাত করতে লাগলো সে দোকানী এই আঁশে
মিষ্টি তোতার কথা বলবার শক্তি ফিরিয়া আসে ।
এইভাবে তিন দিন পার করে দোকানী সে হয়রান
নিরাশার ঘোরে করছিল সেই দোকানে অবস্থান ।
শত চিন্তায় ক্ষত-বিক্ষত মন করে উরু উরু
কখন আমার স্বাধের তোতায় করবে রে কথা শুরু ।
সে কত ভঙ্গি করিয়া পাখিকে দেখাইলো বিস্ময়
হায়রে কপাল! তবুও পাখি যে কোন কথা নাহি কয় ।
দমে দমে কত এদিকে সেদিকে কথার যত্ন ছাড়ে
হয়তো ইহাতে পাখি কথা বলা শুরু করে দিতে পারে ।
কথা বলানোর যত পথ ছিল, ব্যবহার করে সবি
পাখির সামনে ধরলো কতোই রংবেরঙের ছবি ।
হটাৎ সে-পথে খিরকা পরিয়া দরবেশ হয় গত
চুল হীন তার মাথাটা দেখতে রেকাবি প্লেটের মত ।
তাহাকে দেখিয়া পাখিটা হটাৎ বলিয়া উঠলো, আরে
হাসিতে হাসিতে উচ্চস্বরেই ডাকিয়া বলিলো তারে ।
হে নেড়ে! তুমিও কিসের জন্য চুল হতে আজ খালি
বুঝেছি তুমিও, আমার মতোই তৈল ফেলেছ ঢালি ।
তোতা পাখির এ-অনুমানে সবে হাসিয়া উঠলো জোরে
টেকো লোকটাকে বুঝলো তোতায় নিজের মতন করে ।
পুণ্যবানরে নিজের উপর করিওনা অনুমান
‘শের’ আর ‘শীর’ লিখতে একই, অর্থের ব্যবধান ।
‘শীর’ তো সুস্বাদু, তৃপ্তি পাইবে মানুষেরা এটা খেলে
‘শের’ মানে বাঘ মানুষকে যাহা চিড়িয়া ফারিয়া ফেলে ।
একটা কারণ অধিকাংশের বিচ্যুত হইবার
অন্ধদৃষ্টি আউলিয়াদের পারে নাই চিনিবার ।
সত্যদর্শী হয়নাই যারা জীবনে একটিবার
ওদের নজরে একইরকম নেককার আর বদকার ।
নবীদেরকেও নিজেদের সাথে মিলায় আবার ওরা
ওলিদের ভাবে ওদেরই মতো হায় রে কপালপোড়া ।
ওদের দাবী যে, নবী আর ওরা নয় তো কখনো জুদা
ওদের মতন নবীরও লাগে নিদ্রা এবং ক্ষুধা ।
অন্তর্দৃষ্টি হীন ছিল তাই বুঝতে পারলো না যে
কতটা অসীম পার্থক্য যে ছিলো উভয়ের মাঝে ।
বোলতা এবং মৌমাছিদের পানীয় একই ফুল
একজন দেয় সুমিষ্টি মধু, অপরে বিষের হুঁল ।
সব হরিণেই খায় দেখো পানি তৃণলতা পেট ভরি
একটাতে হয় শুধুই গোবর আরেকটায় কস্তুরি ।
আখ আর বাঁশ একই মাটির রস শুষে নেয় ওরা
বাঁশকে দেখিও শুন্যই থাকে আখ হয় চিনি ভরা ।
এমন হাজারো উপমান আছে এ ধরায় দৃশ্যমান
দুইয়ের মাঝে আকাশপাতাল রহিয়াছে ব্যবধান ।
পাপিষ্ঠ খায় তদ্দ্বারা হয় নাপাকীই নির্গত
পুণ্যবান যা খান তাহা হয় প্রভু-নূরে পরিনত ।
অসৎ লোকের খাদ্যতে হয় হারামের খাহেশাত
সৎ লোকদের খাদ্যতে হয় আল্লাহর মারেফাত ।
সৎ লোক হয় পাক পবিত্র সাথে সাথে উর্বর
অসৎ ব্যক্তি হয় নোনাভূমি একদম অনুর্বর ।
একজন হয় পূতপবিত্র ফিরিস্তাদের মতো
আরেকজন যে দৈত্য-দানব হিংস্র প্রাণীর মতো ।
ভালো, মন্দের বাহ্যিক রূপ এক হইতেও পারে
তবে নোনাপানি মিষ্টি পানির স্বাদে এক হয় না রে ।
রুচিবিশিষ্ট ব্যাক্তি ব্যতীত চেনে না পানীয়জল
কোন পানি হায় লবনে পূর্ণ কোন পানি নির্মল ।
রুচিহীন হলে কোন বস্তুর স্বাদ বোঝা যায় না যে
কী পার্থক্য আছে মোম আর মিষ্টি মধুর মাঝে !
ফেরাউন ভাবে জাদু ও মোজেজা সমান, হায়রে বোকা
জাদুর মতোই মুজিযাকেও বলেছে সেদিন ধোঁকা ।
জাদুকর আসে লড়াই করতে মুসা নবীরই সাথে
সাথে এনেছিল নবীর মতোই লাঠিও ওদের হাতে ।
উভয় লাঠির মাঝে ছিল কত ফারাক বিদ্যমান
নবীর আমলে ওদের আমলে আসমান ব্যবধান ।
জাদুকরদের আমলের মাঝে শুধু অভিসম্পাত
এদিকে মুসার আমলের মাঝে আল্লাহর রহমাত ।
কাফেরের মাঝে বিদ্যমান রয় বানরের খাসলত
নবীদের সাথে পাল্লা দেওয়ায়, পায় শুধু জিল্লত ।
মানুষ যা করে বানর’ও তাহা অনুকরণই করে
মানুষকে দেখে মানুষের মতো করে যায় মন ভরে ।
বানর ভাবলো, আমিও তো করি কাজ মানুষের মতো
প্রতিযোগী এই বানর বোঝে না দু'য়ের ফারাক কতো ।
মানুষ সদায় আদিষ্ট হয়ে কর্ম করিয়া যায়
বানর শুধুই নকল করে, কি নির্বুদ্ধিতা হায় ।
মোনাফেকরাও নামাজ পড়তো মুসলমানের দলে
লক্ষ্য ছিল না ইবাদত শুধু লোক দেখানোর ছলে । (৭শ)
নামাজ-রোজায় ও হজ্জ-জাকাতে মুনাফেকরাও ছিল
বাহ্যিকভাবে বোঝাই যেতো না পার্থক্য এক তিলও ।
তবে পরিশেষে মুমিনের হয় গৌরব আর জয়
আর আখেরাতে মুনাফেক কাঁদে ভীষণ লাঞ্ছনায় ।
যদিও করছে উভয় জনেই একই রকম কাজ
একজন যেন পদধূলি আর অপরে মাথার তাজ ।
দু'দল দু'দিকে পৌঁছে যাইবে এক গন্তব্যে নয়
প্রকাশিত হবে কর্মের গুণে নাম আর পরিচয় ।
মুমিন লোককে মুমিন বললে অন্তরে খুশি লাগে
মোনাফেকদের, মোনাফেক বলে দেখিও কেমন রাগে ।
মুমিন শব্দ মুমিন গুণের কারনেই তাঁর প্রিয়
মোনাফেক নামে মুনাফেকি দোষ তাই তো নিন্দনীয় ।
‘মীম’ ও ‘ওয়াও’ ‘মীম’ আর ‘নূন’ থাকলে অনির্ণীত
একযোগে হয় মুমিন শব্দ ভীষণ সম্মানিত ।
মুনাফেকদের মুনাফেক বলে ডেকে দেখো কিছুক্ষণ
বিচ্ছুর মতো অন্তরে তার করতেছে দংশন ।
যদি এই নাম দোযখ হইতে উদৃত নাই হতো
তাহলে এ নামে ক্রোধের প্রকাশ হতো দোযখের মতো?
এই যে নামের খারাবী হরফ হইতে সৃষ্ট নয়
সাগরের পানি তিক্ত হওয়ায় পেয়ালার দোষ হয়?
হরফ পাত্র সাদৃশ্য আর অর্থ পানির ন্যায়
অর্থ-সাগর তিনি যার কাছে লওহে মাফুজ হায় ।
নোনাপানি আর মিঠাপানি দু'ই বয়ে চলে বরাবর
কখনো প্রভাব খাটাতে পারে না একে-অপরের 'পর ।
উভয় নদীই প্রবাহিত হয় একই উৎস থেকে
উভয় নদীর উৎপত্তিস্থলে গিয়ে যদি আসো দেখে ।
কৃত্রিম স্বর্ন, আসল স্বর্ন যাচাই করিয়া নিবে
কষ্টিপাথরে নিশ্চিত করে না নিলে পস্তাইবে ।
যার অন্তরে কষ্টিপাথর প্রভু দিয়েছেন গুঁজে
সে একিন আর সংশয়েরও তফাতটা নেয় বুঝে ।
তোমার মনকে যাচাই করতে দেখো না প্রশ্ন করে
সত্যমিথ্যা অনুভবে মন ঐশী নূরের জোরে ।
মুখের মধ্যে কাটা বিঁধে গেলে লাগে খুব অস্থির
যখন উহাকে বের করা হয় ছোঁয়া পায় স্বস্তির ।
আবার কখনো খাবারের মাঝে খড়কুটো চলে গেলে
জীবিত লোকের চেতনা শক্তি উহা বের করে ফেলে ।
জাহেরি চেতনা, এই জগতকে চেনার উপায় বলে
বাতেনি চেতনা, উর্ধ্বজগত দৃষ্টিসীমায় খোলে ।
শরীরী চেতনা লোপ পেলে যাও চিকিৎসকের দ্বারে
রূহানী চেতনা, উন্নতি হবে অলিদের দরবারে ।
বোধশক্তির সুস্থতা থাকে শরীর সুস্থ হলে
আত্মার বোধ সুস্থতা পায় শরীর ক্ষয়ের ফলে ।
জানের বাদশা দেহকে উজাড় করিয়া ফেলার পরে
নিজের মনের মতোন করিয়া আবার আবাদ করে ।
উত্তম সে-ই ত্যাগিবে যেজন, পাইতে প্রেমের পথ
অফুরান সেই নেয়ামত ত্যাগি পার্থিব দৌলত ।
ধনভাণ্ডার পেতে যদি কেউ বাড়ি করে খানখান
তার দ্বারা ফের ভালোভাবে বাড়ি করা যাবে নির্মাণ ।
মনে করো, পানি বন্ধ করে সে নদী সাফ করে নিল
তারপর সেই নদীতে নতুন পানি চালু করে দিল ।
চামড়া কাটিয়া তীরের ফলক বাহির করিয়া নিল
আবার সেখানে নতুন চামড়া গজাইয়াও উঠিল ।
শত্রুর থেকে বিনষ্ট কোন দূর্গ করিয়া জয়
সেখানে নতুন দূর্গ আবার নির্মিতি পুনরায় ।
আলোচনারও উর্ধ্বে এ-সব বোঝানোর ভাষা নেই
যাহা বলিলাম, শুধু আত্মার দরকারী তাগিদেই ।
আরেফের চোখে প্রকাশিত হয় তাজাল্লীর তুফান
মারেফাতের বিস্ময় হেরি হয়ে যায় হয়রান ।
বিস্ময়কর এই রহস্য জ্ঞাত করা হয় যাকে
সে-তো দুনিয়ার সবকিছু হতে দিশেহারা হয়ে থাকে ।
বিভ্রম থাকে এমনটা নয় অলিদের বিভোরতায়
নিঃসংকোচে ডুবে থাকে মন বন্ধুর ভালোবাসায় ।
একজন ওই নিবদ্ধ থাকে বন্ধুর সম্মুখীন
আরেকজন যে বন্ধুর সাথে পুরোপুরি হয় লীন ।
উভয় শ্রেণির অলিদের প্রতি রেখো তুমি সম্মান
সহবতে গেলে বোঝা যাবে ভালো দুজনের ব্যবধান ।
এবাদত মনে করিও এ-সব অলিদের জিয়ারত
খেদমত করে সুগম করিও সৌভাগ্যের পথ ।
(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২