সালেহা চৌধুরী ও কবিতাগ্রন্থ 'দলছুট শব্দেরা'
খাতুনে জান্নাত
.......
কবি, সাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী, যাঁকে সাহিত্যিকগণ ডাকেন শিল্পের বাবুই। তিনি বুনে চলছেন শিল্পবাড়ি অথবা যেন অনন্তকাল কাল ধরে সাহিত্যের বাগানে রজনীগন্ধা বুকে ফুটে থাকা ঘাসফুল। ডাক ঢোল নেই, প্রচার প্রচারণা নেই, তবে প্রসার আছে। ' নিরন্তর রোদের মিছিলে ' বইতে তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম "সহোদরা " নামে একটি কবিতা ,‘ আপনাকে পাঠে মগ্ন নীরব আবহ/ মনন সমুদ্রে তরঙ্গরাশি বিস্তৃত করেও/ এই মূর্ত মঞ্চে অতি সহজিয়া/ রজনীগন্ধা বুকে সুহাসিনী প্রিয়া।’
গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, গদ্য লেখায় সিদ্ধহস্ত সালেহা চৌধুরী। লেখার অবয়ব দীর্ঘ। চষে বেড়িয়েছেন বিশ্বের আফ্রিকা, ইউরুপ, আমেরিকার অনেক দেশ। গ্রন্থসংখ্যা বাহাত্তর। সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন অনন্যা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার। বিশ্ব সাহিত্য চষে বেড়িয়েছেন। তুলে এনেছেন সাহিত্যের মণিকাঞ্চন। অতিরিক্ত বই প্রকাশের কারণে কখনো কোনো কোনো গ্রন্থে সে ছাপ পরিদৃষ্ট হয়। তবুও উদ্দাম তার কলম ও আজকালের কিবোর্ড। কবিতা গ্রন্থের সংখ্যা কম। বোঝাই যায় তিনি কবিতায় অনিয়মিত। ইংরেজি কবিতার বই দুইটা। বাংলা কবিতার বই হাইকুসহ তিনটা। ইংরেজি কবিতার জন্য পুরস্কৃত। বিমূর্ত ভাবের সরল সংবেদন তার কবিতা। সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘বেহুলা বাংলা" প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘দলছুট শব্দেরা’ কাব্যগ্রন্থ। নামেই গ্রন্থটির একটি পরিচয় মেলে। কুড়ানো ফুলের গ্রন্থিত মালার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবিতাকে মলাটবদ্ধ করা। যেমন বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে সংবৃত করে কবিতা গ্রন্থিত হয়।
সালেহা চৌধুরী থাকেন দেশে ও যুক্তরাজ্যে। কবিতার ব্যাপ্তি ও মনন মাধুর্যতায় ধরা পড়েছে সে দ্বিখণ্ডিত আত্মার অতৃপ্ততা, বিষণ্নতার মায়াজাল, শব্দ সংযোজনের পরিপক্বতা, চিন্তার গভীরতা, নস্টালজিক কাতরতা, জাদুবস্তবতা চিত্রমালা, দেশ ও সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি লিখে চলেছেন অদম্য মনোবল ধরে রেখে। তৈরি করেছেন পাঠক ও সুহৃদ।
দলছুট শব্দেরা বইতে কবিতার সংখ্যা আটাত্তর।
১. শ্রদ্ধাভাজনেষু/ প্রিয়তমেষু
২. প্রকৃতি, প্রেম
৩.মানব মানবী
৪. দেশ ও ভাষা
চারটি ভাগে কবিতাগুলো সাজিয়েছেন তিনি।
যদিও সূচীপত্র দেখে কবিতাগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। পৃষ্ঠা ও কবিতাক্রম নাই। মলাটবদ্ধ হয়েও আলাদা। নাম ধরে কবিতা পাঠে কিছুটা নয় বেশ বিভ্রাট সৃষ্টি করেছে। প্রকাশকের বিষয়টা নজরে আসলে পাঠক উপকৃত হত।
যাইহোক, কবিতা অনন্ত যাত্রার পথে। সালেহা চৌধুরী বিশ্বাসী মানুষ তার পরিবেশ ও মনোজগৎ তেমনি এক গুপ্ত শুপ্ত বেদনা ও রসে আরাধ্য শব্দাবলী নিজস্ব অবগুণ্ঠনে সৌন্দর্য প্রিয়াসী হয়ে ওঠে। সেখানে বেদনার ঘনঘোর আছে, আছে সরলা কিশোরী, বা উদ্ভিন্ন যৌবনের আকিঞ্চণ। স্মৃতির হরিণী পিছু ফিরে ফিরে দেখে ফেলে আসা পথ ও রথের মায়ারেখা।
জীবন যেন বটগাছে বসা পাখি। উড়ে যাবার পর পড়ে থাকে ঝরা পালক। তবুও মুঠোয় আলো থাকে, শিউলি ফুল থাকে। দেশ ছেড়ে আসার কান্না থাকে। স্বদেশের টান এত সজীব যে ল্যাপটপকেই মনে করেন মাটি, করেন ঘাটাঘাটি। দেশ ও মানবিক বিচ্ছিন্নতা ও আবেশ। সালেহা চৌধুরি নিবিষ্ঠ থাকেন আরাধ্য ধ্যানে। বর্তমান পৃথিবীর চাল ও চিত্র, কবিতার গতিপথ কোন ধারায় প্রবাহিত এসব তিনি ভাবেন না। লিখে চলছেন আনমনে গদ্যের নিবিড়তার মধ্যে ফুটে উঠা বিচ্ছিন্ন অনুভাবনা ও বিমূর্ত আবেগ। কখনো উঠে আসে মা, বাবার কলম, কখনো বিশ্ব আলোকিত করা জন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, শামসুর রাহমান, বেন জনসন, ডিলোন টমাস, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাদের অন্তরে ধারণ করে পথচলা লেখার অমনিবাস। কল্পনায় কল্পনায় ছড়িয়ে যাওয়া, ছুঁয়ে দেয়া যাদের সাথে দেখা হয়নি অথচ তাদের জন্য হৃদয়ে ফুটে আছে লাল গোলাপ। অথবা আয়নার উল্টোদিকে প্রিয়জন পাশে থেকেও কাছে না থাকার যাতনা। বেদনার গভীর থেকে উঠে আসে কবিতার মায়াবী সুর, জীবনের নিখাদ অনুরণন। সুরের কলিংবেলে বাজাতে চান নিজস্ব চাওয়া পাওয়ার সাথে বিদগ্ধ জনের উপস্থিতি, আলো ও আঁধার। পাঠক থেকে প্রেমিকা জীবনের সহচর। কল্পনার আরাধ্য পথে হাঁটতে হাঁটতে আরাধ্যজনের স্পর্শে-আনন্দে জীবন সচল হয়ে যায়। ডাল গজায়, তারার ফুল ফোটে। কল্পনার আবেশি হাতে কখনো একটা ইলেকট্রিকের যন্ত্রও প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারে। কখনো কৃষক, নিপীড়িত জনের ব্যথা, বেদনা রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক শোষণে মানবতার ক্রন্দন। পৃথিবী মহাকাশ ছোঁয় আর কৃষক পড়ে থাকে সেই আদিকালে, ফসলের ন্যায্য দাম থেকে আজো বঞ্চিত, বঞ্চিত জীবন স্পর্শ থেকে। তাদের ঘরের চাল ফুটো, পোশাকে তালি। বন্যা, খরা, মহামারি ও মড়কে বিধ্বস্ত সেই অভাব ও হাহাকার, সেই দূরারোগ্য ব্যাধি ও চিকিৎসাবিহীন বিদায় গুনন।
আসুন এক সাথে সালেহা চৌধুরীর কয়েকটি কবিতা বা কবিতাংশ পাঠ করি।
' তুমি দোতলার মানুষ
না হলে উত্তরায়ণের বারান্দায় কখনো
তুমি চলমান নাগরিকের একজন নও
কেবল দূরবিন চোখে ওদের জীবন এঁকেছো
আকাশ বিহারি কবি
সব ভুলে কেবল আকাশ দেখেছো।
ঝড় জল উত্তাল আর প্যাচপ্যাচে কাদা
কেবলই শাওন গগনের ঘোর ঘনঘটা।
সব থেকে চোখ তুলে লেখা লেখা খেলায়
আর খেলা খেলা লেখায়
কবিতা বুনেছো।
খটখটে তাঁতের মাকু
ডান থেকে বাঁয়ে আর বাঁ থেকে ডানে
বুনেছো কেবল মিহি মসলিন শাড়ি।'
(নাগরিক আকাশ)
গল্পের মতোই টানা গদ্য। খুব গোপনে চুপটি করে থাকে শিল্পের সারস। তাকে আদরে ডেকে নিতে হয় স্পর্শের সাহসে। শিল্পের আরাধ্য রসে আপ্লূত করে প্রাণ। চিত্রকল্পের বৈচিত্র্যময় প্রবাহ স্ব-সময়কে বহুদূরে টেনে নিয়ে যায়।
'আমি অনেকদিন থেকে জানি মানুষের শরীরে যে আত্মা থাকে
যে উৎসমুখের সন্ধানে মানুষের দীর্ঘ যাত্রা
তুমি তা
তুমি জাতির পিতা তুমি জাতির আত্মা। '
(তোমার কথা ভেবে হে জাতির পিতা)
তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা ' কথা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে' তে আত্মার স্পর্শ থাকে।
মানুষের মনের সঙ্গে মনের সুগভীর সংযোগ যা নিয়ন্ত্রিত করে মস্তিষ্ক এটাকেই আত্মা বলেন তিনি ।
'যখন আমি একা তোমাকে বুকের ভেতর পাই।
তোমার দুই হাজার সাতশো গানের পর
যাদের আত্মায় একফোঁটা ছোঁয়া লাগে না
কে বলেছে তোমাকে তাদের নিয়ে ভাবতে?
আত্মা আত্মা! কি সে জিনিস রবিবাবু?
আমি বলি, বাদামের খোসার অন্তরালের নিরেট বাদাম।''
সালেহা চৌধুরীর কবিতা মনকে প্রশস্থ করে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তে, লঘিষ্ট থেকে গরিয়ানে। নিয়তিকে অমোঘ মেনেও যে প্রশ্ন তোলা হয়! সে সমাধান বিহীন প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন ছুটে ছুটে বেড়ায় কবিতার মাঠে, প্রলয়ে নিনাদে, কোমলে, কমলে।