সাহিত্যে বারোজন নোবেল বিজয়ী নারী-- জীবন ও সাহিত্য: সালেহা চৌধুরী
আলোচনা: খাতুনে জান্নাত
............
নারী ও নারীর জীবন যে নিজেই এক বিমূর্ত শিল্প। যাকে ঘষে ঘষে জীবন আলোকিত হয়। ভেঙে চুরে হয় শিল্পময়। এটাই যেন প্রকৃতি আমরা বলি নিয়তি। সে নারী কি প্রকৃতি কে ভাঙতে পারে? আলো বিলাতে বিলাতে প্রদীপ কি হতে পারে আলো? শিল্প কি হয়ে উঠতে পারে শিল্পী স্বয়ং? এসব সহজাত প্রশ্ন আমাদের অন্তরে; তৈরি করে দহন নিরন্তর...

সাহিত্যিক, কবি, অনুবাদক, আলোচক বহুবিধ কর্মের সংযোজনে
অনুসারীদের উদ্দীপ্ত করা সালেহা চৌধুরী। বসবাস করছেন লন্ডনে; শত বৈরীতার মাঝে সঙ্গত কারণেই তাঁর “সাহিত্যে বারোজন নোবেল বিজয়ী নারী : জীবন ও সাহিত্য” বইটি নিয়ে আগ্রহান্বিত হই ও সংগ্রহ করি। পড়তে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠি। বিশ্ব সাহিত্যের অপার রহস্যের সাথে নিজেকে যুক্ত করি। শিল্পের অসীম স্বাদ গ্রহণের সাথে সাথে জানতে পারি অনেক অজানা কথা। নারী সাহিত্য দুর্বল সাহিত্য, নারী কবিতা দুর্বল কবিতা। আবৃত্তিকারদের সাধারণত নারী কবিদের কবিতা আবৃত্তি করতে দেখা যায় না। এসব দেখতে বুঝতে অভ্যস্ত চোখ ও মন কিছুটা মুক্তির শ্বাস ফেলে। যদিও এ বই টি আমার জন্য পিঁপড়ার সাগরে সাঁতার। আমি সাঁতার কাটছি, হাবুডুবু খাচ্ছি- ভেসে উঠছি। নারীদের নোবেল বিজয় এও  সম্ভব!

সালেহা চৌধুরী বইটিতে ‘আমার কথা’ শিরোনামে বলেছেন, একশত ছয় জন নোবেল পাওয়া সাহিত্যিকের মধ্যে মাত্র বারোজন নারী। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ বারোজন কি বারো শত জন পুরুষের সমান নয়! কতটুকু প্রতিভা থাকলে সংসার ও সমাজের জটিল কাঁটা-জালের ঊর্ধ্বে ওঠে নারী বের করে নিজের জন্য একটু সময়! কাজ করতে করতে থিতানো মন ও শরীর বিশ্রামের জন্য যখন উন্মুখ হয় এ ক্লান্ত মগজ কী করে ধরে শিল্পের বা দর্শনের মতো জটিল শাখায় আবর্তন। তখন কী করে তেরি করে নিজস্ব সময়। আস্বাদন করে সাহিত্য রস। অবচেতন স্তরে তৈরি হয় ঘূর্ণন আর চেতন স্তরে পৌঁছে তুলে আনে সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞানের সূক্ষ্ন কণিকা। যে জটিল আবর্তে পড়ে অনেক সাহিত্যিক, শিল্পীকে সরে যেতে দেখি, কর্মজীবিকে দেখি কর্মহীন হতে। কেননা নারীকে সংগ্রাম করতে হয় ঘরে - বাইরে, শরীরে - হৃদয়ে, মনে ও মননে। কাকে আমরা দোষ দেব? জীবনের গতিকে না বংশগতিকে, প্রকৃতিকে না সমাজকে! যতক্ষণ না সমাজ মানবিক হয়ে ওঠে। আর মানবিকতাই জন্ম দেয় বিবেক ও ঔদার্য। উইসলোয়া সিমব্রসকার ভাষায় বলা যায়,

সূর্য থেকে দূরের তৃতীয় গ্রহ
বিভিন্ন পাশবিকতার মাঝখানে
যখন জানো   তোমার বিবেক,
এ-ই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ।

সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পথ পরিক্রমাই সংগ্রাম। সংগ্রামে জয়ী ব্যক্তি টিকে থাকবে। সালেহা চৌধুরীর জীবন ও কি এমনই এক সংসার-চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েনি? তিনি মা কিংবা গৃহিণী হিসেবে কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন কিন্তু সাহিত্য বিশ টি বছর বঞ্চিত থেকেছে। হয়ত এ বিগত সময়ে তিনি সৃষ্টি করতেন উজ্জ্বল কোন পঙতি, বিমূর্ত আবহ। তিনি যখন জ্বলে উঠতে চাইছেন জীবন কেটে রেখেছে অনেককিছু। আজও তাঁর কর্ম-স্পৃহা, সংগ্রাম আমাদের সাহস জোগায়। এ বই টি করতে যেয়ে তাঁর অসীম পরিশ্রম মননে নাড়া দেয়। অন্তত সহায়ক গ্রন্থ হিসাবে বিয়াল্লিশ টি বইয়ের তালিকা দেখতে পাওয়া যায়। এরপরও নানা ওয়েব সাইট সার্চিং তো রয়েছেই। অবশ্য তাঁর ‘আমার কথা’ শিরোনাম থেকে আমরা জানতে পারি না বই টি লিখতে কত সময় লেগেছিল? এটি একটি দুর্লভ বই নিঃসন্দেহে আর তার অপরিসীম নিষ্ঠায় বই টি বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সংগ্রহ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

এ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই স্যালমা ল্যাগারলফ (১৯০৯) থেকে হার্টা মুলার(২০০৯) এই একশত বছরের মধ্যে বারোজন সাহিত্যিক। যাদের জীবন ও সাহিত্য বিধৃত আছে। এ নোবেল বিজয়ীদের একজনও এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার ধর্ম ও সমাজ আক্রান্ত নারী নয়। তাঁদের ভাষা, জীবন যাপন, অধিকার, মৌলিক ভাবনা-চিন্তার অগ্রসরমানতা সর্বোপরি তাদের প্রতি নোবেল কমিটির অনুকূল মনোভাব। তাই তাঁদের সৃষ্টি গতিপ্রাপ্ত ও পুরস্কৃত। এখানে এশীয় নাম নেই। না থাকলেও ভবিষ্যতে থাকবে না তা বলা যায় না কেননা আজকের বর্তমান শিক্ষিত ও সংগ্রামী নারীরা জেনেটিক্যালী এগিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অবশ্য সবকিছুর জন্য প্রয়োজন ভাষা কে আন্তর্জাতিকরণ করার প্রচেষ্টা। আর তা স্বভাবতই রাষ্ট্রের হাতে বর্তায়। সে যাক, এ দূর বিশ্বের নারীদের নোবেল বিজয় আমাদের আনন্দিত করে, গর্বিত ও করে। কেননা এঁরা আমাদের মা ও সহোদরা। সামাজিক প্রহার, সন্তানের দায়, সাংসারিক ঘটি-বাটি বহনের ভার এঁদের উপর ই ছিল বেশি আর ছিল সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনের মতো কঠিন ও দুরূহ ভার। তাই এ বই আমাকে আলাদা এক আগ্রহে আগ্রহান্বিত করে-কি লিখেছেন এ নারীরা?

প্রথমে এই সাহিত্যিকদের নাম, জন্ম-মৃত্যু, নোবেল প্রাপ্তির সাল, দেশ ও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য একনজরে দেখে নেয়া যাক:
১. সেলমা ল্যাগারলফ: (জন্ম ২০ নভেম্বর, ১৮৫৮,মৃত্যু ১৬ মার্চ ১৯৪০), নোবেল- ১৯০৯, দেশ: সুইডেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-গোষ্টা বারলিংগা সাগা, ইনভিজিবল লিংকস, দি মিরাকল অফ অ্যান্টিক্রাইস্ট, জেরুজালেম, অ্যাডভেঞ্চার অফ নিলধ, সেলমা ল্যাগারলফের ডায়েরি।
২. গ্রাজিয়া দেলেদ্দা: (জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭১, মৃত্যু ১৫ আগষ্ট, ১৯৩৬), নোবেল- ১৯২৬, দেশ:ইতালি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ফ্লাওয়ার ফর্ম সার্ডিনিয়া, দি ওয়ে অফ ইভিল, সার্ডিনিয়ার স্টোরি, দি অনেস্ট সোল, সিনেরি, আইভি, রিডস ইন দ্যা উইডস, মারিয়না সিরকা, দি মাদার, দি ফ্লাইট ইনটু ইজিপ্ট, দি সিট অফ লাভ।
৩. সিগরিট উন্ডসেট: (জন্ম ২০ মে ১৮৮২ মৃত্যু ১৯৪৯), নোবেল প্রাপ্তি-১৯২৮, দেশ: নরওয়ে (জন্ম: ডেনমার্ক)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ক্রিস্টিন লারভানসডাট্রার, ম্যান ওম্যান এন্ড প্লেসেস, দি মাস্টার অফ হাস্টাভাইকেন, গানারস ডটার, জেনি, বসন্ত, ইডা এলিজাবেথ, হ্যাপি টাইমস ইন নরওয়ে।
৪. পার্ল এস বাক: (জন্ম-২৬ জুন ১৮৯২ মৃত্যু-১৯৭৩), নোবেল-১৯৩৮,
দেশ:আমেরিকা (বড় হয়েছেন চীনে), উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দি গুড আর্থ, দি সান, দি মাদার, কাম মাই বিলাভেড, সাটান নেভার স্লিপ্স, ইমপেরুয়াল ওম্যান।
৫. গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল: (জন্ম-৭ এপ্রিল ১৮৮৯ মৃত্যু-১০ জানুয়ারী ১৯৫৭), নোবেল-১৯৪৫, দেশ: চিলি (দক্ষিণ আমেরিকা),উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মৃতের সনেট, ডেসোলেসন, নারীদের জন্য বক্তৃতা, তালা, লাগার, চিলির কবিতা।
৬. নেলী সাক্স: (জন্ম-১০ ডিসেম্বর ১৮৯১ মৃত্যু-১২ মে ১৯৭০), নোবেল-১৯৬৬, দেশ:জার্মানী(পরবর্তীতে দেশ ত্যাগ করে সুইডেনে বসবাস করেন)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: লেজান্ড এ্যান্ড স্টোরিস, এলি, ইন দ্য হাউজ অফ দ্য ডেথ, একলিপ্স অফ স্টার, ও দ্য চিমনি, ফ্লাইট এন্ড মেটামরফসিস।
৭. নাদিন গর্ডিমার: (জন্ম-১৯২৩)। জন্ম ও বড় হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা। নোবেল-১৯৯১, দেশ: ইংল্যান্ড(ব্রিটেন),
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দি লাইং ডেজ, বারজের্স ডটার, দি হাউজ গান, সিলেক্টেড স্টোরিজ, অন দ্য মাইনারস, লাইফটাইম আন্ডার আপারথেড, দি লুট এন্ড আদার স্টোরিজ, বিথোফেন ওয়াজ ওয়ান সিক্সথ ব্লাক।
৮. টনি মরিসন(জন্ম-১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৩১) নোবেল-১৯৯৩, দেশ: আফ্রিকা(জন্ম-আমেরিকা)।উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দি ব্লুয়েস্ট আই, সুলা, সং অফ সলোমন, টার বেবি, বিলাভেড, জ্যাজ।
৯. উইসলোয়া সিমব্রসকা: (জন্ম- ২জুলাই ১৯২৩), নোবেল প্রাপ্তি-১৯৯৬, দেশ: পোল্যান্ড, উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: এই জন্যই আমরা বেঁচে আছি, নিজেকে প্রশ্ন কর,  কলিং আউট টু ইয়েটি, লবণ, মজার শেষ নেই, হতে  পারতো, একটা বড় সংখ্যা
১০. এলফ্রিড জেলিনেক: (জন্ম-২০ অক্টোবর ১৯৪৬), নোবেল জয়-২০০৪, দেশ: জেকোস্লোভাকিয়া, সিরিয়া (বড় হয়েছেন অস্ট্রিয়ায়)।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: উই আর ডিকোয় বেবী, ওম্যান এজ লাভার, পিয়ানো টিচার,লাস্ট, চিলড্রেন অফ দ্যা ডেড, গ্রিড, নাটকের ভেতর, ক্লা রা এন্ড মিউজিক্যাল টিচার, ফার্স উইথ সং, ডিজায়ার পামিশন টু ড্রাইভ, ক্লাউডস হোম।
১১. ডোরিস লেসিং(জন্ম ১৯১৯) জন্ম  : পারসিয়া (বর্তমান ইরান), বড় হয়েছেন আফ্রিকায়। । দেশ: ব্রিটেন,  উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: সিকাস্তা, দি গোল্ডেন নোটবুক, গ্রাস ইজ সিংগিং, ব্রিফিং ফর এ ডিসেন্ট ইনটু হেল, দি গুড টেরোটিস্ট, কানুপুস ইন আরগোস এবং ক্লেফট
১২. হার্টা মুলার(১৭ আগষ্ট, ১৯৫৩- ) ২০০৯। দেশ: জার্মান, (জন্ম-রোমানিয়ায়)।উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দি পাশপোর্ট, দি ডেভিল ইজ সিটিং অন দ্যা মিরর, ইভেন ব্যাক দেন দি ফক্স ওয়াজ হান্টার, এ ওয়ার্মর পোটাটো ইজ এ ওয়ার্ম বেড, দি ল্যান্ড অপ গ্রিন প্লাম্প, হাঙ্গার এন্ড সিল্ক

সাহিত্যিকদের জীবন নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকলে সমস্যা ও রোগে আকীর্ণ জীবন সংগ্রামে কারো কারো জীবনে সহিংসতার চিত্র ভেসে ওঠে। বেশীরভাগই স্বাভাবিক সংসারধর্মী নারী নন। মর্মস্পর্শী দুঃখ ও দৈন্যতার ভেতরে এগিয়ে যেতে হয়েছে অনেককে। এর ভেতরও নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন লেখায়। তবে পারিবেশিকতার কারণেই অধিকাংশ কোন না কোনভাবে উচ্চ শিক্ষা’র (সবার ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক নয়) সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন, সাংস্কৃতিক জীবনের আস্বাদ লাভ করেছেন; গ্রহণ করেছেন জীবনমুখী শিক্ষা। অতীতের গল্প ও উপকথা তাদের লেখার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। স্যালমা ল্যাগারলফ, গ্রাজিয়া দিলেদ্দা, উইচলোয়া সিমব্রসকা ব্যতীত বাঁকি সব সাহিত্যিকই তার নিজ দেশের বাইরে ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছেন ও বড় হয়েছেন। আমরা ধরে নিতে পারি, এ রকম পরিস্থিতিতে যে মিশ্র জীবনের স্বাদ ও গ্রহণকৃত অবসাদ তাও কখনো কখনো সাহিত্যের পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে থাকবে। নারী মুক্তি ও নারীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে দেখা যায় অধিকাংশ সাহিত্যিক কে। অনেকে সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। রাজনীতি না করেও শুধু লেখার কারণে সরকারের কোপানলে পড়েছেন, পড়েছেন সামাজিক রোষানলেও। অর্থাৎ নানা প্রতিকূল জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন। আদর্শ বদলেছেন। জীবনের প্রয়োজনে জীবন ভেঙেছেন। অনেকেই ভুগেছেন মানসিক ব্যাধিতে। কেউ বা আজীবন একা থেকেছেন। এভাবেই তাঁরা সৃষ্টি করে গেছেন প্রেম ও মানবতার গ্রন্থিকতা। দু’একজন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন সম-সঙ্গী যা নিয়ে অনেকে কটাক্ষ করে থাকে। আজকের সমাজে সম বিয়ে ও সম বাস আইনগতভাবে সিদ্ধ হয়েছে অনেক দেশে। নারী মানুষ তার মানবিক চাহিদা ও রুচির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে জীবন পরিচালনা করার সাহস ও দৃঢ়তা অর্জন সে বিংশ শতকের শুরুতে কম কথা নয়।

বলাই বাহুল্য তাঁদের সাহিত্য গভীর বোধ ও মননশীল, শিল্প ও দর্শন প্রজ্ঞাময়। তাঁরা লেখনী শৈলী কে তুলে ধরেছেন সকল ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণী ও বিভেদের উর্ধ্বে। যা পাঠান্তে মন উদার হয়, শিল্পরসে অভিভূত হয়, অলংকার মাধুর্যে ঋদ্ধ হয়।  মন হারিয়ে যায় থেম্বির ভালোবাসা পাবার আকুলতা ও সংগ্রামের কাছে। তেমনি হাটো নামের তপস্বী যে পৃথিবী কদর্য হয়ে গেছে বলে তা ধ্বংস হয়ে যাবার প্রার্থনা করত তারই অসহায় প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ জেগে উঠতে দেখে। যে বোন কবিতা পড়ে না তার সাধারণ কথায় কবিতা মূর্ত হয়ে ওঠে। আমরা শিশুদের নানা বিকৃতি ও জটিল অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের হাস্যকর করে তুলি- হার্টা মুলার’র ‘পঁচা পেয়ার’ গল্প ভাবের গভীরতা ও ভাষার মাধুর্যতায় তা দেখিয়ে দেয় । তেমনি টনি মরিসনের গল্পে কৈশোরের উঠতি কালে মনের নানা দ্বান্দ্বিকতা ও জটিলতা স্পর্শ করে। উঠে এসেছে এলফ্রিক জেলেনিকের লেখায় মেয়েদের জীবনের ক্ষুদ্রতা ও চাওয়ার সীমাবদ্ধতার কথা: যে জীবন শুধু আরাধনা করে স্বামী ও প্রেমিক। উইসলোয়া সিমব্রসকার পাথরের সঙ্গে কথা বলা কি কঠিন সমাজ জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয় না! নেলি সাক্সের কবিতা মহাজাগতিক চিন্তা ভাবের পথে তাড়িত করে। নারী মুক্তি ও নারীর যাতনার কথা গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল যেভাবে বলেন,

আমার ভেতরের সেই নারী যাকে আমি হত্যা করেছি
কারণ?
ওকে আমি ভালোবাসতে পারিনি।
ও ছিল জ্বলন্ত আগুন
পাহাড়ের ক্যাকটাস ফুল
সে খরা ও আগুন
কখনো ওর শরীর শীতল হয়নি।

পার্ল এস বাকের মা’ গ্রন্থটি মায়ের প্রতি সাধারণ মনোভাব টাই পাল্টে দেয়। তাঁর জীবনস্পর্শী লেখা নাড়ায় সনাতন ভাবনা ক্রান্ত জীবন ও আবিষ্ট সমাজ ব্যবস্থাকে।

আমরা পড়ি। ভাষার সুনিপুন গাঁথুনী, অলঙ্কার, উপমা ও চিত্রকল্পের উর্বর অনুসঙ্গ ও আধুনিকত্বের বিভা টানে। গল্প কবিতা, নোবেল ভাষণ সর্বত্রই ভাব, ভাষা ও আবেগের রুচিস্নিগ্ধ বলয়ে পাঠক মোহিত থাকে। শিল্পের জন্য শিল্প বা জীবনই এক আশ্চর্য শিল্প মিথস্কিয়ায় প্রাণিত হয়ে উঠে প্রাণ। সহজাত অনুবাদের কারণেও বলা চলে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি এ বিশ্ব বরেণ্যদের জীবন ও সাহিত্য। আসলে এ গ্রন্থে একটি দু’টি গল্প বা কবিতা যা সাহিত্য মানে যেটুকু অনেকটা তরকারীর লবন চাখার মতো। এ শুধু আগ্রহ বাড়াতে পারে। এত বিশদতা এ ক্ষুদ্র কলেবরে সম্ভব ও নয়। যেটুকু মিলে আমরাও অশ্রুসিক্ত হই সালেহা চৌধুরীর মতো সালমা ল্যাগারলফের ঋণ ও তা পরিশোধের কাল্পনিক চিন্তা দেখে। হার্টা মুলার মায়ের রুমাল নেয়ার ঘটনায় এক মর্মস্পর্শী জীবনের গল্প বলে গেছেন তার নোবেল বক্তৃতায়। বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়লে অনেক সময়ই দেখা যায় তাঁরা জীবনের বৈরিতা ও কদর্যতায়  আবদ্ধ হয়ে আত্মহত্যার শিকার হন। কিন্তু আমাদের এ বারোজন সাহিত্যিকের মধ্যে তা দেখতে না পেয়ে আশান্বিত হই। সংগ্রাম ও সাহসে নিজেকে সম্পৃক্ত করার অনুপ্রেরণা জাগে।

সালেহা চৌধুরী’র বদান্যতায় বারোজন বিশ্ব সাহিত্যিক এক মলাটবন্দি।
অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরের সাহিত্য, দেশ ও সংস্কৃতিও দৈনন্দিনতার অংশ হয়ে মুক্ত করছে মনের আকাশ ও ভূমি। অভিভূত, আমি অভিভূত! যতই পড়ছি গল্প, কবিতা আর তাদের বৈচিত্রময় জীবন আকর্ষণ করছে, অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করছে মনের তৃষিত পটভূমি। সাথে সাথে মনে পড়ছে সালেহা চৌধুরীর কথা। নিজের দেশ সমাজ থেকে দূরে থেকে তিনি হয়ে উঠছেন বিশ্ব জনের। তাই তো তার প্রাণের টান বিশ্বকে বাঙালি পাঠকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়; সাথে জ্ঞানের পরিধি ব্যাপ্তির তাড়নায় ও হয়তো এ কর্ম প্রয়াস। যিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে সংগ্রহ করেছেন, বিশ্ব সাহিত্য কুড়িয়ে তোলা ফুল গ্রন্থিত করেছেন। যা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে তা বলারই অপেক্ষা রাখে না।

বইয়ের সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমার মনে হয়েছে বা বই পাঠে কিছুটা বাধা গ্রস্ত করেছে তা হল সর্বশেষ সাহিত্যিকের নাম প্রথমে লেখা। যে কারণে আমাকে বইয়ের শেষের দিক থেকে প্রথম দিকে আসতে হয়েছে। কেননা আমার আগ্রহ প্রথম নারীকে দেখা বা তার
ধারাবাহিকতা। মনে হয়েছে নোবেল বক্তৃতা টা সাথে আসলে কি হত? একইসাথে জীবন, সাহিত্য ও নোবেল ভাষণ। বার বার ১০০১টি বই এর কথা বলা এবং সাহিত্যিকের জীবনী বর্ণনা কালে নিজের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি প্রকাশ পাঠে ছন্দপতন এনেছে। যা ভূমিকায় বলতে পারতেন বলে আমার মনে হয়েছে। যাইহোক, এটা অতি ক্ষুদ্র বিষয়। সালেহা চৌধুরী যা ভাল মনে করেছেন সেভাবে লিখেছেন। এটা ব্যক্তি বিশেষের রুচি ও পছন্দের ব্যাপার।

সবশেষে বলা যায় সালেহা চৌধুরীর এ গ্রন্থ এক আলোকবর্তিকা হয়ে সব মহলের সকল পাঠকের মনকে আলোকিত করুক আর সালেহা চৌধুরী কে দিক আরও দীর্ঘ জীবন যেন তিনি বিশ্বনন্দিত হয়ে উঠতে পারেন তাঁর শৈল্পিক কাজের জন্য...
বইটির প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স
মূল্য -৩৫০ টাকা
.
খাতুনে জান্নাত
লন্ডন, ২০১৩