কবি মুনিষ মুর্মু। তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বর। পশ্চিম বঙ্গ, ভারতের হাওড়ায় বসবাস। পূর্বজনের ভিটিবাড়ি কুমিল্লার কাসারিখলা ও , বরিশালের কলসকাঠি, বাংলাদেশ।
মুনিষ মুর্মু সমূহ সরবতার মাঝে নীরব আবহে ধ্যানমগ্ন কবি। প্রচারে নেই, প্রসারেও নেই। প্রশংসা যেন তাকে ম্রিয়মান করে, প্রচার যেন তাঁর কুণ্ঠা বর্ধিত করে। কবিতায় তিনি উচ্চকণ্ঠ, ঐতিহ্যের প্রেরণায় দৃঢ় সচেতন। প্রেম ও পৌরাণিক শব্দ ও বন্দনায় উচ্চকিত। স্পন্দিত আলোর ঝরণার মতো বেগমান। হঠাৎ পিছু ফেরানোর মতো সচেতনতায় চকিত করে পাঠককে। ভালোবাসার শুদ্ধ উচ্চারণে হৃদয় মথিত করে। আলোড়িত করে সময় সংলাপ।
মুনিষ মুর্মুর কবিতা সরল বুননের আবহে গভীর অনুভব। তাঁর ভাষা, বাক্য ও বিভা কবিতার কঠিনতার পথ ধরতে শেখেনি। ছন্দ ও অলঙ্কার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা স্বইচ্ছায় গতিপথ করে নিয়েছে। কোথাও আরোপিত বা চাপিয়ে দেয়া নেই। তিনি বলেন,
আমিই সেই রাজা তোডরমল
তোর প্রেমে জমি সংস্কার করি
তুই পাশে থাকলে
বাদশা আকবর হয়ে যায়
আমার কাছে ভিখিরী
দেবরাজ ইন্দ্র ঈর্ষায় পুনর্জন্মের আকুতি করে।(একটি গন্ধর্ব আলাপ)
নস্টালজিকতার শিল্পময় প্রকাশ কত উজ্জ্বল তা তার নিচের কবিতাটি থেকে বোঝা যায়...
নারী -
বিছিয়ে আছো পৃথিবীর মত।
ঘাস হয়ে ছড়িয়ে আছ আমার বুকে।
সময়ের হিসেবে তুমি
অনেক ছোট আমার চেয়ে।
ভেবেছিলে কখনও
পৃথিবী না থাকলে ঘাস
জন্ম নিত কোথায়?
জানি তুমি বলবে
ঘাস না হলে পৃথিবীর
শৃঙ্গার হত কীভাবে?
চল অমিত্রাক্ষর
কিছুটা পথ নাহয় হাঁটি একসাথে
সঙ্গম থেকে হিমবাহ
হাঁটি না হয় আজ উল্টোপথে।
নর -
অনেক সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেছি
আমরা একসাথে, জানি আমি।
পথের প্রতিটা বাঁকে
আজো হয়ত পাওয়া যাবে
আমাদের ফেলে আসা চরণচিহ্ন।
শুধুমাত্র তোমার জন্য ছন্দা
কফিনে ভরেছি সময়
মমি হয়ে আছে অনুভুতিগুলো
মরুর পথে যেতে যেতে
যেদিন ডুবে যাবে সূর্য
কোনো আগামী পথিকের
জন্য রেখে যাব অসমাপ্ত অনুরোধ
পিরামিডের শূন্য গহ্বরে
আমাদের স্মৃতি ডানায় জড়িয়ে
চামচিকা উড়ে বেড়াক অনন্তকাল।
(প্যাপিরাস)
কবির প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একটি। নাম "পোড়ারুটির অকবিতা' (২০২১)। নামেই বিধৃত কবিতার পরিচয়।
শ্রমজীবি মানুষের অন্তর্দহন ও বিলাপ কবিতার ছত্রে ছত্রে। মূল্যহীন শ্রম কৃষক, শ্রমিক, মুটে, মজুর, মেথরের জীবনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আনে অসাম্যের বাতাস। তার উপর বর্ণ প্রথার প্রকোপ তো রয়েছেই। কবির দক্ষ কলমের বাক্য ও বিভাসে অলংকৃত কবিতার অবয়ব। অনেকের মতোই কবির এ আবেশ লোকদেখানো বিলাসব্যাসন নয়। তিনি মনের দহন সাথে করে আজীবন কাজ করেছেন শ্রমজীবি মানুষের সাথে। তাদের দুঃখ ও বেদনার ভেতরে প্রবেশ করে আঁজলা আঁজলা চোখের জল পান করেছেন। তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের অবহেলা, নির্যাতীত নিপীড়িত মানুষের আত্মার ক্রন্দন শুনতে পায় না ভাবলেশহীন সভ্যতা।
কবির অন্তরাত্মা কেঁপেছে সে ব্যথা ও বেদনায়। তিনি নিজেও সে ক্রন্দনের অংশ, তিনি নিজেও রাষ্ট্রীয় বিভাজন ও বৈরিতার অংশ। ধর্ম যেখানে, যে রাষ্ট্রে প্রবল জীবনের গান সেখানে বেদনাবহ।
'পোড়ারুটির অকবিতা" গ্রন্থে রয়েছে মানবতার আর্তি...
"শহরের ভাঙা ফুটপাথের সাথে
ছেঁড়া হাওয়াই চটির সহবাস
জংধরা পেরেক পা থেকে
বের করে প্লাসটিকে
বেঁধে নিই ক্ষত ।
শহর পরিষ্কার হয়ে গেলে
তখন কী দিয়ে বাঁধব ?
শ্রম আইন আর শ্রমিকদের জন্য নয় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পকেটস্থ করেও
ছেলেটা আমার আজকের দিনে
প্রাইভেট ব্যাংকের দরজায়
বারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা
ছ'হাজারী দারোয়ান ।
ওর প্রেয়সীও কসমেটিক্সের দোকানে
লাখ টাকার প্রসাধনী ঘাঁটা
তিনহাজারী সেলস উওম্যান ।
এতো কম টাকার বেতন দামী স্বপ্নের
জন্ম দিতে পারে না ।
ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় খুব সহজেই
ফুটপাথের উপর চাওমিনের প্লেটে ।
রাজা আসে, রাজা যায়
শুধু জামাটা পাল্টায়
চেতনার বিকাশ ঘটে না ।
সত্যেন বোসের ছবিটা ঢেকে গেছে
ধুলোবালি আর মাকড়সার জালে।
জাতীয় জীবনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞান চেতনা
ক্রমশ শীতলতর হতে হতে
গিয়েছে ঠেকে বোস আইনস্টাইন কনডেনসেটে ।
ফুটপাথ কখনও পাঁচতারা হোটেলের
করিডোর হবে না জেনেও শহরের রাজপথে
প্রতি কিলোমিটারে হতভাগ্য কালো ঘোড়াটার
খুরের নাল পাল্টে যায় ।
শনিগ্রহের চোখ থেকে জল পড়ে না ।
মেরুদন্ড সোজা করে চলতে পারিনা
হাড়ের সব ক্যালসিয়াম শেষ হয়ে গেছে
১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই ।
এখন ধুঁকে ধুঁকে চলি
পিঠে পাটকাঠি বেঁধে শ্মশানের পথে
জ্বলে ওঠার আগ্রহে ।'
(ধুঁকছি)
চৈত্র মাসের এক দুপুর ।
পাঁজাদের ছোট পুকুরের জল
প্রায় শুকিয়ে এসেছে।
পাড়ার কচিকাঁচারা নেমে পড়েছে
ঘোলাজল ছেঁচে মাছ ধরবে।
ওদের মাঝে নিতাইও আছে
ছেঁড়া গামছায়
গোটা চারেক বাটাছানা ।
বসন্ত উৎসব একবেলার জন্য ।
নিতাইয়ের বাপ কেরলে গেছে
কাজের খোঁজে।
বাড়ীতে অনেকদিন পর
আমিষ আমিষ গন্ধ।
বসন্ত উৎসব একবেলার জন্য।
(একটা অন্যরকম বসন্ত উৎসব)
পোড়ারুটির সাথে একটু নুন
পেঁয়াজ কুচি ?
সে তো লটারি ! রোজ জোটে না।
শরীরের সব নুন বয়ে গেল ঘামে।
হাতুড়ী, কাস্তে, শাবল আর গাঁইতিতে
ছাপা আছে আমাদের নুনের দাগ।
কয়েকদিন আরও নাহয়
হাড় কখানা জড়ো করে
পাঁজর চেপে বাঁচি।
আমাদের রোজকার জীবন
ক'খানা অশরীরী কঙ্কাল
হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকির সংসার ।
একফোঁটাও দুধ জোটেনা শিশু কঙ্কালের ঠোঁটে।
পাঁজর চেপে ধরে
ফুসফুস নিংড়ে কঙ্কালমাতা
বের করে আনে দুফোঁটা নুনজল
আমাদের শিশুদের সহজাত পুষ্টি।
না। এভাবে আর কতদিন?
আর নুনজল নয়,
এবার লিখব অন্য গল্প ।
ফোঁটা ফোঁটা সায়ানাইড
ঢেলে দেব আগামীর ঠোঁটে
বিষ হজম করতে শিখুক।
আসুক সেইদিন
তাদের ঘাম থেকে যেদিন
শুধু ঝরবে বিষ
সে বিষে স্নান করুক
পুঁজিবাদের তাজমহল।
(বিষাক্ত হোক হাতুড়ী)
তিনি গদ্যছন্দে খুলে খুলে দেখছেন জীবনের অসাম্যতা, ধর্মের আগ্রাসনতা, রাষ্ট্রের অর্বাচীনতা সবলের পক্ষে কী নির্লজ্জভাবে কাজ করে যায়।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ধারণ করে না সে ন্যুব্জ জনসাধারণের পথ ও রথ চিত্র। একদিকে উঁচু দালানের উচ্চ মিনার আর কর্পোরেট ঝকঝকে বিপনি বিতান অন্যদিকে দিনভর শ্রম দিয়েও দুমুঠো খেতে না পারার আর্তনাদ। এই যে, অসাম্যতা এই যে বিভেদ তা কতজনকে বেদনাহত করে?
....
কবির জন্য শুভকামনা। কবির লেখা নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছা রইলো।