কবি হানিফ মোহাম্মদ প্রগতির পথে দীপ্ত পথচলা এক কবির নাম। ২৫ নভেম্বর কবির জন্মদিন। সাল পাওয়া যায় না। তাই বয়সের ফ্রেমে বা দশকের ফ্রেমে বাঁধা যায় নাই। চির তারুণ্য অন্তরে ধারণ করে সমাজ, রাষ্ট্রের জরাজীর্ণ ব্যবধান ও অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব। কবিতায়ও তার এ সরবতা পরিদৃশ্যমান। আলোর মশাল হৃদয়ে ধারণ করে কবি ছুটছেন, অন্তহীন যাত্রা।
কবি লিখছেন প্রচুর কিন্তু প্রকাশ কম। কবিতা, নাটক আর রাজনীতি নিয়ে কর্মমুখর সংগ্রাম। দুর্বলের অধিকার আর প্রগতিশীলতার চর্চা মননে ধারণ করে তার চলার গতি ঊর্ধ্ব মুখে।
১৯৮৮ সালে যৌথ
কাব্যগ্রন্থ 'অনিক' এর পর ২০১৮ সালে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ 'পদাশ্রিত পাঞ্চজন্য'। ৬৪টি চমৎকার কবিতা সম্বলিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন, আইয়ুব আল-আমিন। ফ্ল্যাফের লেখা লিখেছেন সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক আবুল কাইয়ুম।
শিল্প্রাশ্রিত কবির ভাষা সরল ও প্রাঞ্জল। দুর্বোধ্যতার প্রহেলিকা এড়িয়ে তিনি তৈরি করেছেন শৈল্পিক অবয়বে নিজস্ব ভাষা ও বুনন করেছেন সংগ্রামী সংগীত। বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মিশেল।
এ সমাজ ও রাষ্ট্র আজ বন্দিত্বের নষ্ট শিকলে আবৃত। যেখানে লেখককে পরাজিত হতে হয় জঙ্গিবাদের চাপাতির কোপে। অন্যদিকে কালো টাকার ঊর্ধ্বগামী স্রোতের কাছে পরাজিত সমাজ ব্যবস্থা। বাজারের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি।
বিপ্লব, বিপ্লব ভাঙো সমাজ, চুরমার করো। চুরমার করো নষ্ট, ভ্রষ্ট এ চলমানতা। প্রেমেও বিপ্লব; এ বিপ্লব নিজেকে ভাঙার কারও বাহুতলে আশ্রয় প্রত্যাশী নয়। প্রেমেসিক্ত কবি চান একটুকরো উজ্জ্বল পৃথিবী। যেখানে পকেটে মারণাস্ত্র আর বুকে চাপাতি নিয়ে হত্যায় উন্মত্ত হবে না পৃথিবী।
'প্রত্যাশার ম্রিয়মান চোখে
আমরা তাকিয়ে থাকি
উহাদের জেগে-ওঠা
প্রত্যয় ও প্রত্যাদেশের অপেক্ষায় '
(সোনামুখি রোদ)
হাতুড়ি, কাচি, শাবল, কুঠারের মতোই কবিতার অলঙ্কার বেছে নিয়েছেন কবি। 'মাগুর, কৈ আর টেংরা যুবক '। চিত্রকল্প উজ্জ্বল ও নতুনত্বের আবীর মাখা।
'রাষ্ট্রযন্ত্রের পালিত পুত্রেরা
দখলে নিয়েছে সব আলোকিত পলিমাটি'।
পদাশ্রিত পাঞ্চজন্য ' কবিতাগ্রন্থ উজ্জীবিত করে চেতনা কে। আমাদের গৌরবময় অতীত। নিজের অস্তিত্ব ফিরে পাওয়া সংগ্রামই আমাদের কবিতা।
আর তাকে উজ্জীবিত রাখা স্বদেশ-প্রেমী কবির আকাঙ্ক্ষা।
'এনটিপিসির যড়যন্ত্রে খসে গেলে
বনসুন্দরীর সবুজ আঁচল
তিলোত্তমা রামপালে লেখা হবে
বধ্যভূমির নতুন ইতিহাস। '
(অগনন বৃক্ষের মৃত্যু হলে)
আলোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কবি ছুটছেন এ অন্ধকার পৃথিবীতে। 'গরীবের পেটের মতো ভাষণের শূন্যতা চোষে।' এ বধির সমাজ ধর্মের দোকানে দোকানে বেহেশতের টিকেট কিনে। মানুষের মহত্ত্বহীন মন উদার নয়। পোড়ায় অন্যের ঝাড়বাতি। অথবা বাতি কোথাও নেই কেবল অন্ধকারের আস্ফালন।
পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ইশতেহার কবিতা হতে পাঠ করা যায়...
' জ্বলন্ত অঙ্গারে হাত রেখে
প্রেমের সাতকাহন গাইতে গাইতে
হয়ে যেতে পারি জাতির ক্রান্তিকালে বিপ্লবী সুভাষ বসু।
...
চারু মজুমদারের মতো অস্ত্র হাতে হয়ে যেতে পারি
নিষিদ্ধ রাজনীতির যজ্ঞ-বলি।
...
কালের অতল হতে টেনে তুলতে পারি
ইলামিত্রের রক্তাক্ত আঁচল।....
এ আঁচলই কবির কাছে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ইশতেহার। '
ইতিহাস আবৃত কবিতাটা চমৎকার, নান্দনিক ও শোভাময় ।
কবির সাম্যবাদী মন সচল থাকুক। আরও বাঁধভাঙার কবিতা ফুটে উঠুক, প্রাণিত করুক প্রাণ। উপমা, অলঙ্কার, উৎপ্রেক্ষা ও অনুপ্রাসের দ্যুতিময় সম্ভারে মূর্ত করুক কাব্যোদ্যান ও কবি মানস। কবিকে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘ আঙ্গিকে লেখার ইচ্ছা রইল।