হৃদয় নিষিক্ত শব্দের অনুরণন কবিতা/ খাতুনে জান্নাত
ভাবনা, অনুভাবনা কখনো দুর্ভাবনার অন্বিষ্ট রূপই তো কবিতা অথবা দৈনন্দিন জড় ও জীবের সংগ্রামে সৃষ্ট কোলাহলময় পৃথিবী থেকে পলায়নপর মনোভাবের মূর্তরূপ নান্দনিকতকার পোশাকে সজ্জিত শব্দসমষ্টির নাম কবিতা । কখনো অনুভূতির আবেগ তাড়িত সঞ্চিত প্রাণরসের নির্যাসের নাম কবিতা। এও বলা যায় অনুভূতির প্রগাঢ় তাড়নায় হৃদয় নিষিক্ত শব্দেরাজির পুঞ্জীভূত অনুরণন কবিতা।
মহাবিশ্ব আর তাকে ব’য়ে ছুটে চলা তরঙ্গের আমিও এক সংযোজন। বিন্দু বা অংশবিন্দু যাই হোক এ আমি আমার উপস্থিতি মহাকালের স্রোতে সদা বহমান। আমি কেউ নই আবার অনেক কিছু। আমার আদি নেই নেই অন্ত। তবুও আমার রয়েছে হাতে ধরা দু’প্রান্ত। একদিকে পরতে পরতে জমে থাকা লাঞ্চনার ক্ষত; ভেদাভেদের নিয়ম শৃঙ্খল। অন্যদিকে প্রেমের মহাযজ্ঞে আত্মনিমগ্ন অস্তিত্ব বার বার খুঁজে ফিরে অনন্ত আবাহন; নিঃশেষিত করে জাগতিক জীবন ও তার সমূদয় সম্ভার। আবহমান কাল থেকে বিদেহী কালের কোথাও আমি ছিলাম হয়তোবা থাকবো না। যা দেখি, যা দেখতে পারি নাই বা যা দেখতে চাই এসবই তো তুলে আনতে চাই কবিতায়। রস-রঙ চালে আবদ্ধ করে নিতে চাই কষে জংধরা হৃৎপিঞ্জর। কিন্তু কোথায়! কি আমার সামর্থ যে ঝিনুকে সেঁচতে চাই অতল সাগর।
আমার চারপাশে হরিজনের উৎসব, আমার চারপাশে গুণীজনের উৎসব, আমার চারপাশে নিগৃহীতের ক্রন্দন, আমার চারপাশে ধূর্তদের স্তব-বন্দনা। আমি কি তুলেছি তাকে, আমি কি বেঁধেছি তাকে! আমি এক ভাসমান কচুরিপানা হয়ে দোদুল্যমানতার জলে শিকড় বাড়াই।কখনো খাল ও বিল কখনো হাওর। মধ্যখানে পিঠে লেগে থাকে তেলে জলে বেড়ে উঠা সমাজ-সংসার। প্রেমিকা-পতিতা, সন্তান আর মাতাপিতার কান্নায় কোন তফাৎ দেখি না তো! শূন্যে শূন্যে মিলে যেন পূর্ণ হয়ে ওঠা। কোথাও গোলক ধাঁ ধাঁ কোথাও গরিমা।প্রশ্নে প্রশ্নে পরিব্যাপ্ত জীবন-- কূল চেয়ে মাঝদরিয়ায় পাতে নোঙ্গর।
কবিতা কয়েকটি মুহুর্তকে রঙিন করে রাখে। ভাবনার অতল থেকে অনুভূতির নির্যাসটুকু ছুঁয়ে থাকে কোন কোন একাকী রাতের বাহু ও কোমর। সে আমার প্রহরী, গল্প-বলা সহচর। একাকী প্রহরের আদুরে কল্লোল, সে আমার ভোরের সূর্যগান, মাদক মাদক তান।অশ্রুর নদী থেকে কুড়িয়ে আনে হীরক কণা। ক্ষয়িষ্ণু সময়ের দ্রবণে জমে থাকা কালের ফসিল থেকে কলমে তুলে দেয় প্রাপ্তির মণিকাঞ্চন। হৃদয়ের জারক রসে তৈরী হয় প্রাজ্ঞতার তন্তুগুটি। তার উজ্জ্বলতায় প্রাণভরে সময়কে দেখি; বহুদূর অতীত ও বহুদূর ভবীষ্যৎ এক হয়ে হাতের তালুতে জমে বর্তমান হয়ে যায়। সেই তো শেখায় জীবনের এ রূপ ও বোধ যখন আমি বলি ‘ আমি ঘেটুপুত্রের কাছে শিখেছি দুঃখগুলোকে কৌতুকে উড়ানো ঔদার্য। রাতভর দুঃখ মাখতে মাখতে গড়িয়ে পড়া দেহপসারিণী সকালের রোদে ধুয়ে নেয়, অবলীলায়। তার মনের বৃষ্টিতে ধুয়েছি সকাল, কতকাল।
অক্ষর, মাত্রা, ছন্দ, অলঙ্কার, অনুপ্রাস ও আবেগ সাথে নিয়ে অনুভূতির অনুসঙ্গে গড়ে মেপে মেপে কবিতার পোশাক সাজাতে হয়। সে আমাদের কবিতার প্রথম কাল, মধ্যকালও। আজকাল কেউ কেউ ছুঁড়ে দেয় নিয়ম-শৃঙ্খল। কেন মুক্ত আমার থাকবে না মুক্তির আস্বাদ! মুক্তির আস্বাদে কবিতাও ব্রতী হয়। দেখা, শোনা, বোঝা ও না বোঝার দ্যোতনায় আমার মাঝে তৈরী হয় কিছু টানাপোড়ন। এ দুয়ের মাঝে পড়ে আমি কিভাবে সাজাতে পারি সরল মনের আলুথালু ভাব ও শারদীয়া বিন্যাস!
কোন পথটি আমার! অথবা রয়েছে নিজস্ব কোন পথ! একেবারে অভিন্ন, কারও সাথে কোন মিল নেই। যেখানে আমিই হবো এক ও একক অবিনশ্বর। ভাবনার জাহাজে চড়ে সময় চলে যায়, যেতে দিতে হয়। দ্বিধা ও সংকোচ, অজ্ঞতা ও সীমার আড়ালে পড়ে আমার প্রার্থনার কোন বন্দনায় গীত হয় পাথর সময়! কোন বন্দনার পয়ারে বাঁধি পরিযায়ী কালের বেদন অথবা কোন আনন্দের অভিধানে রাখি প্রিয় স্পর্শের মধুর কাঁপন, রক্তের সিঞ্চনে মূহুর্মুহু গেয়ে যাওয়া কোকিল সকাল। ‘দিনের জঠরে দিন/ আমি আর কতদূর যাবো? পথের মাথায় পাহাড় পাথর আমি আজ কোণ দিকে যাবো?’
মনের এসব জটিলতায় কখনো জমে যায় মেঘ। কখনো কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হয় কবিতার চরণ। সে মেঘের আড়ালে কি হারিয়ে যায় আমার আমি। হয়তো সে মেঘ ফুঁড়ে কখনো উঁকি দেয় আমার সত্তা, সঞ্জীবনী জ্ঞানরস সারিয়ে তুলতে পারে কবিতার খুঁত ও ক্ষত। প্রজ্ঞাবান বুঝে নিতে পারে। এ প্রত্যাশা আমি রাখতেই পারি।