ভোরের শিশির ভোরের পরশ
তোমাকে আমাকে চাইছে
পাখির কণ্ঠ আনন্দিত
আমাদের গান গাইছে।

মিষ্টি মিষ্টি রোদ আর হিমেল বাতাস ভরা হেমন্ত মানেই যেন ভোর, হেমন্ত মানেই যেন জীবনের প্রত্যুষ, প্রত্যুষ মানেই কাঁচা সবুজ আর সোনার বরণ রোদের মাখামাখি। রুক্ষতা, ক্লান্তি, ক্লিষ্টতা, প্রতারণা আর পরাজয়ের প্রহার কাটিয়ে এমন জীবনই যেন চায় মানব মন। মুঠো মুঠো ঘোর লাগা আনন্দ, রিনিঝিনি বাতাসের ছন্দ। বর্ষা ও শরতের বৃষ্টির পরশছোঁয়া প্রকৃতি হেমন্তে খুলে ধরে সৌন্দর্যের অবারিত দ্বার। প্রকৃতির কোলে জেগে ওঠে নীরব প্রকৃতি। টুপটাপ শিশিরের ধ্বনিতে পল্লবিত ভোর, সোনার আলোর ঝালরে রাঙা দুপুর, স্নিগ্ধ হিরন্ময় বিকেল আর কুয়াশার পোশাক পরা না শীত না গরমের মায়াবী রাত। রাতের জ্যোৎস্নায় গা ভাসিয়ে দেয়া জারি, শারি, ভাটিয়ালি আর ভ্ওায়াইয়া বাংলার সুর ও ছন্দ রূপের কালই তো হেমন্তকে কারুকার্যময় করে তোলে। বকুল, শিউলি, ছাতিম, বক ফুল রজনীগন্ধা ও কচি ঘাসের শিহরণ বয়ে যায় তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।ফুলে ফুলে নেচে বেড়ানো প্রজাপতির দলবাঁধা উড়াউড়ি জাগ্রত হেমন্তের উজ্জ্বল ছবি যেন সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা দেশটির প্রকৃত রূপ পরিগ্রহ করে। কচুরিপানার বেগুনীতে ভরে উঠা খাল, ডোবা, পুকুর যে সৌন্দর্য ছড়ায় তা তো হেমন্তের ই জয়গান। তাই তো হেমন্ত এতটা মায়াময়। কবির কলমে, শিল্পীর কণ্ঠে, চিত্রকরের তুলিতে ক্যানভাস হয়েছে চিত্রময়।

হেমন্তকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন সকল বিখ্যাত কবিগণ ই। মধ্যযুগের কবিগণের কলমে হেমন্ত ধরা দিয়েছে অপরূপ  ‍মূর্ছনায়।মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী(১৫৪০-১৬০০) রচিত‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের সামান্য নমুনা পরিদৃষ্ট হয়। কবির ভাষায়:
‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।’
মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে হেমন্তের নতুন ধান্যে কৃষকের ঘরে ঘরে সুখের আবেশ ছড়ায়। এ সময়ে তারা পরম তৃপ্তিতে সুখস্মৃতি নিয়ে আনন্দ বিলাসে মেতে ওঠে। মেতে ওঠে সার্বজনীন গান ও পালায়। বৈষ্ণব পদকর্তা লোচন দা(১৪৭৮-১৫৪০) পদে তার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে।
‘ অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।
সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে ॥
পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।
সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে ॥’
বৈষ্ণব পদকর্তাগণের মধ্যে গোবিন্দচন্দ্র দাস(১৮৫৫-১৯১৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। অঘ্রাণে কৃষাণ-কৃষাণীর সমৃদ্ধি ও সুখের সময়ে কুলবধ‚রা স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নায়রে গমন করে। তার রচিত পদে উল্লিখিত হয়েছে:
‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র
নায়র মাথুরা গেল।
পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ
বৃন্দাবন বন ভেল ॥’
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(৭ মে, ১৮৬১-৭ই, আগস্ট ১৯৪১ বা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮-২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) লেখায় প্রকৃতি ও ঋতু বৈচিত্রের আবহ ফুটে উঠেছে বিচিত্র ভাব ও রঙিন আভায়। কবির আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনায়, গান ও কবিতায় আত্মা পরমাত্মার ধ্যান ও সাধনায় লৌকিকতা থেকে অলৌকিকতার মহারূপে আত্ম নিবেদিত হয়েছে সুর ও আরাধনায়। সেখানে হেমন্ত সেজেছে অপরূপতায়। কবির বাণীতে হেমন্ত ভেসে উঠেছে প্রশান্তির বিমূর্ত ছন্দ ও লালিত্যে। কবি নজরুল ইসলাম(২৫ মে, ১৮৯৯-২৯ আগস্ট ১৯৭৬ বা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬-১২ ভাদ্র, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ) তার বিদ্রোহী সত্তার বাইরে নিটোল প্রকৃতি প্রেমী। তাঁর কবিতায়ও ঋতু বৈচিত্র ও হেমন্তের জয়গানে মুখরিত। হেমন্তে আবিষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ( ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯-২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ বা ৬ ফাল্গুন বা ১৩০৫- ৫ কার্তিক, ১৩৬১)। তিনি মিশে আছেন হেমন্তের আবহে মিলনে, বিরহে। অনুভূতির গভীরতম অনুধ্যানে জীবনানন্দের কবিতা আমাদের মানসলোকে ব্যাপ্তি ও সৌন্দর্যের আলোকে প্রসারিত করে প্রাণ সম্ভার। কবির ভাষায় হেমন্ত শস্যের ঋতু, হেমন্ত সহ্যের ঋতু, হেমন্ত পরিতৃপ্তির আশ্চর্য ঢেকুর।কবি জসীম উদ্দীন( (১ জানুয়ারি ১৯০৩ - ১৩ মার্চ ১৯৭৬ বা ১৮ পৌষ, ১২৯৬-২৯ ফাল্গুন, ১৩৬৯)গ্রাম ও প্রকৃতির কবি।প্রকৃতিতে গভীরভাবে নিমজ্জিত থাকেন ও প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে মিশেই তিনি তাঁর লেখার মুক্তো আহরণ করেছেণ। আর তাই তো তিনি  পল্লী কবি।তাঁর লেখায়ও হেমন্ত অবগুণ্ঠন খুলে দাঁড়িয়েছে রূপ ও সৌন্দর্যের পশরা নিয়ে। সুফিয়া কামাল(২০ জুন ১৯১১-২০ নভেম্বর ১৯৯৯ বা ৬ আষাঢ়, ১৩১৭-৫ অগ্রহায়ণ, ১৪০৬ ) এর ‘হেমন্ত’ শীর্ষক কবিতা আজও সকল পাঠককে হেমন্তের অবারিত শস্য ও সৌন্দর্যের প্রাণ প্রবাহে জাগিয়ে রঞ্জিত করে তোলে।
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া
সেই নাচনে উঠল মেতে।
টইটুম্বুর ঝিলের জলে
ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে
চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে
সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’
(কাজী নজরুল ইসলাম)
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শ‚ন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,
ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে ক্ষেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন ঝড় পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ন সোনালি।’
এবং
‘যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে।’
(জীবনানন্দ দাশ)
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
(জসীম উদ্দীন)
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
(সুফিয়া কামাল)

কার্তিক ও অগ্রহায়ণ’ এ দুই মাসকে আমরা হেমন্তকাল হিসেবে জানি। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকা তৈরির সময় ‘অগ্রহায়ণ’ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।‘অগ্র’ এবং ‘হায়ন’ এ দুই অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুুম’। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে পরিপক্ব হয় ধান। অগ্রহায়ণে ফসল ঘরে তোলা। বলা হয়ে থাকে, ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব ‘নবান্ন’। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের স‚চনা হয়। মাঠে মাঠে আমন ধানের শীষ নাড়া সোনালি কোলাহল ও নবান্নের গানে আর নতুন চালের গন্ধে সুরভিত হয়ে উঠে বাহির ও মনোজগৎ। পিঠা পায়েসের মৌতাতে সাড়া পড়ে আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত পরিজন। গাছিদের দা ও রসের হাড়ি চড়ে খেজুর গাছে আর রসের পায়েস ও ফিরনির উৎসব। রাত জেগে চিঁড়া কুটা উৎসব শুরু হয় হেমন্তের প্রহরে প্রহরে। মাঠ ভরে যায় সর্ষে ও মটরসুঁটির হলুদ-সবুজ হাসিতে তেমনি গ্রামের খেলার মাঠে, চষা ও নাড়ার ক্ষেতে বৌচি দাঁড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি ও গোল্লাছুটের কলকোলাহল।
শীতের স্থবিরতা দিয়ে শুরু বসন্তের গুঞ্জরন, গ্রীষ্মের ধাবদাহ ও বর্ষার রাগিণী, শরতের পাঠ শেষে হেমন্তের জয়গান । মুক্তির সোপানে বহমান জীবন। মিষ্টি বাতাস আর প্রকৃতির রঙ ও স্নিগ্ধ সুবাস ভুলিয়ে দেয় হারানোর বেদনা ও কষ্টের কঠিনতা । সুপারি ও বাঁশবনের ঝিঝিঁ পোকার ডাক ও জোনাকি সন্ধ্যার মগ্নতা নিয়ে আসে প্রকৃতির কাছাকাছি। নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আর আমরা ভাঙনের ডাক শুনি না। বরং জীবন গড়ার তাড়নায় হেমন্তকে সাথে নিয়ে শীতকে মোকাবিলা করার সংগ্রামে ব্রতী হয় সবুজ বদ্বীপের মানুষেরা। এভাবেই প্রকৃতির কাছে পায় সাম্যতার সংগ্রামে সংগ্রামী হবার অধিকার ও চর্চা। চৈত্রের রুক্ষতা, গ্রীষ্মের ধাবদাহ, বর্ষার তলিয়ে নেবার পর জাগরণের মুক্ত পদক্ষেপ হেমন্ত। বলা যেতে পারে নিজেকে উজাড় করার  ‍মূর্ত আবেগ হেমন্ত।

লাঠি খেলা, বাউল গান, নাগরদোলা, চুড়ি, ফিতা, নাকফুল ও খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়। গ্রামে গ্রামে নৌকা বেয়ে ঘুরে বেড়ায় বাইদানী। বাইদানীর শাঁক বাজতে থাকে গৃহাঙ্গন ও মেলার মাঠে। নতুন চুড়ি, গৃহ সরঞ্জাম ও সাপের নাচনের মুগ্ধময়তায় প্রাণ পেয়ে নেচে ওঠে গ্রাম্য জীবন।
হেমন্তের নাগর দোলায়
জীবন হাসে মনটা ভোলায়
ফুলপাখি আর বাতাস বিভোর
শিশির ভেজায় পা
হেমন্তের মাদকতায় থাকবো পড়ে
আজ ঘরকে যাবো না।
অথবা
নিবিড় হেমন্ত দিনে শিশিরের অমৃত লিখন-
আমরা সিক্ত হই, আদরে নিষিক্ত রই
প্রকৃতির মায়ায় জড়িয়ে থাকি প্রকৃতির ফুল
নিয়ত গানের সুরে মনকে মাতিয়ে তোলে
বনের আদরমাখা মৌটুসী, বুলবুল...