ছন্দের আলোয় মনের মুক্তি
খাতুনে জান্নাত
----------------------
আমরা বসত করছি এক নিরবধি ছন্দ আবিষ্ঠতায়। ছন্দ রয়েছে আমাদের চারপাশে।হাস্যময় ফুল, পাতার নিবিড়তা ও শিশুর কোলাহলে, প্রতিদিনের প্রেমরস ও আবেগের সিঞ্চিত ফল্গুধারায়। ছন্দ বহমান বাতাসের সিম্ফনী ও নদী-সাগরের কল্লোলে।পাখির কণ্ঠে যে সুর প্রকৃতি জাগিয়ে তোলে তার তাল, লয় ও ধ্বনি আমাদের মোহিত করে, প্রাণবন্ত করে; প্রাণকে জাগ্রত করতে অনুপ্রাণিত করে।শাহরিক বাস্তবতা ও দ্বন্দ্ব সংস্কারে ভগ্নছন্দ কে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ যে প্রচেষ্টা তাও মনে করিয়ে দেয় সহজাত মানব মন ছন্দ প্রেমী ও ছন্দে নিয়ত চলার প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত থাকার অভিলাষবাহী।
কবিতা প্রাকৃত জনের মুখের ও মনের বহুমাত্রিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হ’য়ে যুগে যুগে প্রাত্যহিক ও মনের গহনকে রঙিন করেছে। কবিতা সৃজিত আবেগের অবগুণ্ঠনে, সুপ্তি মগ্নতার নিগূঢ় উচ্চারণে। তা নিমজ্জিত থাকে, নিবেদিত থাকে ছন্দসুধারসে। তেমনি যে প্রাকৃত ধ্বনি যুগে যুগে আমাদের শিল্পস্বত্তাকে জাগ্রত করে রাখে তা নানাবিধ ছন্দ-সুর ও ব্যঞ্জনা লালিত্য হয়ে এসেছে। তারই গুণ টেনে নিয়ে এসেছে আমাদের পূর্বজ কবিগণ এবং আগামীর হাতে পৌঁছে দিচ্ছে বর্তমান কবিতা শ্রমিক। এর সাথে আরো জড়িত দায় বোধ ও প্রকৃতি কে ধারণ করার সহজাত মনোপলদ্ধি। আসলে প্রকৃতির অংশ আমরা অথবা প্রকৃতিই আমরা। এই আমাদের এক সত্তা বিশ্লিষ্ট হয়ে বহুসত্তার রূপে।এই রূপ ও প্রেম সাধনা ই আরাধ্য। প্রেমের রূপ তো ছন্দময়, হৃদয়িক ভাব, বিরহ ও গভীর হবে তা বলাই বাহুল্য।
বিচিত্র শব্দ বা সুর ও চিত্রের এক মহাসৌন্দর্যের সম্মিলন মানব জীবন।প্রেম, বিচ্ছেদ ও মিলনের এক গূঢ় সংযোজন ই মানুষের মন।মানুষ সুরের আবহে থাকতে চায় আর তা থেকে বিচ্যুত হয় বলেই জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে। কবিতা ও সংগীত সে সুরকে সমন্বিত করেছে বলেই মানুষ সংগীতকে, কবিতাকে নিজের আত্মার বা গভীর মনের সুর বলে মেনে নেয়।তা থেকে বিচ্যুত মানেই ভেঙে পড়া ভাঙা সাঁকোর মতো সকল সংযোগ বিচ্ছিন্নতা।
আর এ ছন্দময়তা ধরে রাখতে কবিতার ফুলকে সাজাতে তার দলমঞ্জুরিকে নির্দিষ্ট অবয়ব গড়ে গঠিত হতে হবে অথবা ফুলে ফুলে সাজিয়ে নিতে হবে মালা আর তা নিবেদিত হবে প্রেমার্থীর জন্য। কবিতার পাঠকই সে প্রেমী যে নিবেদন গ্রহণ করে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই তো সে মাল্য হতে হবে হৃদয় উজাড় করা নৈবেদ্য। পরিপূর্ণ রূপ রসে মাদকময়। তা গঠন করতে নিজেকে ভেঙে ভেঙে পূর্ণ হতে হয়। পুরনো অবয়ব ভেঙে প্রয়োজনে নতুন অবয়ব গড়ে তুলতে হয়। তাকে হতেই হবে ছন্দময়, আলোক ময়, গঠনমূলক। মানব জীবন বিশৃঙ্খলতা ও অস্থিরতায় নিমজ্জমান। প্রতিদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণা, মন্দা, মারী, প্রতারণা, বিশ্বাসহন্তার ছুরিতে কাটছে সময়। কিন্তু সহজাত ভাবে মানুষ প্রেমপুজারী।তার প্রাণ শুদ্ধতার পথে চলমান। সে প্রাণ কে জাগ্রত করাও কবিতার কাজ। আমাদের অন্তরের স্রোতকে বহমান করতে কবিতাকে ছন্দ নাওয়ের পাটাতনে চড়তে হবে। আগাতে হবে কূল ও গতির স্রোত ধরে। প্রবাহিত হবে দুই কিনারের সকল সৌন্দর্য অবলোকন ও অবগাহন করে।
অনেকেই বলে থাকেন অক্ষর, মাত্রা, ছন্দ ও আবেগ সাথে নিয়ে অনুভূতির অনুসঙ্গে গড়ে মেপে মেপে কবিতার পোশাক সাজানো হাস্যকর। কিন্তু আমার অনুভূতি অনুভূতি ই; তাকে ওসব নিয়মে বেঁধে ফেললে অনুভূতি উপলব্ধিতে যাই ধরা পড়বে ছন্দোবদ্ধ হয়েই ধরা পড়বে। যে কোন কাজের প্রস্তুতি থাকে। পরীক্ষা পাশ করতে হলে পাঠ্যপুস্তক পাঠ করতে হয়। চাকুরীর ইন্টারভিউতে আরও বিস্তৃত পঠনের প্রয়োজন পড়ে। সব কাজের মতো এখানে ও রয়েছে ব্যাপক কাজ ও জ্ঞান আহরণের বিশালতা অর্জনের মতো কাজ ও অনুধ্যান। কেউ কেউ প্রকৃতিগত ভাবে হয়তো জ্ঞানী থাকে। সেটা আভ্যন্তরীণ। এ আভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা র সাথে বহিঃ জগতের সম্মিলন কিন্তু সে অনুভূতি কে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। সুর- ছন্দ- প্রজ্ঞা-আবেগ এক হয়ে মিশে সৃষ্টির সৌন্দর্য ত্বরান্বিত করে আর তা গ্রহণ করলে অনুভূতি খণ্ডবিখণ্ড না হয়ে মঞ্জরিত হয় শুদ্ধ প্রাণোদ্যানে সঠিক বিটপের শাখায়।এতে অনুভূতির বিচ্যুতি না ঘটে সনির্বন্ধ লাভ করে। ‘“ছন্দ জেনে নিয়ে ছন্দ ভাঙো।” পূর্বজ কবিদের এসব বাণী হেলায় ফেলে দেয়ার মাঝে কোন কৃতিত্ব নাই। ভবিষ্যৎ তো নাই ই।
অক্ষর, মাত্রা, ছন্দ, অলঙ্কার, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প আবেগ বা অনুভূতির নির্যাস ও জ্ঞানের দ্যুতি একসাথে মিলে মিশে হয় কবিতা।তা দিয়েই গঠিত কবিতা যদি আমাদের মুগ্ধ করে, আলোকিত করে, খুলে দেয় মনের দুয়ার তবে আমরা কেন ভেঙে দিতে চাই ঐতিহ্য ও সংযুক্তির সকল আবীর? তা থেকে কি মিলছে আমাদের? উপন্যাস বা গল্প সাহিত্যের পথ ও পাঠক যত বিস্তৃত হচ্ছে কবিতা সাহিত্যের জগৎ ও পাঠক তত কমে যাচ্ছে; মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে কবিতার বলয় থেকে।ছন্দোবদ্ধ কবিতা মানে অনেকে অন্তমিলযুক্ত কবিতাই বোঝেন। তাই বলে থাকেন এসব কবিতা আজকাল কেউ পড়ে না। এটা একটা ভুল ধারণা। অন্তমিল না দিয়েও বহ উত্তীর্ণ কবিতা বাংলা কবিতা সাহিত্যে রয়েছে। একে তো কবিতার পাঠকের চেয়ে কবির সংখ্যাই বেশি।শুধু বেড়ে উঠছে সংগঠন, কবিতার বাণিজ্য বাড়ছে ঠিক নয় কবি নামধারী মানসিকভাবে দুর্বলতর কবিদের মূলধন করে ফায়দা লুটছে সংগঠনকারী। শত শত পুরস্কার বিতরণ হচ্ছে রিলিফ বিতরণের মতো। ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আর শোকেসে রেখেই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে কবি। কবিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কবি। পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক বা তার বন্ধু বা পত্রিকার সাথে জড়িতরাই বড় কবি।টেলিভিশনেও একই চিত্র বন্ধুত্বের মান বড় মেধার নয়। নীরবে কাঁদছে কবিতা। মননের বা মেধার চর্চা নাই কোথাও। মান বাড়ছে না লেখার বা কবিতার। কেননা কবিতা ভাবনা বা মনের গহনের খোঁজ কেউ করছে না। অন্যদিকে গুটিকয় আবৃত্তি শিল্পীর দ্বারা পরিচালিত কবিতা ই কবিতা হয়ে থাকছে। এখানে ও কথা ‘কবিতার পাঠক কখনো সাধারণ্যে ছিলো না ’।
কিন্তু একথা ও তো সত্যি যে একসময় মানুষ মুগ্ধ ছিল কবিতায়। প্রেমাস্পদকে একটা কবিতার বই দিয়ে সুখী হত প্রেমিক বা প্রেমিকা এখন কেউ আর এমনটি ভাবেন বলে দেখা যায় না। প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে যে সব কথা ,‘‘কবিরাই কবিতার পাঠক” অথবা “সবাই শোনাতে চায় কেউ শুনতে চায় না।” অথবা ‘‘কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি।’’ এসব প্রচলিত কথা কবিতার জন্য হানিকর। কবির জন্য তো বটেই। তার উপর মানুষ দায়বদ্ধ সময়ের কাছে। এ সময়ই হয়ে পড়বে একদিন ইতিহাস। তাই যেন আগামীর হাতে এক সমৃদ্ধতর ইতিহাস পৌঁছে দেয়া যায় তাই হোক আমাদের আরাধ্য-অন্বিষ্ট। মানুষ যে কথা বলতে চায় বলতে পারে না যে কথা শুনতে চায় কবিতায় সে কথার অনুরণন শুনতে পেয়ে কেঁপে ওঠে আর তা শুনতে না পেয়ে সরে যায় এ জগৎ থেকে। কেননা মানুষের ভেতরে বাস করে এক অবোধ মানুষ। আর কবিতাকে লালন করতে হবে সে অবোধ মানুষের অন্তরের প্রতিচ্ছবি, কবিতাকে জাগ্রত করতে হবে সে অবোধ মানুষটিকে...