আর্তুর র্যাঁবো: এক মহাদ্রষ্টা কবির কাব্যদর্শন ও কবিতা
খাতুনে জান্নাত
প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্ব শিল্প-শৈলী সমৃদ্ধ আলাদা মনন, বোধ ও ভাষা। কবি নিজস্ব মতামত, রূপ ও বৈচিত্র্যের মাধুর্য্য দিয়ে ভাষার ফুল ফোটান। তার-জন্য তাকে হতে হয় বিশ্বস্ত ও ধ্যানী। ধ্যানের আলোকরশ্মি দিয়ে তিনি আঁধার, কাঁটা ও পাথর কেটে কেটে পথ করে নেন। তাতেই ঝর্ণার কলকল ছন্দে, ফুলের বিন্যাস ও জীবনের আতর সাথে নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। বুনন করেন শব্দ, ধ্বনি, প্রতীক, রূপক, অলঙ্কারের রূপ-মঞ্জরী। তিনি জাগতিক প্রলোভন ও প্ররোচনার ঊর্ধ্বে নিয়ত অবস্থান করেন। আকরিক সেচে যেমন নিষ্কাশন করতে হয় ধাতুর অবয়ব; কবি নিজেকে নিষ্কাশন করে বের করে আনেন বাক্যের নিপুণ কৌশলে রূপক, ছন্দ ও অলঙ্কারের সংমিশ্রণে কবিতার দ্যুতি। সমাজ ও প্রচলিত জীবনের তলায় প্রবেশ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রক্ষেপণ করেন। নিবিষ্ট থাকেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রস-আহরণে। নিজস্ব সীমারেখা ছাড়িয়ে তাঁকে হতে হয় বৈশ্বিক অভিনিবেশে আবিষ্ট। তিনি ভালোবাসেন মানুষ। মানুষের জৈবনীক রঙ্গমঞ্চ হতে ধ্বনিত হয় জীবনের কথোপকথন। সহজ জাগতিক হাস্য-রসাত্মকতার ভেতরেও কবির হৃদয়ে ধ্বনিত হতে থাকে জীবনের ক্রন্দন। মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে বঞ্চনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। মানবতার দলন ও স্খলনে ব্যথিত, মর্মাহত হন। তাঁর হৃদয়ে কখনো কখনো রক্তক্ষরণও হয়। তাই তো নিজেকে নিবিষ্ট করেন সৃষ্টির অতলান্তিক স্রোত ও আবেগ ধারার অনুভবে; থাকেন অন্তলীন আত্মভুবনে।
ফরাসী তথা বিশ্ব কাব্য জগতের এক মহান স্রষ্টা র্যাঁবো (রেঁবো) যিনি বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন শিল্পের আশ্চর্য যাদুতে। শৈশব ও কৈশোরের আলোকোজ্জ্বল সময়ে তিনি দেখে নিয়েছেন আলোর গভীরে জমে থাকা অগ্নি ও অন্ধকারের জ্বালামুখ। মননের গভীর সূক্ষ্ন দৃষ্টি ও বুননের জঙ্গমতায় শাণিত কাব্যের দ্যুতিতে মুগ্ধ করেছেন সাহিত্যের বিদগ্ধ-জনকে। জীবন ও সাহিত্য কত গভীর অন্তঃদৃষ্টি দ্বারা প্রবাহিত হয়; আর এই অন্তঃদৃষ্টি গভীর পাঠের মাধ্যমে ,মনের গঠন দৃঢ় করে সৃষ্টি করে চলে কাব্যের ভিত ও পাটাতন। মাত্র কটি গ্রন্থেই তৈরি করেছেন শব্দের কুহকজাল। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছে একটি শিশুর হাতে শিশু সাহিত্য নয় ফুটে উঠেছে প্রজ্ঞাবানদের জন্য প্রকৃষ্ট নিদর্শন। তাই তো আর্তুর রেঁবো এক বিস্ময়কর নাম যা শ্রদ্ধা ও সমীহের সাথে উচ্চারিত ও পঠিত হয় সাহিত্যের পাঠশালায়।
জাঁ নিকোলা আর্তুর রেঁবো (ফরাসি: Jean-Nicholas Arthur Rimbaud ফরাসি উচ্চারণ: aʁtyʁ ʁɛ̃bo) জন্ম ২০ অক্টোবর ১৮৫৪—মৃত্যু ১০ নভেম্বর ১৮৯১ একজন ফরাসি প্রতীকবাদী কবি। যাঁকে সাহিত্য বা কাব্য জগতের উল্কা বলা হয়। উল্কার মতোই তাঁর আগমন ও প্রস্থান। তিনি ফ্রান্সের শার্লভিল-মেজিয়ের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেলজিয়ামের গা ঘেঁসে একটি ছোট শহর। তাঁর অধিকাংশ কবিতা লিখেছিলেন কিশোর বয়সে। তিনি জানতেন জার্মান, ইতালি, আরবি, ফার্সি ও আফ্রিকার একাধিক ভাষা।
তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অনন্য ঘটনা থেকে শুরু হয় কবিতাকাল। রেঁবো তখন মাত্র তেরো বছরের এক দুরন্ত কিশোর। ছোট্ট ও প্রান্তিক শহর শার্লভিতে ফ্রান্সের যুবরাজের আগমন উপলক্ষে তাঁকে অভিনন্দন জানালো রেঁবো লাতিন ভাষায় রচিত ষাট লাইনের এক কবিতায়। এই কবিতার মাধ্যমে অনেকের সাথে পরিচিত হলো— যুবরাজের সাথে নন্দিত হলো এক প্রতিশ্রুতিবান কিশোর কবি হিসেবে। এবার রেঁবোর সামনে উন্মোচিত হলো আর এক নতুন জগৎ। আরো তিনটি কবিতা লিখে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম পুরস্কার পান । ১৮৭০ সালে La Revue Pour Tous পত্রিকায় তাঁর ১৫ বছর বয়সে প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটির রচনাকালে ১৮৬৯ সাল এবং এর শিরোনাম Les Etrennes des orphelins.। ইংরেজিতে দক্ষ ছিলেন— জানতেন জার্মান,ইতালীয়ান, আরবী ও আফ্রিকানসহ একাধিক ভাষা—
কাব্যদর্শন:
ফরাসী প্রতীকবাদী কবি ‘ল্যা ফ্ল্যার দ্যুমাল(ক্লেদাক্ত কুসুম) খ্যাত শার্ল বোদলেয়ার তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এই অনুপ্রেরণা তাঁকে কবিতার প্রতীকী স্টাইল তৈরি করতে সহায়তা করেছে। সহায়তা করেছে প্রজ্ঞার গভীরতম স্তরে প্রবেশ করতে।
১৮৭১ সালের মে মাসে, প্যারিসে আসার আগে রেঁবো তাঁর কাব্যিক দর্শনের ব্যাখ্যা দিয়ে দুটি চিঠি লিখেছিলেন প্রথম চিঠিটি ইজামবার্ডকে এবং দ্বিতীয় চিঠিটি পল ডেমেনিকে— যাকে সাধারণত লেট্রেস ডু ভায়ান্ট ("দ্য দর্শনের পত্র") বলা হয়। ১৩ মে লিখিত প্রথম চিঠিটিতে, রিমবাড বা রেঁবো ব্যাখ্যা করেছিলেন:
আমি এখন নিজেকে নিজের মতো করে ফেলছি; সমাজ বিচ্ছিন্ন কেন? আমি কবি হতে চাই, এবং নিজেকে দর্শকে রূপান্তরিত করতে কাজ করছি। আপনি এগুলির কোনও কিছুই বুঝতে পারবেন না এবং আমি আপনাকে এটি ব্যাখ্যা করতে প্রায় অক্ষম। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিকৃতি দ্বারা ধারণাটি অজানাতে পৌঁছানো। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর দুর্ভোগ, তবে একজনকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে এবং জন্মগত কবি হতে হবে। এটি আসলে আমার দোষ নয়”...
পরবর্তী চিঠিতে - ১৫ ই মে তাঁর বন্ধু পল ডেমেনিকে কবিতা ও জীবন সম্পর্কে তাঁর বিপ্লবী তত্ত্বগুলি ব্যাখ্যা করেছেন এবং তার আগে বেশিরভাগ কবিদের নিন্দাও করেছিলেন। নতুন কাব্যিক রূপ ও ধারণার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি লিখেছেন:
“আমি বলি যে, দ্রষ্টা হতে হবে, নিজেকে দ্রষ্টা বানাবেন— কবি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের উৎকৃষ্ট এবং যৌক্তিক বিকৃতি দ্বারা নিজেকে দ্রষ্টা করে তুলবেন। —ভালবাসার প্রতিটি রূপ, যন্ত্রণার, উন্মাদনার; তিনি নিজেকে সন্ধান করেন— তিনি তাঁর মধ্যে সমস্ত বিষ গ্রাস করেন এবং কেবল তাদের তল্লাশি রাখেন— এটি একটি অনির্বচনীয় অত্যাচার, যার জন্য তার সমস্ত বিশ্বাস এবং অতিমানবীয় শক্তি প্রয়োজন, সেই সময়ে তিনি মহান ধৈর্যশীল, মহান অপরাধী, মহান অভিশপ্ত এবং মহান জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে যান! — কেননা তিনি অজানাতে পৌঁছান ! কারণ তিনি নিজের আত্মা চাষ করেছেন যা সমৃদ্ধ ছিল অন্য-কোনও মানুষের চেয়ে বেশি! তিনি অজানায় পৌঁছেন; এমনকি যদিও ট্রেজিক, তার দর্শনের বোঝাপড়াটি হারিয়ে শেষ করেন, কমপক্ষে তিনি যেগুলি দেখেছেন! সে সেই অপ্রয়োজনীয়, অজ্ঞাতনামা জিনিসগুলির মধ্য দিয়ে মরুক: অন্য দক্ষ লোক আসবেন; তিনি যে দিগন্তের কাছ থেকে আত্মহত্যা করেছেন সেখান থেকে তাদের শুরু হবে...”
.
রেঁবোর কাব্যদর্শনের মূল কথাই ছিল স্বেচ্ছাধীন— স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে অসীম, অনন্ত ও অচেনা এক জগতের সন্ধান। এ' জগতের সন্ধান শুধুমাত্র পঞ্চেন্দ্রিয়য় আবদ্ধ অনুভূতির দ্বারা পাওয়া সম্ভব নয়— এই কারণেই বোধহয় তিনি কাব্যে আরও অধিক প্রতীক ব্যবহারের দিকে ঝোঁকেন— বিশ শতকে এসে পাবলো পিকাসো এবং জিম মরিসনের মত অনেকেরই গুরুতে পরিণত হন। এই প্রতিভাবান লেখকের হুট করে আবির্ভাব এবং আকষ্মিক চলে যাওয়া— এখনও অনেকের কাছে বিস্ময়ের বিষয়। আলবেয়ার কামুর মতে— ‘কবিদের মধ্যে রেঁবো সেরা এবং বৃত্ত ভাঙার এক বিদ্রোহী কবি।’ আদ্রে ব্রেতোঁস বলেছেন, —‘রেঁবো কবিতার এক কিশোর দেবতা’ আর রেঁনের ধারণায়- রেঁবো কুমারী সভ্যতার প্রথম কবি'। রেবো বিশ্বাস করতেন কবিতা শুধু পাঠের বিষয় নয়; যদি ঈন্দ্রিয় ও মনন জাগ্রত না হয় আর সৃষ্টি না হয় উন্মত্ততা তবে তার কবিতা না পড়াই ভাল।
.......................
মাতাল তরণী (ল্য বাতো ইভ্র্) বা The Drunken Boat গ্রন্থ থেকে
...................................................
সংবেদন
..
নীল গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আমি নীচে নেমে যাব,
ভুট্টার ছায়ায় আক্রান্ত অল্প ঘাস পিষে:
স্বপ্নে আমি আমার পায়ে প্রশান্তি অনুভব করব।
আমার চুলহীন মাথা বাতাসে স্নান করবে।
আমি কথা বলব না, কিছু ভাববও না:
কিন্তু অবিরাম ভালবাসা আমার আত্মায় প্রবেশ করবে;
এবং আমি জিপসি হয়ে অনেক দূরে ভ্রমণ করব—
মনে হবে গ্রামে উচ্ছল কোনো নারীর সাথে রয়েছি...
(মাতাল তরণী)
(অনুবাদ:খাতুনে জান্নাত)
ইলিউমিনেশনস বা ইলুমিনাসিওঁ বা Illuminations গ্রন্থ থেকে
ভোর
........................
জড়িয়ে ধরি গ্রীষ্ম-ভোর । প্রাসাদগুলো এখনও সাড়াশব্দহীন। মৃত জল। ছায়ারা এখনও অরণ্যে ক্যাম্প করে আছে। হাঁটছি, উষ্ণ নিঃশ্বাস নিচ্ছি ঝকঝকে রত্ন— শব্দহীন ডানার উড্ডয়ন; প্রথম জন একটি সতেজ ফানসে মেয়ে-ফুল— যে তার নাম বলছিল। পাইন বনে হালকা রঙের জন্তু দেখে হাসলাম। রুপালি শিখরে চেনা গেল দেবীকে— একে একে তার আবরণ উম্মোচন করি । গলিতে হাত নাড়লাম। সমতলে দেখি মোরগ; নগর গম্বুজ ও গির্জার ভিড়ে হারালো। মার্বেলের জেটিতে দৌড়াল ভিক্ষুকসম — আমিও পিছু পিছু গেলাম। লরেল বনের পাশ-পথে তাকে আচ্ছাদিত করি । তার অপরিমেয় শরীর টের পাই । ভোর ও শিশু বনের কিনারে পড়ে থাকে। জেগে উঠি এবং দেখি দুপুর... (‘ইলিউমিনেশনস)
(অনুবাদ:খাতুনে জান্নাত)
..
‘নরকে এক ঋতু’ বা উন সেজোঁ অন অঁফে বা A season in hail .
বজ্র
মানব শ্রম! বিস্ফোরণ সময়ে সময়ে আমার অতলকে আলোকিত করে।
"জ্ঞানের দিকে কিছুই নিরর্থক নয়!" আধুনিক উপদেশককে বিশ্লেষণ করে সকলে। তবুও দুষ্ট ও অলস দেহগুলি সবার হৃদয়ে ... আহ! দ্রুত, দ্রুত, দ্রুত; রাত্রির বাইরে ... ভবিষ্যতের পুরষ্কার, সেই চিরন্তন পুরষ্কার ... আমরা কি তা থেকে বাঁচব?
- আমি আর কি করতে পারি? আমি জানি শ্রম এবং বিজ্ঞান খুব ধীর। প্রার্থনা দ্রুতগতির এবং কিছুটা শব্দবহুল ... আমি এটি সম্পর্কে ভাল জানি। এটি খুব সহজ এবং আবহাওয়া খুব উত্তপ্ত; আপনি আমাকে ছাড়া সব করতে পারেন। আমার দায়িত্ব আছে; তবে আমি অন্যদের মতো গর্বিত হব, একপাশে রেখে।
আমার জীবন জীর্ণ। আচ্ছা, ভান করা যাক, কিছু না! ওহ,! আমরা অস্তিত্ববহুল হয়ে উঠব, এবং নিজেদেরকে আনন্দিত করব, রাক্ষসী প্রেম এবং চমৎকার জগতের স্বপ্ন দেখে; বিশ্বের উপস্থিতির সাথে অভিযোগ ও ঝগড়া করে-- মল্লযুদ্ধ , ভিক্ষুক, শিল্পী, দস্যু, - পুরোহিত! আমার হাসপাতালের বিছানায়, ধূপের গন্ধটি আমার কাছে খুব গাঢ়ভাবে ফিরে আসে ; পবিত্র সুগন্ধযুক্ত, বিশ্বাসঘাতক, শহীদের অভিভাবক রূপে ...
সেখানে আমি আমার নোংরা শৈশবের পড়াশোনা স্বীকার করি। তাহলে কী! ... বিশে ফিরুন: আমি আমার বিশ বছরে, যদি প্রত্যেকে করে ...
না! না! এখন আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ! শ্রম খুব সহজ বলে মনে হচ্ছে; আমি গর্বিত। আমাকে পৃথিবীর কাছে ত্যাগ করাও খুব সামান্য শাস্তি হয়ে যাবে। শেষ-মুহুর্তে আমি আক্রমণ করতাম, ডানদিকে, বাম দিকে ...
- উহু! - দরিদ্র প্রিয় আত্মা, চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে না!
..........................................................................................