আমার হৃদয়ে গাঁথা গ্রাম

খাতুনে জান্নাত

  বুকের ভেতর, চলমান রক্তের ভেতর কোথায় যেন স্থির একটি বিন্দু। ‘কপালে টিপের মতো ঝলঝলে দীপ্যমান।’ সেটি আমার গ্রাম। আমার সমগ্র অস্থিত্বের অংশিদার। এ গ্রামের সৌন্দর্য, এ গ্রামের ঐশ্বর্য আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছে শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কর্মকুশলতার উন্নয়নে। কথা হল, কি আছে এ গ্রামে যা নতুন, যা বাংলাদেশের অন্যত্র নেই এ অপরূপ গ্রামের আবহ! কেন এ গ্রামটি আমার সুদূর পরবাসের দৈনন্দিনতায় এতটা ব্যাপ্ত হয়ে আছে। কেন কবিতার চরণে, গল্পের আবডালে, রচনার খাতায় গ্রামটি উঠে আসে স্বমহিমায়। আমাকেে উদ্দীপ্ত করে সবুজের দিকে। যন্ত্রণার গভীর ক্ষতে স্বান্তনার মোলায়েম হাত রাখে। সে কথা হয়তো আমার জানা হবে না কোনদিন। কেননা ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে রাখে আর শৈশব-কৈশোরের মোহ আজীবন তাড়িয়ে বেড়ায় মায়ের মমতার মতো। তাই তো লিখি:

আমার হৃদয়ে গাঁথা গ্রাম
সুর-পাখি বাঁধা প্রাণ
মগজে বিনুনি করে কাস্তে, নিড়ানি আগাছার
নাজুক-নতুন চারায় দিতে জল
সাঁঝজ্বলা চেরাগ আলোর
তোমার পায়ের কাছে টেবিল-বিছানা
প্রশ্ন-উত্তরে আঁকা ইংরেজি আসর। (দীর্ঘশ্বাস)

  গ্রামের নাম গোপীনাথপুর। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। নদীবিধৌত পলিমাটির গ্রাম। সাগর অঞ্চল হলেও সাগর বেশ দূরে। গ্রামের আয়তনিক হিসাব নেই আমার কাছে। তবে  চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলে আমি ঠিক-ঠিক পৌঁছে যাবো গ্রামসীমার এমাথা থেকে ওমাথা। গ্রামের তাল, খেজুর গাছে ঝুলন্ত বাবুইয়ের বাসা ও কলরব, তেতুল, করই, সজনের ডালে-ডালে দোয়েল, পাপিয়া, হলদে বৌ, শালিক,চড়ুই ও টিয়ার সন্মিলিত স্বর; থানকুনি, পুদিনা, হেলেঞ্চা, মলিচা, আসামি লতা, কলমি লতা, বাসক পাতা, আঙ্গিলা ফুল, বাটুই ফুলের গন্ধ শুঁকে-শুঁকে বলে দেবো এটি আমার গ্রাম। কবিতায় বলেছি এভাবে:
স্মৃতি-সরোবরে সাঁতরে বেড়ায়
শিশিরের ওমেভেজা রোদদের ঘ্রাণ।
...
কৃষ্ণচূড়া, সোনাইলের আগুনজ্বলা দ্যুতি
পথের দু`পাশে দুলে দুলে ফুলে ওঠা
বাইট ফুলের মদির-মুগ্ধতা
সোহাগে ভরে তুলে হৃদয়ের জীর্ণ ভূবন।
(স্মৃতির ওম)

অথবা
  
লক্ষীপুরের তেমুনি থেকে সোজা উত্তরের পথে
মাইল তিনেক পার হলে--
শৈশবের গন্ধ ছড়ানো আমার গ্রাম--
চুপচাপ শুয়ে থাকে বন-দুবলা আর বাটুই ফুলের প্রশান্তিতে।
প্রবল বৃষ্টিতে পলিমাটি ধুয়ে দিলে
ডোবা-পুকুর ভরা ব্যাঙের তারস্বরের সাথে
শিশু-কিশোরের হেঁড়েগলা ছেড়ে
রোদ-বৃষ্টি আর খেকশিয়ালির বিয়ের কাব্য...  
ইচ্ছের পালের হাওয়ায় তালের নাওয়ে কোরাল খাল
শাপলা-শালুক ডুবু-ডুবু নাও আর লগির বিদ্যুৎ।
গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, চিকুৎকুৎ বিকেল।
নারিকেল, সুপারি, তাল ও তেতুই বনের ঘনশ্বাসে
মাঠভরা সোনালি ধানের শিষ-নাড়া দেখতে-দেখতে ঘরে ফেরা।
মুরুব্বিজনের দর-কষাকষি শেষে বাজারের থলি
সন্ধ্যার উঠোনে উনুনের ঝাপ খোলে তরকারীর ঘ্রাণ।
প্রকৃতি রাতের রাগিণী শুনিয়ে ঘুম পাড়ালে
লক্ষীপেঁচার ডাকের সাথে বন্দুকের আওয়াজও শোনা যায় আজকাল। (গোপীনাথপুর)

এ গ্রামের পুকুর-ডোবা, নালা, কুপ মাছের আড়ত। শীত মৌসুমে বড় পুকুরের পানি সেঁচে মাছ ধরা হয়। অনেক কুপ ও পুকুর এমনিতেই শুকিয়ে যায়। কম পানির পুকুর জাল দিয়ে বা কাদামাখা পুকুরে হাতিয়ে মাছ ধরা হয়। কার খলুইয়ে কতবেশি মাছ। মানুষের ভিড়ে শরিক হয় মাছরাঙা, বক, চিল, কুরুয়াল আরও অনেক শিকারি পাখি ও হল্লা। সেদিন বিকালের নাস্তা মাছ। শিশুদের হাতে-হাতে মাছ। সবাই আনন্দে খেতে থাকে মাছ। বর্ষা মৌসুমে উজান মাছ ধরার ধুম। স্রোতের পানি যেখানে বেশি খর হয় সেখানেই মাছ ভূমিতে উঠে আসে। কৈ,শিং,মাগুর, পুঁটি, শোল, গজার আরো কত জাতের। চাঁই টেডা,বাঁশের আন্তা কখনো মশারি( পোনা) দিয়েও মাছ ধরা হয়। রাতের বেলা দোনালী জ্বালিয়ে পুকুরের পাড়ে ক্ষেতের আলে-আলে মাছ ধরা চলে। আর রয়েছে ছোট বড়শি, চরক বরশি। বারোমাসই মাছ ধরার প্রতিযোগিতা ও আনন্দ। বেশি প্লাবিত হলে বাড়ির উঠানে পানি আর পানি। ঘরগুলো ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। তখন জোয়ারের ভয়ের চেয়ে নৌকা পারাপারের আনন্দই বেশি হয়। তবে এ সময়টা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না।  
   কোনো-কোনো পুকুর নিয়ে পুরনো জানা গল্প বা প্রত্যক্ষদর্শীর সত্যি ঘটনা রয়েছে। যেমন সেসব পুকুরে গোসল করতে গেলে এক ধরনের শিকল এসে জড়িয়ে ধরে পা অথবা বৃষ্টির দিনে কারো উজায়ার মাছ ধরতে এসে পাশাপাশি বসে থাকা টাকার কলসি দেখার কথাও শোনা যায়। ভয় পেয়ে মানুষ অনেকদিন সেসব পুকুর ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। এমনকি পানি সেঁচতেও ভয় পায়। কেউ-কেউ উদ্যোগ নিলে কারা নাকি স্বপ্নে ভয় দেখায়। তাই আমাদের চামার পুকুর প্রায় দেড়শত বছর পর প্রথম সেঁচ দেয়া হয়। তার কাদা প্রায় পুকুর পাড়ের কাছাকাছি। আর তাতে ভরা ছিল গাঁজিলা আর মাছ। পানি সেঁচে চলে উদ্দাম জীবন যাপন। অবশ্য শিকল বা টাকার পাতিলের সন্ধান আর মেলেনি। বর্ষার দিনে মুত্রা-বেতে নকশি পাটি ও পাখা বানানোর ধুম। নিজের কাজ ছাড়াও বিক্রির মাধ্যমে আয়ের একটা পথ করে নেয় গ্রামের মেয়েরা।শীতের দিনে বাড়ির উঠোনে কাঁথা ও নকশি কাঁথা সেলাই ।

    বর্ষা মৌসুমে ফসলের মধ্যে ধান আর পাট। ছপাৎ করে হেঁটে-হেঁটে যে যার জমিটি খোঁজ করে। যাঁরা দিনমজুর তাঁরা জমি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে সারাদিন বা দিনের পর দিন।কাজ শেষে অনেকেই ভোগে নানা পানিবাহিত রোগে। শৈল্য চিকিত্সা করে অনেকেই কঠিন ক্ষত বা রোগে ভোগে আজীবন। পাঠক্ষেতে বড়দের চোখ এড়িয়ে শিশুরা লুকোচুরি খেলে। আর দলবেঁধে খোঁজে হাঁসের খাদ্য শামুক।বেচারা শামুক সন্তরণের আনন্দ করতে এসে ধরা পড়ে। শিশুরা আরো খোঁজে মানুষের খাদ্য শাপলা-শালুক।  এরই মধ্যে বৃষ্টি এলে সমস্বরে গান ধরে-

জড়ি আইয়েরে তুরুল্যা
হাঁতরে ক্ষেতে বদিল্যা
ইঁচাগুঁড়ার সসিন্দা
হায়রে আমার বদিল্যা।`  

আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, এন্না, ঢেউয়া, তাল, পেয়ারা, আতা, মন্ডল, জাম্বুরা, কাগজি লেবু, জামরুল, বরই, হেলা, গজবই(ডুমুর) বিচিত্র সব ফলের সমারোহে মৌ-মৌ গ্রাম। আম ও তালের দিনে বাড়ির উঠোনে, খাটের নিচে, মাচায় আম আর তাল। উঠানে পাটি বিছিয়ে চলে আমসি(আমসত্ব) তৈরির এক মনোমুগ্ধকর খয়েরি-হলুদ দৃশ্য। বড়দের সাথে শিশুদের আনন্দও কম নয়। নারিকেল ফলে বারোমাস। পুড়িয়ে খাও, পিঠা, সন্দেশ, ফিরনি, পোলাও। নারিকেলের ব্যঞ্জন পাকা রাঁধুনীর হাতে পড়লে মনে লেগে থাকবে অনেক কাল।

কাঁঠালিচাপা, রজনীগন্ধা, হাস্নাহেনা ঘ্রাণ গ্রামের কোমলতার কথা মনে করিয়ে দেয় আগন্তুকের মনে। টগর, শেফালি, জবা ফুলগুলো পুকুরপাড়ে, কবরস্থানে নীরব প্রশান্তিতে জ্বলতে থাকে। নয়নতারা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, বেলি, রেণু আর একুশে ফেব্রুয়ারীর সময় গ্রাম আলো করে থাকা গাঁদা চলে যায় প্রভাত ফেরিতে ভাষা শহীদের বেদীমূলে। মাইল মাইল পথ পাড়ি দিয়ে হেঁটে প্রভাত ফেরির বেদিতে ফুল দেয় স্কুলের ছেলে,মেয়ে  ও শিক্ষকগণ।

তারপর মাঠ ভরা ফসলের কথা। হেমন্তের ধানকাটা হয়ে গেলে নাড়ার ক্ষেতে বেড়ে ওঠা খেসারি ডাল। মোলায়েম ,পুঞ্জিভূত খেসারির ছোট-ছোট নীল ফুল দেখলে  ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে আদর বুলিয়ে  দি তার নরম গায়ে। কোনো-কোনো ক্ষেতে মরিচ লাল আর সবুজ, সবুজ আর লাল। প্রতিদিন লাল মরিচগুলো  বোঁটা ছিঁড়ে তুলে ফেলা। এ লাল-সবুজের খেলা চলে অনেকদিন। আরো ফলে মুগ, মসুর,কলা্ই  , মঁটরশুঁটি, কাউন,গম অল্পকিছু জমিতে আমন ধান।  এ সময় গবাধি পশুরা মাঠে চরে, যদিও পূর্ণ বয়সীরা দড়িতে বাঁধা থাকে ফসলহীন জমিতে। গরুর বাছুর ও ছাগল ছানার মাথা বঁকিয়ে নৃত্য করতে দেখা  যায়।

গ্রামটিতে ধর্মীয় আভিজাত্য আছে তবে উন্মদনা না্ই। বিশ্বজুড়ে কোন্দল, হত্যা হয়েছে যা হয়নি আমাদের গাঁয়ে। এখানে মিলেমিশে আছে বাগানের বৃক্ষের মতো, একই  পরিবারের মতো পরস্পরের আনন্দে-বিরহে, হাসি ও বেদনায়। কতদিন রাত জেগে-জেগে দূর্গাপূজার নাচ-গান ও যাত্রা দেখেছি। স্কুলের মাঠে প্রজেক্টরে গণশিক্ষার ও পরিবার পরিকল্পনার প্রোগ্রাম। দেখেছি গ্রামের ও শহরের ছেলেমেয়ের অভিনীত মঞ্চনাটক। স্কুলের বার্ষিক প্রোগ্রাম ও বিভিন্ন ক্লাবের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত।

তবে ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতো যে বিশ্বাসটি অনেক মানুষ আঁকড়ে ধরে আছে সেটি জ্বিন-ভূত বিশ্বাস। এখনো ঝাড়ফুক তাবিজ-কবজ ছদকা বলা দূর--অনেক মানুষের জীবন পরিচালনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। প্রায় দেখা যায় এ-বাড়ি ও-বাড়ি জ্বিন-ভূতের নজর এবং চিকি’সা। দলবেঁধে মানুষ ছোটে পানিপড়া, তাবিজ সংগ্রহের জন্য। যে মেয়েটি কালও ভাল ছিল আজ তার উপর জ্বিনের আছর(ধরা)। তার ব্যবহার চালচলন সবকিছু্ই অন্যরকম। অশিক্ষিত মেয়েটির কোরান ভরে ওঠে আরবী লেখা তাবিজে (কাগজ পাতায়)। তার টুকরি ভরে ওঠে বনবাদাড়ের লতা-পাতায়-যা এ এলাকায় না্ই। জ্বিনের চিকি্ত্সা ওঝা, গণকেরা করে। প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ও ডাক্তার, রয়েছে , সহশিক্ষার পরিবেশ রয়েছে তবে গ্রামের কাছে ধারে এখনো নাই  কোন কলেজ। আর কলেজ নাই  বলে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয়ে নয়তো কোনদিনই  হয়তো বা গ্রামের সীমানা ছেড়ে , দেশের সীমানা ছেড়ে আসতে হত না আমাকে! এখন গ্রামে বেড়েছে বোরকা; বোরকা ছাড়া কোন নারী দেখা যায় না প্রায়। নারী মহিলা-মাদ্রাসার সুবাধে ক্লাশ সিক্স থেকে অনেক মেয়েরা বোরকা পরে। অবশ্য এটা এখনো মাদ্রাসা নির্ভর।
ঈদ, মেলা, পূজা-পার্বণ আনন্দ আর আনন্দের মেলায় ছড়িয়ে থাকা গ্রাম। মা-বাবা-ভা্ইবোনের আদর-শাসন, মান-অভিমানের এক মূর্ত আবহ ছিল যা কোনদিন ফিরে আসবে না আর আমার জীবনে। তবু মন ঘুরে-ঘুরে চায় বার-বার শুনতে সেসব কথা, বার-বার ফিরে-ফিরে দেখতে সেসব দিন; সেসব হিরক সময়। হয়তো আবারও কোনদিন কচুবনের শীতলতায় তালের নৌকা বেয়ে যেতে-যেতে জানতে চা্ইবো--আমায় মনে আছে তো!
গ্রামের চারধারে এখন পাকা রাস্তা। ভোঁ-ভোঁ করে চলছে শহরমুখী গাড়ি ও নীরবতা ভঙ্গকারি ভেঁপু। ভেতরে অনেক টিনের ঘর, পাতার ঘর ভেঙে-ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ইটের দালান। কুপি-হারিকেনের বদলে অধিক ঘরই ঝলমল করছে বৈদ্যুতিক বাতি, চলছে রঙিন টেলিভিশন। তবে এখনো স্নেহময়, আগ্রহী ও সরল মাধুর্যে পরিপূর্ণ মানুষের মন। পুকুরঘাটে, উঠানে ধান শুকোতে-শুকোতে জমে পারস্পরিক খোঁজ খবর, বিনিময় ও গল্পআসর। আকাশের মেঘ দেখে আবহাওয়ার খবর দেয়া পান চিবুতে-চিবুতে দাদির গলায় শোনা যায়`কালা মেঘে নালা হানি/দলা মেঘে গলা হানি।‘ ধান ঠিকমতো শুকিয়েছে কিনা পা দিয়ে পাটিতে মাড়িয়ে চাল বের করে ছোট চাচির হাতে দিলে চাচি দাঁতের ফাঁকে কট করে আওয়াজ পেলে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় ধান শুকানোর কথা। তার কথামতো্ই ধান ঘরে তোলে। অকাল প্রয়াত মেয়েটির জন্য সুর করে কাঁদে মা, চাচি ও আপনজন। বখে যাওয়া ছেলেটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিভোর হয় চায়ের টেবিলে হাটের মুরুব্বীগণ।কারো নিন্দা বা পরাজয়ে মজা করার নিন্দুকদের দল খুব কম হয় এটা বলা যাবে না। শশুরবাড়িতে মেয়েদের চলে অনেক খাঁটুনি। সব জেনেবুঝেও বাবা মেয়েকে না্ইওর নিতে যায় না। মেয়ে কান্দে, বাউরি বাতাসের কাছে বলে তার দু:খগাথা:

বাউরি বাতাস বাউরি বাতাস
উড়াল নদীর চরে
আমার খবর পৌঁছা্ই দিও
বাবার আড়ত ঘরে।

বাউরি বাতাস বাউরি বাতাস
মনে-মনে কান্দি
দু:খগুলো মনের গিটাত
শক্ত করে বান্দি।

বাউরি বাতাস বাউরি বাতাস
যাওরে তাড়াতাড়ি
মা-বাবারে বুঝায়ে কবা
নিতে গো না্ইওরি

বাউরি বাতাস বাউরি বাতাস
রাখিও খবর
ছোট্র বইনটা কেমুন আছে
হইছে কি ডাঙ্গর?
ওরে যেন পায় না বাগে
দুপায়ি হাঙ্গর ।

চাঁদনী রাতে উঠানে বসে গল্প গানের আসর; বিশেষ করে বাড়িতে কোনো নাইওরি আসলেই এসব আসর বেশ জমে ওঠে। না হয় বাড়ির ছোটদের পরীক্ষা শেষ হলে। সাদা উঠানে সাদা অথবা ডিজাইন করা মোসতাকের(মুত্রাবেত) এর পাটি বিছিয়ে গল্প-গান আসর । কখনো কখনো খেলাও চলে। লুকোচুরি, বৌচি, গোল্লাছুট। পরীক্ষা শেষ হলে বাচ্চারা, পুকুরের পাড়ে বসে বা ভিটিক্ষেতে বনভোজনের আয়োজনে মেতে থাকে। পুকুর থেকে নিজেরা মাছ ধরে, বন থেকে লাকড়ি ও শাকসব্জি কুড়িয়ে এক ঘরের চাল ও অন্য
ঘরের তেল ও অন্যঘরের মসলাপাতি দিয়ে রান্নার আয়োজন চলে। সারা বছরই চলে ফুলনের সুর। ফুলন ফুলন দোলন
ভাসতে থাকে `এপেনটি বাইসকোপ নাইনটেন টেসকোপ
চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠক খানা।...।
খেজুরপাতা ছিঁড়ে একটার ভিতর একটা ভরে দুজনে মিলে গায়
`চরকা চরকা হুতা কাট,
কািইল বেয়েনে নগর আঁড
নগর আঁড যাবিনি
বাঁডা মাছ কিনবিনি
বাঁডা মাছের তেলে
মোমবাত্তি জ্বলে
কোনাই-কোনাই জ্বলে
শিরি গাছের তলে...`

তবে এখন আর অকালে বিধবা মেয়েটি পরিবারের গলগ্রহ হবার কথা ভাবে না। স্বামীর বাড়ি বা নিজের বাড়িতে তৈরী করে নেয় নিজের ও সন্তানদের পরিচালনার যাবতীয় পরিকল্পনা ও কর্মকান্ড । স্বামীকে ছেড়ে আসা মেয়েটিও তার জীবন নির্বাহ করতে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। ঠিক একইভাবে ছৈয়াল বা জাল্যা পাড়ার ছেলেমেয়েরাও আর্থিকভাবে পরনির্ভশীলতা কাটিয়ে উঠেছে। অবশ্য এ সবের পেছনে সমাজ কল্যান সংস্থা বা এনজিও দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। পরিবারের সন্তানাদি ছোট বা নিয়ন্ত্রিত রাখার ক্ষেত্রেও ভূমিকা তাদের কম নয়। এভাবেই অধিকাংশ পুরুষের মুক্তমন সাথে নিয়ে গ্রাম দাঁড়িয়ে থাকে,  স্বনির্ভর।
পরিশেষে কবিতায় শেষ করি এভাবে:

রেখে আসি উত্তরের পথে গাঁয়ের রেশম বুক  
প্লেটভাঙা কারুকাজ ঠকাঠক কাঠের খড়ম  
মসজিদের পাকাথানে কোরানের কোরাস-সুখ  
মেহেদি রঙিন বউ টানা টানা চোখের সরম।

আউল-বাউল ঝাড়বন অগোছালো পথ-ঘাট  
বর্ষা-ধারায় ঘাস-ফুলের ফাঁকে মাছের উজান
পাঠশালা মাঠজুড়ে গোলবাঁধা নামতার পাঠ  
সুর তোলে পা‘র কচিপাতা মাখা শিশিরের গান।

ধান কাউন মরিচ অড়হর মসুর কলাই  
মিলে মিশে দোল খায় শিশুবেলা দক্ষিণ পাথার  
তালের নৌকার ভিড় তালে তালে পানা খালপাড়  
শাপলা-শালুক বিল, কৈয়া জাল, পোনা ভরা চাঁই।

মুড়ি খই, চিঁড়া ভাজা, গুড়ি কুটা কাজের মসুম  
এ-বাড়ি ও-বাড়ি দৌড় প্রিয়মুখ কথার কুসুম  
কীর্তন-প্রসাদী ঢোল রাতজাগা পূজা-পার্বণ  
ঈদ-মেলা ডাকে আয়, ভাঙে পাড় করে গুঞ্জন।

বাঁশবন শনশন বাউরি বাতাসে ঘূর্ণি নাচন
ফেলে আসি বুক ছিঁড়ে বহুদুরে জীবন পাঁচন।