আপনি একজন শিক্ষক ছিলেন,-----
আপনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, -----
অতঃপর আপনি একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু সর্বোপরি আপনি একজন মানুষ ছিলেন, ----- মানুষ গড়ার স্বপ্নে বিভোর একজন স্বপ্নপ্রবন মানুষ! রংধনু আঁকা জীবনের স্বপ্ন-পসরা মাথায় নিয়ে
উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান করতেন ------
"কেউ স্বপ্ন নেবে, স্ব-প্ন; -------
মানুষ হওয়ার স্বপ্ন,------
মনুষ্যত্বের স্বপ্ন,------
মানবতার স্বপ্ন -------
আপনার বাবা কোন আইনস্টাইন ছিলেন না,
মার্কস্ কিংবা লেনিন ও ছিলেন না,------
আভিজাত্যহীন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাপোষা অভিবাবক, সৎ আদর্শনিষ্ট একজন সাধারণ মাঝি।
ধর্মীয় বিভেদ রেখা পেরিয়ে প্রতি বৎসর
'সীতারাম-কল্যাণম্' উৎসবে নৌকা সাজিয়ে
রামেশ্বরম মন্দিরের মুর্তি নিয়ে যেতেন রামতীর্থে।
তাঁর কাছেই আপনি শিখেছিলেন,
উদারতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর সততা।
আর আপনার মা? --------
মাদার টেরিজার মত মহীয়সী রমণী ছিলেন না।
আটপৌরে গিন্নিপনায় প্রতিদিন বাইরের
অগনিত মানুষকে খাওয়াতেন যত্ন করে।
নিজের বরাদ্দ খাবারটুকু অনাহূত অথিতির পাতে
তুলে দিয়ে উপবাস করতেন হাসিমুখে।
তাঁর কাছেই আপনি শিখেছিলেন,
মহত্ত্ব আর ভালবাসা, যা আপনাকে মানুষ থেকে
'মনীষী'তে রূপান্তরিত করেছিল।
তাই, আত্মসংযমের কঠিন শৃঙ্খলে হে তাপস!
মাত্র আট বছরের শৈশবে তেঁতুল-বিচি বিক্রি করা পয়সায় আপনি নিজেকে রাজপুত্র ভাবতেই পারেন!
অথবা নিমজ্জমান অভাবের সংসারে শৈশব
কাটিয়েও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারেন ------
"আমার শৈশব, মানসিক এবং নৈসর্গিক ভাবে
খু-উ-ব বেশি সুরক্ষিত ছিল।"
আশ্চর্য মনে হলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থানের
বিচারে আপনার কথায় কিন্তু বেশ যুক্তি আছে।
অথচ প্রগতির মূর্তপ্রতীক আমাদেরকে দেখুন;
মাইক্রো পরিবারের সুরক্ষিত শৈশবে
আমাদের হৃদয়-মণিকোঠা অবরুদ্ধ!
এখানে দিদা নেই, ------ দাদু নেই, ----
পাড়াপড়শী, পরিজনের কোন আনাগোনা নেই।
একান্নবর্তী পরিবারের দায়মুক্ত বাবা-মা
আত্মভারে অবসন্ন!
হৃদয়ের অনুর্বরতায় সম্পর্কের বুনন তৈরী হয়
আন্তর্জালে আর 'মুখ-পুস্তিকা'য়!
মননের সংকীর্ণ পরিসরে আলো হাওয়ার অভাবে
কল্পনা আর অনুভবের ফুলগুলো ঝরে
যায় বসন্তের অ-নে-ক আগেই!
বস্তুত, ক্যরিয়ারের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে
আমাদের ঘুমোতে না দেওয়া স্বপ্নগুলো কখন যে
জীবন-বৃত্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যায়,
আমরা নিজেরাই টের পাই না!
ভোগবাদী চেতনায় শিক্ষকতাও আজকাল
বিপণন সামগ্রী। তাই,
সুব্রামানিয়া আইয়ারের মত স্যারদের বাড়িতে
ছাত্রদের নিমন্ত্রণ জোটে না খুব একটা।
মনে পড়ে আপনার? ------- 'আপনি তখন
এলিমেন্টারি স্কুলে পঞ্চম মানের ছাত্র।
প্রতিদিনের মতো টুপিমাথায় শ্রেণীকক্ষে বসে আছেন
সহপাঠী রামানন্দের পাশে প্রথম সারিতেই।
নবাগত ব্রাহ্মণ শিক্ষক, পৈতে'র পাশে টুপিকে
মানিয়ে নিতে পারেন নি, ------ তাই আপনাকেই
যেতে হল পেছনের সারিতে। আপনি বুঝতে
পারেন নি; ব্যথাটা সেদিন আপনার চাইতে
রামানন্দের বুকেই বেশি বেজেছিল।
পরদিন রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, ---- রামানন্দের বাবা পক্ষীলক্ষ্মণ শাস্ত্রী, মাষ্টার মশাইকে
ডেকে পাঠালেন ---- "বর্ণবাদ আর সাম্প্রদায়িক
অসহিষ্ণুতার বিষ খাইয়ে আপনি কি আমাদের
নিষ্পাপ শিশুদের মেরে ফেলতে চান?
সোজা কথায় বাচ্চাদের কাছে কৃতকর্মের ক্ষমা
চেয়ে নিন্, আর নাহয়, --------
দয়া করে রামেশ্বরম ছেড়ে চলে যান।"
কী অদ্ভুত আদেশ? একজন ব্রাহ্মণ মাষ্টার
মশাইকে তাঁরই ছাত্রদের সামনে মানবতার
পাঠ শেখাচ্ছেন একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত!
আমাদের কাছে শুধু অসম্ভব নয়; অকল্পনীয়!
হে স্বপ্নদ্রষ্টা সন্যাসী ,
আপনার স্বপ্নরহস্যের মায়াজাল আমার
কাছে আজ উন্মোচিত! আমি জানি,---- স্বপ্ন নয়,
স্বপ্ন নয়, সাধনার কঠোর মন্ত্রে জেগেছিল
বুভুক্ষু হৃদয়, ----- সৃষ্টির আগুনে!
স্বপ্নদেখা ঘুমের সময় কোথা' 'প্রজ্জ্বলিত মননে'?
তাই আকাশছোঁয়া স্বপ্নকে যান্ত্রিক অবয়বে ধরে
রাখার কী যুগান্তকারী প্রয়াস!
তিলে তিলে, কৈশোরের স্বপ্নভাঙ্গা ভোররাতে
ধনুশকুড়ি রেল লাইনের পাশে খবরের কাগজ
কুড়োতে কুড়োতেই গজিয়ে উঠে 'আগ্নিপক্ষে'র
আগুন ঝরা পালক!
প্রসস্ত হয়, রামেশ্বরমের মসজিদ-গলি থেকে
রাষ্ট্রপতি ভবনে উড়ানের পথ!
হে স্বপ্নের যাদুকর!
প্রতিবন্ধকতার ইন্ধনে দগ্ধ জীবন মিসাইলে
আকাশের যাত্রী আপনি -------- আগুনের ডানায়
পাড়ি জমিয়েছেন অসীমের ঠিকানায় ------
স্বপ্নরাজ্যের ওপার থেকে নিশ্চয়ই আজ
দেখছেন, কী অদ্ভুত মহিমায় জাতপাতের আকীর্ণ
ডালপালায় জড়িয়ে পড়ছে আমাদের স্বপ্ন-ঘুড়ি!
ডিডেলাসের মতো অবরুদ্ধ হয়ে আছি স্বরচিত গোলকধাঁধায়, -------- চোখের সামনে ইকারাসদের
মোমের ডানা গলে গলে পড়ছে, ------
আমরা দেখে যাচ্ছি, অসহায় নির্বিকার!
আজ জন্মদিনের এই শুভলগ্নে, হে শিক্ষক,
আপনার কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করে -----
আর কতজন পেহ্লু খান কিংবা তাবরেজ্
আনসারিকে হারালে আমরা পেতে পারি একজন জয়নুলাব্দিন? --- কিংবা একজন পক্ষীলক্ষ্মণ শাস্ত্রী?
স্বপ্নের পরিধিটা আর কতটুকু বাড়ালে আমরা
ডিঙোতে পারি NRC র বেড়াজাল?
অথবা প্রমাণ করতে পারি ----- এদেশ আমাদের!
------- হিন্দু- মুসলিম, বৌদ্ধ-খৃষ্টান,
সবাই ভারতীয় আমরা, একই মায়ের সন্তান!
--- খছরুজ্জামান্
১৫/১০/২০১৯ ইং