তখন দুপুর; খা খা রোদ রাস্তায়, তবু যেতে হবে।
শিল্পকলা থেকে নিয়ম মাফিক কাজকর্ম সেরে ছুটলাম চাঁনখার পুল;
পেটপুজা না সেরে দুনিয়ায় কোন পুজা চলে না; নাড়ীর যন্ত্রনা বড়ো
বেশী জ্বালায়; বিবেক লোপ পেয়ে যায়, দূর্বলতা আসে।
অগত্যা ভর্তাভাত পাতলা ডালে সেরে নিলাম-
সবাই মিলে দুপুরের ভোজ; কেউ কেউ অন্য টেবিলে ভিন্ন স্বাদের
ব্যঞ্জনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল, যদিও দৃষ্টিকটু ছিলো পুরো বিষয়।
বসবার জায়গা ঠিক ছিল; চলে এলাম হেঁটে হেঁটে।
তখন কমলা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে ঘাসের বুকে-
আনাগোনা কম ছিল না সেখানে; বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক-যুবতী
যে যার মতোই প্রিয়জনের সাথে ব্যক্তিগত আলাপে ছিল মশগুল।
কেউবা মোবাইল ফোনে ছবি তুলবার ব্যস্ততায়।
আমাদের ছিল এক পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা,
‘রক্তের নির্জন কল্লোল’ স্রষ্টা স্বশরীরে আসবেন, কথা বলবেন এই
সুনসান বিকেলে। অপেক্ষায় ছিলাম বারোজন; দলনেতা ‘তানভীর’
ভাইকে নিয়ে চলছিল সময়ের সদ্ব্যবহারে মহড়া।
কার্জন হলের সবুজ চত্বর; ঘাসের বুকে শরমরাঙা
কমলা বিকেল সকল আগল খুলে দিয়ে যেন বিছিয়ে দিয়েছে আঁচল,
পায়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে এলেন আমাদের প্রিয়ভাজন ‘পিয়াস মজিদ’
কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে যার সুনাম এখন তুঙ্গে।
যথাযথ কুশল বিনিময়, উপহার সামগ্রী বিতরণের পর
মূল আলোচনায় মগ্ন সবাই। বিষয় ‘জীবনানন্দ দাশ’ তার রচনা
সাহিত্যে অবদান, অবহেলিত জীবন যাপন, কর্ম জীবন, এবং
তার জীবনের নানবিধ টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা।
পৃথিবীতে কেউ কাউকে জায়াগা ছেড়ে দেয় না,
নিজের জায়গা নিজেই তৈরী করে নিতে হয়, কেউ সাগ্রতে নেয়ও
কেউ তা ভ্রুক্ষেপও করে না। ‘জীবনানন্দ দাশ’ যেন অচল পয়সার
মতো গড়িয়ে চলে; বিস্মিত হতে হয় তার জীবনযাত্রায়।
পুরোটা জীবন ছিল সাহিত্যে নিবেদিত, কবিতায়
যার দেশ ও দশের কথা, প্রকৃতির কথা, প্রেম-বিরহ নিয়ে যার
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ব্যতিক্রমী শব্দগাঁথুনি, সেই কবি সারাটা জীবন
ছিলেন অবহেলিত। অর্থাভাবের কষাঘাতে জর্জরিত।
নাক উঁচু পুরোধা ব্যক্তিত্বেরা তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ
করতেও এতোটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। তবু জীবন চলেছে তার
জীবনের নিয়মে, রেখে গেছেন অমূল্য সব সৃষ্টি। সাহিত্যের ভাণ্ডার
পূর্ণতা পেয়েছে তার সৃষ্টি রসদে, জীবন বৈচিত্রে।
উনিশ’শ চুয়ান্ন অক্টোবরের এক নির্মম ট্রাম
দূর্ঘটনাায় যার জীবনাবসান। অনেকের মতে আত্মহত্যা, বোদ্ধারা
বলেন, না আত্মহত্যা নয়; কোন ভাবনায় নিমগ্নতা। যার চাওয়ার
কিছু ছিলো না জীবনে তিনি কেন আত্মহত্যা করবেন!
হাতে ডাবের কাঁদি; অসুস্থ কবি হেঁটে যাচ্ছিলেন
ঘরের দিকে; ট্রামচালক বার বার হুইসেল দিয়েও তার মনোযোগ
আকর্ষণ করতে পারেননি। শম্ভুনাথ হাসপাতালে পাঁজরভাঙ্গা কবি
চিরকালের মতো ঘুম না ভাঙ্গা ঘুমে অচেতন।
না জানা অনেক বিষয়াবলী উঠে আসছিলো আলোচনায়,
সবাই শুনেছি, ঋদ্ধ হয়েছি এক বিকেলের অমূল্য এই আলাপচারিতায়।
জীবনে কতো বিকেল কতো দুঃখ-শোক, আনন্দ-বিহ্বলতায় কেটেছে,
কিন্তু আজকের কমলা বিকেল অক্ষয় স্মৃতি হয়ে রইল হৃদয়ে।
------------------ ০ ----------------
১৩ আগষ্ট ২০২২, ২৯ শ্রাবন ১৪২৯, ১৪ মহররম ১৪৪৩, শনিবার, সকাল: ০৯:১১, কাব্যকুঞ্জ, (স্বত্ত্ব সংরক্ষিত)