আমি     উঠেছি জেগে বিশ্বকে অবাক করে
           আমার আগমন চলছে যুগ-যুগ ধরে।
আমি     জেগেছি আলো ছড়ায়ে আকাশ জুড়ে আপনমনে,
            এ মুঝদা পৌঁছে গেছে বিশ্বের সর্বস্থানে।
আমি     দূর করতে এসেছি সকলের রোদন,
           আমার আগমনে ভুলে গেছে সবে ক্রন্দন।
           ‘যিনি দিয়েছেন সকলের জীবন কওসর
           আমার বক্ষে সতত বসবাস তার।’
আমি    সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ কোন অপূর্ণতা আমার নাই
           মানুষের সৃষ্ট আইন-কানুন মানিনা ভাই।


আমি    আলো ছড়ায়ে আকাশ জুড়ে উঠবো জেগে
           অবাক নয়নে দেখবে সবাই তাকিয়ে !
আমি    অচেনা-অজানা পথিক বলে,
           কেউ কেউ দেখবে আমায় অবহেলে।


আমি     জেগে উঠেছি যেন এক ভীমরুল,
           অত্যাচারী-কূপমন্ডুক ভয়ে পাবে না কোন কূল।
           ‘হুল ফোটাতেই জেগে উঠবো আমি
            অত্যাচারীর দল সকলেই যাবে থামি।
            দিকে দিকে আজি বুজদিলদের বাস,
             পৃথিবীটাকে বানিয়েছে তুরুপের তাস।’
আমি      অ-সত্যের বুকে পদাঘাত করে
             বুকে তুলে নেব জনমের অত্যাচারিতরে।

আমি      আপনার সাহসে জেগে একাকি,
             হানিব তাদের বুকেতে আঘাত রাগি,
             স্ব-জাতিকে যারা দেয় ফাঁকি।

আমি     আলো ছড়ায়ে আকাশ জুড়ে উঠব-ই জেগে,
            শয়তানের দল তা দেখে যাবে ভীষণ রেগে।
            ‘যত আছে আঁতেল-দালালের দল
            সকলেই পাবে এবার তাদের কর্মফল।’
আমি     জেগে উঠব-ই সহসা তাদের তরে,
            আজীবন যারা অবহেলা-অপমান সহ্য করে।

আমি      তাদের বুকে আঘাত হানি
             ঝরাবো তাদের চোখের পানি –
             যারা মায়ের বুক খালি করে আনন্দে মাতে
             ভয় যাদের নাই একটুও বুকেতে।

আমি      পূর্ণিমার আলো হয়ে আকাশেতে উঠবো জেগে
আমি      শমসের হাতে থাকবো হরদম বে-দেরেগে।
আমি      করে দেব-ই দেব মিসমার,
             যত আছে শোষকের গড়া দরবার।
             ‘যুগ-যুগ যুগান্তর শোষিছে যারা মানুষেরে
              ভুলে গেছে যারা আপনারে একেবারে
              আনন্দে দিবা-যামী রত যারা হরওক্ত,’
আমি       ঝরাবোই ঝরাবো তাদের বুকের রক্ত।

আমি      তোমাদের ঐ প্রাসাদ ভেঙ্গে আনবো তাদের মুক্ত করে
             জিঞ্জির হাতে আজীবন যাদের রেখেছ বন্দি করে।
             শুনে নাও এবার আমার শোহরত,
             হে নিঠুরের দল এ-ই তোমাদের বখত্।

আমি     দিলওয়ারী, আমি তাজী,
আমি     শোষিত কৌমকে মুক্ত করতে হরদম রাজি।

আমি       আলো ছড়ায়ে আপনার ইচ্ছায় উঠবো জেগে,
             মুক্তির বারতা আনবো ধরার বুকে।
আমি      আপনার মনে পথ চলি নিজ আনন্দে,
             গান গেয়ে চলি আপনার দেয়া সুর ও ছন্দে।
             ‘বুকে যে মানুষ আজীবন বয়ে চলে ব্যথা
             লুকিয়ে রাখে মনের বনে হাজারো কষ্ট-কথা’
আমি      তা-রি বুকে গড়ে তুলব ডেরা,
             ঝরাবো তার চোখে আনন্দ-আঁসু ধারা।
             ‘চেয়ে দেখ ভাই আজি দুঃখ কোথাও নাই
             এসো না বুকে বুক মিলিয়ে আনন্দ গান গাই
             মানুষের মাঝে ভেদাভেদ নাই এই তার ফরমান,
             হে বন্ধু নিয়ে এসো তোমার সামান’-
আমি      ভেঙ্গে ফেলবো দুনিয়ার শোষকের প্রাসাদ-প্রাচীর
            যারা যুগ -যুগ ধরে গড়েছে মানুষের জন্য জিঞ্জির।

আমি     করবোই করবো সবাইকে জের-
            হায় ! বদ-নসিব তাদের-
            ‘যারা সুমসাম গেঁথে চলে মানবতা বিনাশের মালা
            মানুষকে করে অবজ্ঞা আর অবহেলা’
আমি      তাদের বুকে আঘাত হানি করবো জেরবার
আমি      ন্যায়ের রঙিণ নিশান হাতে ফিরে আসবো বারবার।

আমি     হুঙ্কার ছেড়ে উঠবো-ই জেগে,
            উন্মাদ হয়েছে মম চিত্ত ভীষণ রাগে।
            ক্লেদাক্ত মানুষগুলোকে পুঁজি করে
            নিত্য যারা উল্লাসে ফেটে পরে
            তাদের ধ্বংসে উঠবে জেগে আমারি শমসের,
            সাহস করবে না কেউ অত্যাচারি হতে ফের।

আমি      এসেছি ন্যায়ের তাঞ্জাম হয়ে
            ভালোবাসার পতাকা হাতে নিয়ে।
            ‘যে প্রেয়সী আজীবনের তরে প্রেমিক হারা,
            যার বক্ষে বহে শুধু কষ্ট জলের ধারা,’
আমি      তার বুকে ভালোবাসার ফুল ফোটাব
আমি      তার প্রেমিক হব।

আমি     আসবো-ই মুক্ত করতে শৃঙখলাবদ্ধ বিশ্বকে
            আলো ছড়াতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধরার বুকে।
আমি      ন্যায়ের তেগ হাতে আসব যে যাই ভাবুক,
             অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে কুল-মখলুক।

আমি       নকীব, আমি আফতাব
             পূরণ করবো দুঃখী মানুষের খাব্ ।

আমি      জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেব পৃথিবীরে
             হরদম আগ জ্বলে আমার বুক জুড়ে
             আগুনের স্ফুলিঙ্গের মাঝে সদা বসবাস আমার
             পয়মাল করে দেব শোষকের বাড়ি-ঘর।
             আমার হাতে শোভা পায় না কখনো জিঞ্জির,
             সাধ্য নাই কারো বন্ধী করবে আমারে পৃথিবীর।
             আমার মাঝে কমি’র বসবাস নাই,
             হরওক্ত জয়ের -ই গান গাই।

আমি       চির সত্য, সরওয়ারে কায়েনাত
আমি       সাচ্চারই পথে চলি দিন-রাত।
             ‘আমার কোনো গমি নাই কখনো ছিলও না,
             গমিকে জয় করে নিত্য চলি-ফিরি আপনা।’
আমি      উথাল-পাথাল, আমার নেই কোনো আবাস,
আমি      আপনার মাঝে করি শুধু বসবাস।
আমি      আপনাকে জয় করেছি ওগো ভাই
             আমার দুঃখ-ব্যথা-বেদনা কিছুই নাই।
আমি      চিরকালই দারাজ দিল্,
             বিনাশ করবো তাদের যারা কঞ্জুস দিল্।

আমি       আলোকিত করে দুনিয়া উঠবো জেগে
              চারিদিকে ভালোবাসার মেশক বু ছড়ায়ে।
আমি       এক  ক্ষ্যাপা মসতান,
              আমার বুকে বাজে উন্মাদনার তান।
আমি       তাদের তরে নিয়ে এসেছি নওরাতি,
              যাদের সঙ্গী শুধু সিয়াহ্ রাত্রি।

আমি        জোরওয়ার আজাদ করাই আমার কাজ,
              আমার আমামা’য় শোভা পায় জয়ের তাজ।
আমি       বয়ে বেড়াই সদা ন্যায়ের হাতিয়ার,
              আমার আগমনে অপরাধীরা হয়ে ওঠে দিকদার।


আমি       মুক্তিদাতা,
আমি       অবহেলিত-নিগৃহিত জাতির ত্রাণকর্তা।
              ‘অসহায় জাতি ভুলে গেছে হায় ন্যায়ের তাজিম
              তামাম সত্তা জুড়ে তাদের অন্যায়; হাতে শরাবের জাম,
              ভুল পথের পথিক সবাই, ভুলে গেছে সঠিক পথ
              কান্ডারী বিহীন ইচ্ছামাফিক শুধু চলেছে রথ।’
আমি       অর্ধচেতন এ জাতিকে করবো জাগ্রত,
              চেতনা ফিরায়ে তাদের করবো সঠিক পথে রত।

আমি       কোনকালে কখখনো হই না পেরেশান,
             পৃথিবীর সর্বত্র উড়াব জয়ের নিশান।
আমি       চিরকাল থাকি জিন্দা আল্লাহ্ র ইচ্ছাতে
             মৃত্যু কখনো স্পর্শ করে না চলে সে অন্যপথে।
             ‘আমার আগমনে কাঁপে সারা দুনিয়াদারি
             সঙ্গদিল ছুটে চলে নিজ ঘর-বাড়ি ছাড়ি।’  

আমি      আপনার ইচ্ছাতে চলি এ আমার জেওর,
আমি      জানাই তাদের প্রতি কহর-
            যারা অন্যায়ে মেতে পৃথিবীকে করে তাবা
আমি     জোশে মেতে তাদেরকে দেব থাবা।
আমি     শোর্-আওয়াজ করে জেগে উঠেছি  এবার
            বন্ধ করে দিতে পৃথিবীর অন্যায়-অবিচার।
           ‘আমার ভুবনে নেই পরাজয়ের গ্লানি’
আমি     শোষকের পাষাণ বক্ষে বারবার আঘাত হানি।

আমি      কেঁড়ে নিতে চাই তাদের খাড়া গর্দান
            যারা মানুষকে মেরে করে আনন্দ-আয়োজন।  
            ‘আমার তামাম আঞ্জাম তাদের বিরুদ্ধে
            পঁচা-কলুষিত-মিথ্যা ভর করেছে যাদের স্কন্ধে
            যারা বারবার আঘাত করে এ বিশ্বের ওপর
            গোরস্তানে পরিণত করেছে মানুষের বাড়ি-ঘর।’
আমি      তাদের-ই জন্য নিয়ে এসেছি এ-ই সামান
             তাদের বিনাশের তরে আমার আগমন।

আমি       আলোর পথের পথিক জেগে উঠি বারবার,
              বিশ্বের বুকে আলো ছড়াতে সহস্রবার।
আমি      জেগে উঠি প্রচন্ড খুন-জোশীতে,
             জোছনা ছড়িয়ে দেই আঁধার নীশিতে।

আমি      শের, হুঙ্কার ছেড়ে গ্রাস করবো বিশ্ব
            পুঁজিবাদি শোষককে করে দেব নিঃশ্ব।
আমি      তাদের বক্ষকে করে দেব বিয়াবান
            এ বিশ্বে যত আছে পলিদ প্রাণ।

আমি      জেগে উঠেছি আঁধারে ভোরের আযানের ন্যা-য়,
             সুপ্ত এ কৌমকে জাগ্রত করার আকাঙ্খায়।
            ‘আমার আগমন মুক্তির বারতা নিয়ে
             মুক্তি পাগল আমি পথ চলি গান গেয়ে
             পঁচা-ঘুণে ধরা এ বিশ্বের বুকে
             যারা পথ চলে ধুঁকে ধুঁকে
             তাদেরকে জীবনের মানে শেখাতে
             জীবনকে বোঝাতে এসেছি ধরাতে।’
আমি      আপনাকে চিনেছি জেনেছি নিজের ইচ্ছায়,
             নিজেতে ডুবে থাকি এক অচেনা মায়ায়।

আমি       তার বুকে ফোটাতে চাই ফুল,
             যে শুধু জানে জীবন মানে ভুল।
  আমি     তার কাছে যাব আনন্দ হয়ে
              আজীবন যে শুধু রোয়ে।
আমি       তাকে দেব শুধু তাকেই দেব ভরপুর করে
              জীবনে চলতে চলতে যে শুধু অভাবী হয়েছে রে।


আমি       তাকে শোনাব উৎসাহ-উদ্দীপনার গান
             পরাজয়ে পরাজয়ে যে হয়েছে পেরেশান।
             ‘আমার তাজি ছুটে যাবে তার পানে
             দুঃখ-বেদনা-হতাশা যার বুকে আঘাত হানে।’
আমি      দারাজ্ দিল, আমি জোরওয়ার
             তাদের-ই নিমিত্তে যারা ব্যথাতুর দিকদার।
আমি      কখনো কখনো পাষাণ-প্রাণ,
             মানুষ হন্তারককে করি না পরিত্রাণ।

আমি      উঠেছি জেগে ঈদের চাঁদের ন্যা-য়
            কূপমন্ডুক শয়তান করছে নফসি নফসি হায়।
            ‘যুগ যুগ যারা নিপীড়িত-অবহেলিত
            পরে পরে মার খেয়ে একবারে ক্লান্ত,
            তারা উচ্চৈঃস্বরে জানাচ্ছে ফরিয়াদ-
            ন্যায়ের তাজ তুমি নাও এর দাদ।
            মর্সিয়া গেয়ে চলবো কত আর
            সময় এসেছে ফিরে দাঁড়াবার।’
আমি     শুনেছি গো নিপীড়িতের ফরিয়াদ,
            শয়তানের দল এবার শুধু কাঁদ।
আমি     শুনেছি ভাই হারা ভাইয়ের কাঁদন,
            দিবা-নিশি ভাইয়ের জন্যে করছে রোদন।
আমি     তার ভাই হবো চিরদিন তার কাছে রবো
            তার আঁধার বুকে আলো জ্বালাবো।


আমি     আঁধারে আনবো আলো, ছড়াবো দ্যুতি
            আমার দু’চোখে ন্যায়ের জ্যোতি।
আমি     অপূর্ণ জীবন ভরপুর করে তুলব,
আমি     সন্তান হারা মায়ের সন্তান হব।
আমি     অশান্ত, ছুটে চলি পৃথিবীর সকল প্রান্ত
            আমার আগমনে পৃথিবী আজ শান্ত।
            ‘আমার আদি-অন্ত নেই আমি হরদম থাকব,
            অবিচার রোধে, প্রেম বিলাতে বারবার আসব।’

আমার    আগমন দেখেছে কুল-মখলুকে,
             আল্লাহতায়ালা নিত্য জাগেন মম বুকে।


বিঃদ্রঃ   কবি কাজী নজরুল ইসলামের  ‘বিদ্রোহী ’ কবিতা দ্বারা উৎসাহিত এ কবিতা খানি। কবিতায় ব্যবহৃত ‘আমি’ শব্দটি রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে আমি কোনো ব্যক্তি নয়, মূলতঃ আমি শব্দটি “ন্যায়ের প্রতীক” হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৪.০১.২০০৫