কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল কর্তৃক সম্পাদনায় প্রকাশিত 'কাব্য কৌমুদী' হাতে পেলাম আজ দ্বিপ্রহরে। যে কোন নতুন বই পেলে সেই কিশোরকাল থেকে যে অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে, তাই করলাম। অর্থাৎ, বইটা খুলে নাকের সাথে লাগিয়ে গন্ধ শোঁকা। গন্ধটা মগজের ভেতর নেশা ধরিয়ে দিলো। ফলে, দুপুরের ঘুমুনের সময়টা যথাযথ কাজে না লাগিয়ে কবিতা পাঠে নিয়োজিত করতে হলো।
১৬ জন কবির সর্বমোট ১০০ টি কবিতা । সবগুলো কবিতা একনাগাড়ে পড়া হয়নি। তবে, পরবর্তী সময়ে পুরো কাব্যগ্রন্থটিই পড়া হয়েছে। কিছু কিছু কবিতা দারুণভাবে আমার মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। অনেক ভালো লাগা নিয়ে কোন কোন কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়েছে।
চাঁদনীরাতে নদীর পাড়ে পাশাপাশি বসা একজোড়া মানব-মানবী। জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে আকাশের মেঘের উপর আর নিচে জলের আঙিনায়। দু'টি নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরছে জেলেরা। এমন একটি চিত্রপটের সুন্দর প্রচ্ছদের কাব্য-সঙ্কলন 'কাব্য কৌমুদী'। এই সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছে সানী কবীর। বইটিতে Flap ( চিকন ফিতার লেজ) লাগানো। প্রকাশক- মানুষজন।
১৬ জন কবির কবিতাগুলো অবশ্যই তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোই প্রকাশের জন্য দিয়েছেন। তা পড়লেই বুঝা যায়। প্রকাশিত সঙ্কলনের কবিতাগুলো পাঠ পরবর্তী আমার উপলব্ধির আলোকে বলছি-
কবি অনিরুদ্ধ বুলবল-এর ৭ টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই ভালো লাগলো। 'প্রেম তুমি কাঞ্চনী হেম'-এ যখন কবি বলে যান-
'তুমিহীন এ জীবন লাগে গুরুভার
তোমার দুঃখে কাঁদি, হই জারেজার
তুমি এলে নদী যেন স্রোত ভুলে যায়
মনে পোষা ব্যথা-জ্বালা নিমেষে লুকায়'
তখন মনটা অন্যরকম ভালো লাগায় ভরে উঠে।
কবি আল মামুন-এর ৫ টি কবিতা। কবি যখন প্রাণের গভীর থেকে বলে উঠেন,
' একদিন পৃথিবীকে সাজাবো বলে-
কৈশোরের যৌবন সময়ে রহস্যময় কলম আর কাগজ হাতে নিয়েছিলেম'
আধুনিক কবিতার সুন্দর প্রকাশ। তখনই মনের ভেতর জেগে উঠে দীপ্তিময় পথে চলার এষণা।
কবি আশফাকুর রহমান পল্লব-এর ৬ টি কবিতা। কবির প্রতিটি লেখা-ই ছন্দের মাধুর্যময় কারুকাজে ভরপুর। এহেন কবিতার প্রতি আমার দুর্বলতা সব সময়। তার কবিতার প্রতিটি চরণ আমার মনকে রাঙিয়ে তুললো। তার 'এক ফোঁটা জল'-এ যখন বলেন,
'এক ফোঁটা এই চোখের জলে আর
থৈ মিলে না, সব ডুবে তার তলে,
মনের জগৎ সব ভেঙে চুরমার
থেকে থেকে ঝরে চোখের জলে।'
চিরন্তন এক বাণীর ভালো লাগা সাথে ভিন্নরকম এক দুঃখবোধ পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।
কবি কামরুন্নাহার রুনু-এর ৬ টি কবিতার প্রতিটি সুন্দর। কবি যখন বলেন,
'প্রতিদিন পেছন থেকে চুল টেনে ধরে আমাকে বিরক্ত করার
সেই প্রান্ত আজ কোন এক শূন্য কামরায়;
একাকীত্বকে চেপে ধরে বসে আছে, কে জানে?'
স্মৃতি পাণ্ডলিপি উপুর করে দেয়া মর্মকে স্পর্শ করে যাওয়ার মতো একটি কবিতা। প্রায় প্রতিটি কবিতাই যেন স্মৃতিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম-এর ৬ টি কবিতার প্রতিটি ছন্দে ছন্দে আনন্দ বিলিয়ে যায়। তার 'মনের কথা' যখন ছন্দ-দোলায় নেচে উঠে কাব্যের গহীন ভাবনায়, তখন ভালো লাগার অন্যরকম আনন্দ ঝরে পরে। কবির ভাষায়,
'সাগর দেখে মনটা আমার
বলছে উদার হতে
দুঃখগুলো লুকিয়ে রেখে
সুখ বিলিয়ে দিতে।'
কবি কৌশিক আজাদ প্রণয়-এর ৬ টি কবিতাই আমাদের জীবনবোধকে উস্কিয়ে দেয়ার মতো সাবলীল ভাব ও ভাষার প্রকাশ ঘটেছে। কবি যখন প্রাণের গহীন থেকে বলে উঠেন,
'আমাদের রক্তে ঘামে অনুপ্রবেশ করে অন্ধকার,
আমাদের সীমাহীন সীমায় সঙ্গম করে কাঁটাতার।'
তখনই জীবনকে বোধের উপলদ্ধি দিয়ে দেখা যায়। কথাগুলো নির্মম হলেও, কতো সত্য!
কবি খলিলুর রহমান-এর ৭ টি কবিতার প্রতিটি চারণকবির মতো শব্দের বিন্যাস তুলে ধরেছেন। জাতকবির দ্রুপদী সুর ও ছন্দ প্রতি কবিতায় খেলা করে যায়। কবির 'অপ্রকাশ'-এর ভাষায় বলতেই হয়,
'শিল্পী তুমি শোনাও যে গান নিত্য নব সুরে
তারই সাথে হৃদয় কাঁদে কোথাও অচিন পুরে
কণ্ঠে যা গাও ছন্দ-কথায় ভাব-সংগীতের রাগে
কেউ না দেখে কোন্ হৃদয়ের কান্না তাতে জাগে।'
এক দারুণ অভিব্যক্তির দীপ্য প্রকাশ কবির কবিতায় কবিতায়।
কবি খায়রুল আহসান-এর ৭ টি কবিতার প্রতিটিতে তার স্বকীয়তা তুলে ধরেছেন। তিনি যেমন মেঘবালিকার সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন ঘন মেঘের চাতাল। তেমনি দৃপ্ত পদে হেঁটে গেছেন তার 'পথ চলা' কবিতায়। কবির ভাষায় বলতে হলে,
'বিধাতার অভয়ারণ্যে হেঁটেছি শঙ্কাহীন,
শ্বাপদের ভয়ে চিত্ত কভু হয়নি মলিন।
ভালমন্দ না বুঝেই একা দিয়েছি হাঁটা,
তাঁর দয়ায় দূর হয়েছে পথের যত কাঁটা।
কবি জসীম উদ্দীন মুহম্মদ-এর ৭ টি কবিতার প্রায় সব কয়টিই বিমূর্ত ভাবধারায় লেখা। তার কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে বারবার রূপসী বাংলার কবির কথা মনে পড়ে যায়। তার লেখা ' আমার আরণ্যক মন একলা হাঁটে'তে লিখেন,
'আমার আরণ্যক মন একলা হাঁটে পৃথিবীর শরীর
ঘেঁষে, নির্বাসিত কিছু দীর্ঘশ্বাস ফিরে ফিরে আসে;'
কবি জালাল উদ্দিন মুহম্মদ-এর ৭ টি কবিতার প্রতিটিতেই আধুনিক কবিতার সুন্দর ব্যকরণ তুলে প্রকাশ করেছেন। কবির সরল কথার সৌন্দর্যে ফুটে উঠে ভালোবাসার মর্মার্থ। 'কেউ আমাকে' কবিতায় কবি যখন বলেন,
'আমি চাই কেউ দেখুক আমাকে
হতবাক হয়ে চেয়ে থাকুক,
মনে মনে ভাবুক আমাকে
বিড়বিড় করে বলুক, 'তুমি সুন্দর'!'
কবি নূরুল ইসলাম-এর ৬ টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই ভালো লাগার শব্দের সম্মিলন। কবির 'সর্ষে ফুল'-এর ভাষায় বলতেই হয়,
'ভোরের আলোয় শিশির কণা চিকচিকিয়ে উঠে;
সোনার অঙ্গে মুক্তার মালা কার কপালে জুটে?
কী অপরূপ দেখতে হায় ঈর্ষা ধরে মনে,
সর্ষে ফুলে সর্ষের গাছ যেন অষ্টাদশী কনে।'
কবি মুহাম্মদ রুহুল আমীন-এর ৬ টি কবিতাতেই সহজাত কবির ছাপ। প্রাণের কন্দরে জেগে উঠা শব্দাবলীর ঝংকার বেজে উঠে তার কবিতায়। তার 'দিও না আঘাত মনে' কবিতায় স্বতঃস্ফুর্ততায় ঝংকৃত হয়ে উঠে,
'কাউকে দিও না আঘাত পৃথিবীটা হোক স্বর্গ
আমিত্বকে বধ করো, দাও ভালোবাসার অর্ঘ্য।'
এক অমীয় ধারার বাণী যেন কবিতার পরতে পরতে বেজে উঠে।
কবি শাহীন আহমদ রেজা-এর ৬ টি কবিতার প্রতিটিতে ছন্দের যাদুকরী আলোড়ন খেলে গেছে। ভাবের স্পষ্টতা কবিতাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কবির দ্রুপদী ভাষায়,
'ডাকে না চন্দ্রা আসে না তন্দ্রা
আদরিণীর ছবি আঁকি চিত্তে
কাটে না নিশি হাসে না শশী
জীবন চলেছে আপন বৃত্তে।'
কবি সরকার মূনীর-এর ৬ টি কবিতা। পড়তে ভালো লাগলেও মর্মার্থ উদ্ধার করতে পাঠকে বেশ ভাবতে হয়। বিমূর্ততার গহীন বলয় থেকে উত্থিত শব্দরাজি কবিতায় বিকশিত হয়েছে। তার 'কবিতার জন্ম' কবিতায় লিখেছেন,
'শোকের কুয়াশা পেরিয়ে এলে-
বেদনার শিশির ভিজিয়ে দেয় আমাকে,
স্মৃতির ধোঁয়া উঠছে স্বস্তি আর অস্বস্তির কণা নিয়ে।'
কবি মোঃ সানাউল্লাহ-এর ৭ টি কবিতা কাব্য কৌমুদীতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি কবিতা ভাষা ও বক্তব্যই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনতায় তুলে এনেছেন। কবির ভাষায়,
'জন্ম না নিলে ধরায়, কি এমন হতো!
ধরণীটা তা'হলে কি রসাতলে যেতো?'
আর আমার লেখা ৫ টি কবিতা। সবগুলো কবিতাই কবিতার আসরে প্রকাশিত। নিজের ঢোল ফেটে যাওয়ার ভয়ে বাজানো গেলো না।
কাব্য কৌমুদীর সুযোগ্য কবি ও সঙ্কলকের ভাষায় বলেতই পারি,
' এই সংকলনের কবিবৃন্দ সৌখিন লিখিয়ে হলেও, অপটু নন। কবিতাগুলো গুণে মানে ও রসবোধে অনন্য। আশা করি কবিতা পাঠে পাঠক হতাশ হবেন না।'
ধন্যবাদ সকলকে।
মিরপুর, ঢাকা
০৬/১১/২০১৬