বন্ধুরা, ছন্দের খেলা নামে আগে চারটি পোষ্ট দিয়েছি। এবার বাংলা সনেটের একটি ধারণা তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো। যারা ছন্দ বিষয়ে আগ্রহী তাদের জন্য এ লেখা। যারা আগ্রহী নন, তারা পাশ কেটে যেতে পারেন। আবার, কেউ ইচ্ছে হলে, তার নিজের মেধা দিয়ে পোষ্টটিকে সম্মৃদ্ধ করলে আন্তরিক কৃতজ্ঞ থাকবো।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের একটি রূপ সনেট। বাংলা ভাষায় সনেটের উদ্গতা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি মূলতঃ ইতালিয় কবি 'পের্ত্রাকা'র কাব্য রীতি অনুসরণ করে নিরীক্ষামুখী কবিতা রচনা করতে গিয়ে সনেট লিখেন।
চৌদ্দ অক্ষরের চৌদ্দ চরণের কবিতা হলো সনেট। কেউ কেউ আঠারো অক্ষরেও লিখে থাকেন।

উদাহরণ-
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; -
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; -
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে -
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!"
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।

বঙ্গভাষা/ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সনেটে দু'টি ভাগে তার আবেগকে প্রকাশ করে।  অষ্টকে ভাবের আবর্তন এবং ষষ্টকে (কেউ কেউ 'ষটক'ও বলে থাকেন) ভাবের নিবর্তন বিধৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, অষ্টকে যে বক্তব্যের পরিবেশনা ঘটে; ষষ্টকে তার পরিপূরক আবেগের উপসংহার করা হয়।

সমুদ্রতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতন যেমন তাল-লয় নিরবচ্ছিন্ন, সনেটের ভাবতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতনও সেরূপ তাল-লয় নিরবচ্ছিন্ন।ফেনিলোচ্ছল সাগরতরঙ্গ যেমন ক্রমশ স্ফীত ও বর্ধিত হয়ে বেলাভূমির উপর আছড়ে পড়ে এবং নিমেষমাত্র স্থির থেকে আবার উজান বেগে সাগরগর্ভের দিকে ধাবমান হয়, সেরূপ ভাবের তরঙ্গ ছন্দোময়ী শব্দধারায় অষ্টকে উচ্ছলিত হয়ে বিপরীত নিবর্তনে ষষ্টকে অবসানপ্রাপ্ত হয়।

সনেটে বিবিধ অন্তমিল বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। যেমন,

ABAB :  ABAB :: CDECDE
ABAB : ABAB :: CDCDEE
ABBA : ABBA :: CDCDCD
ABBA : ABBA :: CDDCEE

ইত্যাদি ( আরো অনেক অন্তমিল বিন্যাস আছে)।

তবে, ১৪ পঙ্‌ক্তিযুক্ত এবং সনেটীয় অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতামাত্রই সনেট নয়। একটি কবিতাকে আদর্শ সনেট বলা যাবে তখনই, যখন এর ভাব-প্রবাহ সনেটীয় রীতিতে প্রবহমান থাকবে, এবং এর অন্ত্যমিলও সনেটীয় রীতি দ্বারা বিরচিত হবে।

ধন্যবাদ সবাইকে।