বন্ধুরা, পূর্বের দু'টি পোষ্টে ছন্দ সম্পর্কে একটু ধারণা তুলে ধরেছি। আজ মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ক্ষাণিকটা ধারণা তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মূলতঃ কবিপ্রিয় ছন্দ। স্বরবৃত্ত যেমন আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি; তেমনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মূল সংস্কৃত ছন্দের। এটাকে ধীর লয়ের ছন্দও বলা যায়। পূর্ণ পর্বগুলো সমপার্বিক এবং  অসম পার্বিক হতে পারে।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর সর্বদাই দুই মাত্রায় হিসেব করতে হয়। এ ছন্দ অনেকটা সুরাশ্রয়ী, তাই গীতি কবিতায় এর প্রয়োগ অনেক বেশি।
সাধারণতঃ ৬ মাত্রায় একটি পূর্ণ পর্ব হয়ে থাকে। এ ছাড়া ৪, ৫ বা ৭ মাত্রায়ও কবিতা লেখা হতে পারে।

কিছু উদাহরণ দিলে, আমরা সহজেই তার ব্যবহার বুঝতে পারবো।

এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

কবর / জসীম উদ্দিন

এইখানে তোর / দাদির কবর / ডালিম গাছের / তলে,
৬/৬/৬/২
তিরিশ বছর / ভিজিয়ে রেখেছি / দুই নয়নের / জলে।
৬/৬/৬/২

এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

দুইবিঘা জমি / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এ জগতে হায় / সেই বেশি চায় / আছে যার ভূরি / ভূরি,
৬/৬/৬/২
রাজার হস্ত / করে সমস্ত / কাঙালের ধন / চুরি।
৬/৬/৬/২


(সমপার্বিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ)

আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।

কুলি মজুর/ কাজী নজরুল ইসলাম।

আসিতেছে শুভ /দিন
৬/২
দিনে দিনে বহু / বাড়িয়াছে দেনা / শুধিতে হইবে / ঋণ।
৬/৬/৬/২


(অসম পার্বিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ)

৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-

ছিপখান / তিন-দাঁড় / তিনজন / মাল্লা
৪/৪/৪/৩
চৌপর / দিন-ভোর / দেয় দূর /পাল্লা।
৪/৪/৪/৩

দূরের পাল্লা/ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

৫ মাত্রার উদাহরণ-

তখনো ছিলো/ অন্ধকার/ তখনো ছিলো/ বেলা
৫/৫/৫/২
হৃদয় পুরে/ জটিলতার/ চলিতেছিলো/ খেলা
৫/৫/৫/২
ডুবিয়াছিলো/ নদীর ধার/ আকাশে আধো/লীন
৫/৫/৫/২
সুষমাময়ী/ চন্দ্রমার/ নয়ান ক্ষমা/হীন
৫/৫/৫/২

হৃদয়পুর / শক্তি চট্টোপাধ্যায়

৭ মাত্রায় লেখা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ-

তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়
৭/৭
লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি
৭/৭
বাগান জোত জমি/ সহজে সস্তায়
৭/৭
তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়
৭/৭

শোণিতে সৌরভ / আল মাহমুদ

অন্ধ রেল গাড়ি/ বধির রেলগাড়ি/ অন্ধ রেল বেয়ে/ চলছে দ্রুত বেগে
৭/৭/৭/৭
দু-চোখে মরা ঘুম/ আকাশে মরা মেঘ/ সঙ্গে মরা চাঁদ/ অন্ধ আছি জেগে
৭/৭/৭/৭
অন্ধ বগিগুলো/ ক্লান্ত হয়ে গেছে/ এগিয়ে চলে তবু/ অন্ধ প্রতিযোগী
৭/৭/৭/৭
চলছে ট্রাক বেয়ে/ জানে না কোথা যাবে/ নষ্ট রেলগাড়ি/ অন্ধদূর বগী।
৭/৭/৭/৭

অন্ধ রেলগাড়ি / হুমায়ুন আজাদ


(কোন অক্ষরে 'ৌ' (ঔ-কার) বা ৈ (ঐ-কার) থাকলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তার হিসেব দুই মাত্রার হবে)

এ ভাবে বিখ্যাত কবিদের বিভিন্ন কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করলে, আমরা ছন্দকে আরো গভীরভাবে বুঝতে পারবো আশা করি।

বিঃদ্রঃ  যারা ছন্দ বিষয়ে আগ্রহী তাদের জন্য এ লেখা। যারা আগ্রহী নন, তারা পাশ কেটে যেতে পারেন। আবার, কেউ ইচ্ছে করে, তার নিজের মেধা দিয়ে পোষ্টটিকে সম্মৃদ্ধ করলে আন্তরিক কৃতজ্ঞ থাকবো।