বাংলা-কবিতা’র কবি সম্মেলন ২০২০ শীর্ষক অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি, প্রধান অতিথি মহোদয়, বিশেষ অতিথিবৃন্দ, আমাদের আসরের সদস্যগণ সহ উপস্থিত সবাইকে আমার পক্ষ থেকে সালাম ও শুভেচ্ছা। আমার জানা মতে আজকের এই সম্মেলনে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে আমাদের কবিতার আসরের সদস্যগণ উপস্থিত হয়েছেন। পাশাপাশি ভারতীয় বন্ধু সহ অন্যান্য দেশ থেকেও নিবেদিতপ্রাণ সদস্যগণ এসেছেন, যা এবারের সম্মেলনকে নিঃসন্দেহে এক ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছে। শুধুমাত্র কবিতার টানে দূরত্বের সীমাকে অতিক্রম করে অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় করে এই যে আপনারা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছেন, তা কবিতার প্রতি ভালোবাসারই এক অনন্য উদাহরণ! আমি নিজেই এবার এই সীমাকে অতিক্রম করতে সমর্থ হইনি।

তবে আপনাদের মাঝে একজন হয়ে থাকতে না পারার খেদ এবার কিছুটা কম। কারণ আমি না থাকলেও আমার পক্ষ থেকে আমার শিকড় ও উৎস যাঁরা, আমার পিতা মোঃ সিদ্দিকুর রহমান এবং মা হেলেনা খানম আজ আপনাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। সেই শৈশব থেকেই আমার ছড়া-কবিতা লেখার আগ্রহ, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সবই আমি পেয়েছি আমার বাবা-মা তথা পরিবার থেকে।

বর্তমান বিশ্বে আমরা মানব জাতি নানা ভাবে বিভক্ত। দেশ বলুন, ধর্ম বলুন, ভাষা, রাজনীতি বা অর্থনৈতিক অবস্থান, সবই আমাদের নানা ভাগে বিভক্ত করছে। কিন্তু এগুলোর মাঝে একত্রিত হবার উপাদানও রয়েছে! যেমন আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, তারা যে দেশেই জন্মাই না কেন, কিংবা পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছড়িয়ে থাকি, আমরা সবাই বাঙালি। আমাদের প্রাণে আমাদের অনুভূতিগুলো একই ভাষায় দোলা দিয়ে যায়। আর কোনো সাহিত্য যখন এই ভাষায় কথা বলে, তখন তার অনুরাগীরা একে কেন্দ্র করে একত্রিতই হই, বিভাজিত না। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের বাংলা-কবিতা ডটকম প্লাটফরমটিও প্রকারান্তরে এই একত্রীকরণের কাজটি করে যাচ্ছে। হাজার মাইল দূরে থেকে, যাকে দেখিনি তাঁর কবিতা পড়ে তাকেও যেন আপন করে কাছে পাচ্ছি এই প্লাটফরমের মাধ্যমে। তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত এক আত্মিক বন্ধন! এই ওয়েবসাইটের প্রস্ততকারক ও এডমিন হিসেবে আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকবে এই প্লাটফরমে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার।

তবে আমি নই, এই সাইটের প্রাণ হচ্ছেন আপনারা সবাই, এর সদস্যগণ। আপনাদের সকলের সহযোগিতা ছাড়া লক্ষ্য অর্জন তাই কোনোমতেই সম্ভব না। আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, আমাদের এই কবিতা চর্চার প্লাটফরমটিকে নতুন বন্ধন তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করুন, ভাঙ্গনের নয়। কবিরা প্রচণ্ড অনুভূতিপ্রবণ। তবে তারা শান্তিপ্রিয়ও বটে! প্রয়োজনে যে কবির লেখায় যুদ্ধের দামামা বাজে, যুদ্ধ শেষে তার কবিতাই আবার শান্তির বাণী শোনায়। কবির কবি সত্ত্বা তৈরি হয় তার লেখার মাধ্যমে। চলুন, আমরা শুধুমাত্র সেই কবি সত্ত্বাটিকেই সর্বাগ্রে গ্রহণ করি, তার আড়ালের মানব সত্ত্বাকে নয়। আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ-সমালোচনা কেন্দ্রীভূত হোক কবিতাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু তা যেন রচয়িতার মানব সত্ত্বাকে আঘাত না করে। মত ও পথ ভিন্ন হলেও, নিজের মতকে সমুন্নত রেখেই আমরা যেন ভিন্নমতকে আমাদের পাশে স্থান দিতে পারি। অপরের কাছে মাথা নিচু না করেও অপরকে সম্মান দেয়ার বাণী তো কবিরাই শোনাবেন, তাই না?

কবিতার আসরের ভার্চুয়াল সম্পর্কের বাইরে এই যে আমরা নানা সম্মেলন ও মিলন-মেলায় বাস্তবেও একত্রিত হচ্ছি, এটা অবশ্যই আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করছে। আমাদের উচিত এর ভালো দিকটা গ্রহণ করা, এবং ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া। যেন ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করা সম্ভব হয়।

শৈশব থেকেই আমি ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু নিজেকে কবি বলতে এখনও ভয় পাই। জানি না আদৌ কবি হয়ে উঠতে পেরেছি কিনা। হয়তো কবি হতে হতে বাকি জীবন পেরিয়ে যাবে। তাই কবিদের এই সম্মেলনে কবিতা নিয়ে কিছু বলার দুঃসাহস আমার নেই। তারপরও আমার মতোই নবিশ যারা আজ এখানে আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু কথা বলতে চাই। কবিতা কি? নানা জনে এবিষয়ে নানা মত দিয়েছেন। আমাদের ২০১৮ সালের সম্মেলনে কবি ও গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেছিলেন “পাশাপাশি সাজানো কিছু শব্দের সমষ্টি যখন এমন অর্থ প্রকাশ করে যা শব্দের মূল অর্থকে ছাড়িয়ে যায়, তখন একটি কবিতা জন্ম নেয়”। অর্থাৎ, কবিতার অস্তিত্ব তার ভাষা-শৈলীতে। ভাষার ওপর ভালো দখলের কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য আমাদের বেশি বেশি খ্যাতিমান কবিদের কবিতা পড়তে হবে। বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কোন শব্দটা কিভাবে কবি ব্যবহার করেছেন। আমাদের আসরে খ্যাতিমান কবিদের চার হাজারের ওপর কবিতা সংকলিত আছে। তাই নতুন লিখিয়েদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আপনারা তাঁদের লেখা বেশি বেশি পড়ুন। অপর একটি বিষয় হচ্ছে বানান। খুব সুন্দর লেখাও ভুল বানানে পড়তে গেলে বারবার হোঁচট খেতে হয়। তবে আমাদের আসরের কবিদের এ থেকে উত্তরণের জন্য ইতিপূর্বেই আমরা আসরে যুক্ত করেছি বাংলা বানান যাচাইয়ের ব্যবস্থা। কবিতা জমা দেয়ার সময় লেখার নিচের বানান যাচাই করার বাটনে ক্লিক করে পুরো লেখার বানান ঠিক করে নিন। সম্পাদনার পাতায় গিয়েও তা করতে পারবেন। সত্যি বলতে অনলাইনে বাংলা বানান যাচাইয়ের ভালো কোনো ব্যবস্থা খুঁজে পাইনি। তাই নিজের মতো করে এই বানান চেকার তৈরি করতে হয়েছে। সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য এটি আমাদের অপর ওয়েবসাইট বাংলা-প্লাসেও (https://bangla.plus) দেয়া আছে। এই বানান চেকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একে আপনারা যতো বেশি ব্যবহার করবেন, সময়ের সাথে সাথে তা ততোই সমৃদ্ধ ও কার্যকর হবে।

কবিতার অপর যে বিষয়ে আমি আলোকপাত করতে চাই, তা হলো ছন্দ। কবিতায় ছন্দের প্রয়োজন আছে কি নেই তা নিয়েও নানা মতভেদ আছে। ছন্দ ছাড়াও একটি সার্থক কবিতা তৈরি হয়। তবে মানব ইতিহাসে হাজার হাজার বছর ধরে কবিতায় ছন্দের ব্যবহার চলে আসছে। তাই আমি মনে করি নিজের লেখায় ছন্দের ব্যবহার না করলেও একজন কবির ছন্দ সম্পর্কে জানাটা আবশ্যক। নিয়ম ভাঙ্গার আগে নিয়ম সম্পর্কে জানতে তো হবে! যারা জানেন, তারা ছন্দ, অন্ত্যমিল, মধ্যমিল, অনুপ্রাস এসব সম্পর্কে আমাদের আলোচনা সভায় লিখুন। ইতিমধ্যেই অনেকে এসব নিয়ে আগেও লিখেছেন। তাই যারা জানতে চান তারা আমাদের আলোচনা সভার শিক্ষামূলক লেখার পাতায় গিয়ে খুঁজে দেখতে পারেন সেসব লেখা।

আপনারা আসরে কবিতা লেখার, পড়ার, মন্তব্যের ও আলোচনার সব ব্যবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করুন। আরও কি কি ফিচার থাকলে ভালো হয় তা জানান। আপনাদের সবার পরামর্শেই নিয়মিত এই ওয়েবসাইটে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এভাবেই হয়তো এটি একসময় আরও কার্যকর এক প্লাটফরমে পরিণত হবে।

যাক, আপনাদের মাঝে উপস্থিত না হয়েও আপনাদের বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম আমি। আমাকে এই সুযোগ দেয়ার জন্য উপস্থিত সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের, যারা নিরলস ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকের এই অনুষ্ঠানটি সম্ভবপর করেছেন।

আপনাদের বাকি দিনটুকু কাটুক কবিতার দোলায় দোলায়, শব্দের আবেশে। এই কামনায় আজকের মতো আমি বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকবেন সবাই।