পড়ন্ত বিকেল বেলা, একা বসে আমি ভেবে যাই
অতীতের জীবনের কথা, জানালার পাশে বসে।
মেঘলা আকাশে দেখি আলোকের বিচ্ছুরণ নাই;
তবুও, একেলা বসে আছি ম্রিয়মাণ মোহবশে।
অপ্রকাশিত কত কি অবান্তর ভাবি নিরন্তর,
কী অবলীলায় ভেঙ্গে গেলো সাজানো গোছানো ঘর!
নিলামে বিকিয়ে দেই এই জীবনের পরমাই,
চাই না জ্বালাতে দীপ আকাঙ্ক্ষার পাথরকে ঘসে।
এই পড়ন্ত বিকেলে সেই কথা একা ভেবে যাই,
কাঁচের শার্সিতে ঢাকা জানালার পাশে একা বসে।

দূরে কোথাও পাখির শব্দ শুনি, সূর্যের আলোয়
আকাশের মেঘগুলো আরো বেশি রঙিন, উজ্জ্বল
হয়ে ওঠে; জানি, কিছুক্ষণ পরে নিকষ কালোয়
ঢেকে যাবে সমস্ত পৃথিবী; রবে না এতো নির্মল।
সমুদ্রের অন্ধকার নক্ষত্রের জোছনায় ভেসে
যাবে অন্তহীন চরাচর, কোন দূরলোক দেশে।
হৃদয়ে মৃত্যুর গন্ধ পাই জাগে না ক্ষাণিক ভয়,
পৃথিবীর এ জীবন বিদায়ের জন্য হয়েছে চঞ্চল।
এইক্ষণে, ভালো লাগে না থাকতে সূর্যের আলোয়,
দেখে শুনে, পরিশেষে বুঝে গেছি, মৃত্যুই উজ্জ্বল।

কোন দূর পারাবারে মুরালি বাঁশিতে বেজে উঠে
বিমর্ষ গানের সুর! চেয়ে দেখি, সায়াহ্নের আলো
হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে; অতঃপর, দ্রুত ছুটে
অজানার অন্ধকারে, ভাবি আমি; তবুওতো ভালো।
যন্ত্রণার জ্বালা নেই, নেই প্রতিদিন জ্বলে যাওয়া;
কোন এক বিচিত্রধারার পরম সুখ পাওয়া।
অনন্য মৃত্যুকে ধরে রাখি জীবনের করপুটে,
সযত্নে বুকের মাঝে; দেখি দূরে নক্ষত্র পালালো।
দূর পারাবারে শুনি করুণ রাগিনী বেজে উঠে,
বিমর্ষ গানের সুরে, নিভে যায় সায়াহ্নের আলো।

হয়তো কোথাও জেগে আছে শিল্পীত শান্তির মেয়ে,
স্বস্তির পসরা নিয়ে অন্ধকারে, কোন এক ঘরে।
আমি ছুটে চলি দ্রুতবেগে অন্তহীন ক্ষুধা লয়ে
তুমুল স্রোতের বিপরীতে, ভাসমান তুচ্ছ তৃণ ধরে।
কালস্রোতে কেটে যায় দিবারাত্রি বাসনাবিহীন;
এই সত্তার নিজেকে মনে হয় চির-অর্বাচীন।
ক্লান্ত মানুষের মতো আকাশের দিকে থাকি চেয়ে,
কালোমেঘ ঝরে যায়, বৃষ্টি নামে মাটির উপরে।
কিন্তু, ফিরে আসে নাকো আর শিল্পীত শান্তির মেয়ে,
পড়ে থাকি নিঃশব্দের অন্ধকারে, খিলবদ্ধ ঘরে।

এমন জীবন মানে- পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা
ঝরা বকুলের মতো, অবহেলা অপমান সয়ে।
নিজের সঞ্চিত সহজাত গন্ধটুকু ধরে রাখা,
আপন রঙের উজ্জ্বলতা পরিহারে, ম্লান হয়ে।
যতো দেখি, যতো শুনি; ততো বেশি বারে বিহ্বলতা,
ততো ম্রিয়মাণ হয় আকাঙ্ক্ষার জীবনের কথা।
চারিদিকে শুনি আজ তীব্র বিরহের দুঃখমাখা
সংগীতের করুণ রাগিনী চরাচরে যায় বয়ে।
জীবনের মানে, যে কোনরকমভাবে বেঁচে থাকা,
অবাঞ্ছিত, অযাচিত অপমান, অবহেলা সয়ে।

আকাশের সীমানার শেষে এসে দাঁড়িয়েছি একা;
কেউ নেই, কিছু নেই; চারিদিকে ধূ-ধূ বালুচর।
সঙ্গীহীন মানুষজীবন, এ কি কপালের লেখা!
ঘরের প্রত্যাশা করি; তবুও যে, ভেঙ্গে যায় ঘর।
কতোকাল কেটে যাবে এ জীবন নিঃসীম আঁধারে,
নিঃসঙ্গ পাখির মতো একা একা, জঙ্গলে-বাদারে?
মানুষজীবনে পৃথিবীতে কিছুই হলো না দেখা;
যাকে ভেবেছি আপন মর্মমূলে, সে-ই হলো পর।
জীবনের সীমানার শেষে এসে, বুঝি, একা একা
হেঁটে যাবো দীর্ঘপথ, সম্মুখে শুধুই বালুচর!

এ সংসার ভালোবেসে করেছি কতোই ছলাকলা!
ভবিষ্যত-কথা ভুলে, উর্ধ্বশ্বাসে আপ্রাণ ছুটেছি
আপনার মোহবশে। ভাবিনি কখনো, পথ চলা
শেষ হবে; সংসারের মায়াবশে শুধুই লুটেছি।
সমুদ্রের তুমুল গর্জন শুনি, ডাকিছে আমায়-
'দেহের উষ্ণতা ছেড়ে জলের বক্ষেতে ফিরে আয়'।
একেবারে যেতে হবে, স্তব্ধ হবে সব কথা বলা,
সায়াহ্নের এই গোধূলি বেলায়, এখন বুঝেছি
সংসারের মোহজালে যতোই করো না ছলাকলা,
সবকিছু ব্যর্থ হবে, বুঝে যাবে অনর্থ ছুটেছি।

বিশ্বাসের হাত রেখে হাতে, বলেছিলাম তাহাকে-
'শুধু ভালোবাসা দিও; কখনো করো না অবহেলা।
চিরদিন পাবে দাসানুদাসের রূপে, এ আমাকে;
কারণ, অনেক কষ্টে কেটে গেছে অতীতের বেলা'।
মোহভর্তি তাহার হৃদয়, রাখেনি সেসব কথা,
তাই বুঝি, বেড়ে গেছে ক্রমে জীবনের ব্যাকুলতা?
সেইহেতু, বিষন্ন হৃদয়ে চিরমুক্তি দিয়ে তাকে,
অজানা গন্তব্য পানে ভাসিয়েছে জীবনের ভেলা।
তাই, এ বিমর্ষক্ষণে আমি আর ডাকি না তাহাকে,
যন্ত্রণা দেয় না সেইসব অপমান অবহেলা।

যখন বিচিত্রভাবে চলে যেতো রৌদ্রের ভেতরে
আমাদের শতাব্দীর নিরুৎসুক অভীষ্ট সময়।
তখন সত্যের স্বাভাবিকতার সুর বুকে ধরে
চেনা পথে হেঁটে গেছি; ছিলো বিশ্বাসের বরাভয়।
এখন ক্ষাণিক ভুল হলে দেখি, সাপেদের মতো
ফোঁসফোঁস করে ওঠো নিত্য, অকারণে অবিরত।
ভয়াবহ অবহেলা, সীমাহীন বিষাক্ত অন্তরে
ছুঁড়ে দাও অহর্নিশ; এ অন্তর পুড়ে ছাই হয়।
নবীন আহ্লাদে ফের ছুটে চলি রৌদ্রের ভেতরে,
যদিও জানি না, ফিরে পাবো কি না অভীষ্ট সময়।

অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছে
বসন্তের মতো, গ্রীষ্মের প্রবল তাপে, অন্যলোকে।
মানবিক সমাজ-দর্শন-তত্ত্ব সকল নিয়েছে
কেড়ে, সংকল্পের কঠিন বন্ধন ছিঁড়ে; কাঁদি শোকে।
নাগরিক জীবনের হা-হুতাশ এসে ভিড় করে
নিত্য, সারিবদ্ধভাবে; মোহগ্রস্ত তোমার অন্তরে।
এখন নিরলে অবসরক্ষণে ভাবো, কী পেয়েছে
উদ্যত হৃদয়, পৃথিবীতে? কতোটুকু আছো সুখে?
দেখো, কি অবলীলায়! দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছে
অতি দ্রুতবেগে, অজানায়; কোন এক অন্যলোকে।

প্রতিবাদী সুর তুলে সত্য কথা করিলে প্রকাশ,
লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মানুষের সমাজ-সংসার।
তাই, চুপচাপ থাকি; নিরিবিলি ফেলি দীর্ঘশ্বাস,
নিয়তির খেলা ভেবে ভুলে যাই সব অহংকার।
কষ্ট পাই, ঘুরপাক খেয়ে যাই অন্ধকার বৃত্তে,
সাগরের ঊর্মিজল দোলে ওঠে দোটানার চিত্তে।
মরণসিন্ধুর দিকে ছুটি, ছেঁড়ে ব্যাসন-বিলাস,
পৃথিবীতে এই ছিলো অদৃষ্টের কপাল আমার!
সযতনে বন্দি রাখি সব সত্য, করি না প্রকাশ,
হৃদয়বিহীনভাবে ঠিক থাকে সমাজ-সংসার।

আজ কোন পরোয়া করি না- মৃত্যু অথবা জীবন!
আগামীর চিন্তা নাই, অতীতের কোন ক্ষোভ নাই;
চলমান বর্তমানে এ জীবন যেখানে যেমন
চলে যাক অন্তহীন বিশ্বপাড়ে, কিছু নাহি চাই।
স্বপ্ন ফুরিয়ে গিয়েছে অন্ধকার গহীন অতলে,
শুকনো পাতার মতো উড়ে উড়ে দূরে যায় চলে।
রাতের গহীনে ভাবি, এ জীবন কেনো যে এমন!
হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার সব কথা হয়ে গেলো ছাই।
পরোয়া করি না আমি, নিয়ে এই মানুষজীবন,
এখন নিঃসঙ্গতায় আর কোন দুঃখ-ক্ষোভ নাই।

ক্লান্ত-শ্লথ পায়ে হাঁটি, গন্তব্য অজানা; নিরাশার
দোলাচলে কেটে যায় রাত্রিদিন- প্রচুর সময়।
পৃথিবীর শস্যক্ষেত্রে হানাহানি চলে বেশুমার,
সুবোধেরা পালিয়ে বেড়ায়, অসুরেরা জেগে রয়।
ঘুমিয়ে যাবার আগে, একবার দেখে যেতে চাই
স্বস্তির পৃথিবী। প্রভু! অতোটুকু দাও পরমাই।
সোনার বাংলাদেশের চারিদিকে দেখি, অন্ধকার!
দেশপ্রেমিকেরা জেগে এ আঁধার কাটবে নিশ্চয়।
খিলবদ্ধ ঘরে আর ছবি আঁকবো না নিরাশার,
অন্ধকার যতো নামে, দ্রুত আসে আলোর সময়।

০৬/০৪/২০২৫
ঢাকা।