বই পরিচিতিঃ
বই এর নামঃ চতুষ্কোণ, কবিতার বই
লেখকের নামঃ কেতন শেখ
প্রকাশকের নামঃ রাজিয়া রহমান
জাগৃতি প্রকাশনী
৩৩, আজিজ সুপার মার্কেট, নীচতলা
ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ আফরিনা ওশিন
উৎসর্গঃ নাঈমা পারভীন

কবি পরিচিতিঃ
কবির কথাতেই- “মন যেভাবে বলে, কেতন শেখ সেভাবেই লেখেন। কখনও তা কবিতা হয়, কখনও অন্যকিছু”। কেতন শেখের জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়। স্কুলজীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। যথাক্রমে আলীগড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এবং বর্তমানে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টমিনস্টারে অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। শিক্ষা ও অর্থনীতির গবেষনায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ কমনওয়েলথ স্কলারশীপ ও ওয়ার্ল্ড বিজনেস ইন্সটিটিউট ফেলোশীপে। কর-নীতি এবং কৃষি ও উন্নয়ন অর্থনীতির উপর লেখা তাঁর বেশ কিছু গবেষনাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বমানের একাডেমিক জার্নালে। জাগৃতি প্রকাশনী থেকে তার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এর পরের বছরগুলোতেও জাগৃতি ছাড়াও অন্য কয়েকটি প্রকাশনী থেকে তার কয়েকটি গল্প, কবিতা এবং উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রবাস জীবনে তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সমাদৃত হয়েছেন। স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে তার সুখের সংসার।

আলোচনাঃ
কবি খুব চমৎকার একটা ভূমিকা দিয়ে তার বই শুরু করেছেন। এত অল্প কথায় শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে মনের কথাগুলো সবাইকে এতটা গুছিয়ে বলে যেতে পারেন খুব কম লেখকই। বইটির কবিতাগুলো মোট চারটি আলাদা আলাদা বিভাগে বিভক্তঃ অনুরাগ, রমণী, বিষাদ ও মনন। যদিও, একজন পাঠক হিসেবে আমার পছন্দ ও ভাল লাগার ক্রমানুযায়ী বিভাগগুলো এভাবে বিন্যস্ত হতোঃ রমণী, অনুরাগ, মনন ও বিষাদ।

অনুরাগঃ
বই এর প্রথম কবিতা “প্রেমবাণ” পড়ে আমি একান্তে কিছুক্ষণ হেসেছি। মনে হয়েছে, কবির শিরোনামটি যথার্থ হয়েছে। প্রেয়সীর প্রতি তিনি এ কবিতায় যে অভিপ্রায় ও প্রত্যাশাগুলো নিবেদন করেছেন, আশাকরি সে কথাগুলো প্রেমের বাণের মতই তার প্রিয়তমার অন্তরে গেঁথে রবে চিরকাল। "সওগাত" কবিতায় তিনি প্রেমের সওগাত পাঠিয়েছেন। কবিতার শেষের স্তবকটা পাঠকের মনে কবির প্রতি এক ধরণের মায়া ধরিয়ে যায়। অবদমিত বাসনার চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটেছে তৃতীয় কবিতা "অভিষবণ" এ। শিরোনামের শব্দচয়ন উপযুক্ত ও যথার্থ হয়েছে। আমার মনে হয়, এ বিভাগের সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটি "দাদন"। চমৎকার ছন্দে প্রেমানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে কবিতায়। "সরোদ" কবিতায় কবি সরোদের সুরের সাথে প্রেমাকাঙ্খার তুলনা করেছেন। সুরকার কবির এ তুলনাটা সহজবোধ্য হয়েছে। "চিত্রকর" কবিতায় কবি একজন দক্ষ চিত্রকরের মতই মনের ইচ্ছেগুলোকে এঁকে গেছেন। বয়স্ক প্রেমিক প্রেমিকাদের মনের আবেগ অনুভূতিগুলো কবি সুনিপণভাবে বাস্তবতার আলোকে প্রকাশ করেছেন "সায়াহ্ন" কবিতায়। "বিনিদ্র" কবিতার শেষ দুটো স্তবক এবং "সুরসিক প্রেম" ও "অনুলেহ" কবিতার কয়েকটি স্তবক খুব সুন্দর হয়েছে। "বাসর" কবিতায় বিবৃত কল্পনায় সাজানো বাসর কাব্যও ভাল লেগেছে। তবে এ বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কবিতা "অনাদায়ী সুখ"। কবিতার সুন্দর ছন্দ আর ভাবের স্বচ্ছ অভিব্যক্তি পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। যে সুখের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবার সম্ভাবনা নেই, সে সুখ তো অনাদায়ীই বটে!

রমণীঃ
এ বিভাগের চারটি শ্রেষ্ঠ কবিতা যথাক্রমে পৌরুষ, বন্ধুবরেষু, মনমিতালী আর মেঘমন্দ্র। যে পুরুষ পতি প্রতাপ ভুলে বন্ধু, সাথী হবে, “তারেই নারী করবে পুরুষ হৃদয় দুয়ার খুলে” – কবির অনুধাবিত এ ধারণার সাথে দ্বিমতের অবকাশ নেই। "বন্ধুবরেষু" একটি মায়া জাগানিয়া কবিতা। প্রেমিকরা আদিকাল থেকেই যুগান্তরব্যাপী বোকাই থেকে গেছে। মনমাতানো ছন্দ আর স্ফটিকস্বচ্ছ অভিব্যক্তির কবিতা "মনমিতালী"। “ভালবাসা থাক সাথে, কেউ না জানুক আমরা জানি কার কী ক্ষতি তাতে?”- শেষের স্তবকের এ কথাগুলো ভাল লেগেছে। "মেঘমন্দ্র" কবিতার ভারিক্কি শিরোনামের সাথে কবিতার কথামালা সাযুজ্যপূর্ণ। এর পরেই স্থান পাবে "বিরহিণী" নামের চমৎকার, মায়াময় কবিতাটি। এ বিভাগের অন্যান্য কবিতাগুলোও উচ্চমানসম্মত।

বিষাদঃ
এ বিভাগের শ্রেষ্ঠ কবিতাটির নাম "রোমন্থন"। সুন্দর ছন্দে ব্যক্ত হয়েছে জীবন শকটের ব্যাকসীটে বসা প্রেমের অবস্থান পরিবর্তনের কথা। তার পরে আসে "নাগরিক নির্বাসন" কবিতাটি। প্রকৃতি আর মানব সন্তানের মাঝে সখ্যতা প্রাচীন। কিন্তু প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে মানব সন্তানের হাল আমলের নাগরিক জীবনাচার তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। বেদনার কথা, ঝরা সুখের গল্পের কথা বলা হয়েছে "ঝরিত সুখের গল্প" কবিতায়। কালীগঙ্গা কবিতায় কবি তার ছেলেবেলায় দেখা কালীগঙ্গা নদীর স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবেঃ “সেই ছেলেবেলা থেকে তার ডাক শুনছি, আমার সাথে বড় না হয়ে দিন দিন ছোট হচ্ছে নদীটা”। এ বিভাগের বাকী কবিতাগুলোকে আমার কাছে গড় মানের মনে হয়েছে।

মননঃ
এ বিভাগের "অমূর্ত" কবিতাটিকেই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। বই এর সর্বশেষ কবিতা "একরারনামাও" খুব ভাল হয়েছে। এ ছাড়া চতুষ্পথ, নক্তচারী, টুথপেস্ট কবিতাগুলোর প্রতিটির শেষ স্তবক ভাল লেগেছে।
"অধমর্ণ" কবিতার শিরোনামটি তাৎপর্যপূর্ণ, ভাল লেগেছে। "নিরুত্তর" কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে, এমন প্রশ্নে নিরুত্তর থাকাটাই স্বাভাবিক। বাকী কবিতাগুলোও ভাল লেগেছে।

এ বই এর কবিতা পড়তে গিয়ে অনেকগুলো নতুন, অপরিচিত বাঙলা শব্দ পেয়েছি, যেগুলোর মানে আন্দাজ করতে পারলেও সঠিক অর্থ জানা ছিলনা। প্রায় প্রতিটি অজানা শব্দের অর্থ জানতেই অন লাইন অভিধান খুলেছি। শব্দগুলোকে আপাতঃ দৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও, অভিধান ঘাটার পর সহজ এবং যথোপযুক্ত মনে হয়েছে। তবে কয়েকটা শব্দের অর্থ শেষ পর্যন্ত অজানাই থেকে গেছে কারণ সেগুলোকে অন লাইন অভিধানে পাইনি। হয়তো হার্ড কপিতে পাওয়া যেত, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, রিভিউ লিখতে গিয়ে অতটা মেহনত করতে ইচ্ছে হয়নি।

এ বইটি জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল থেকে কিনে যখন কবির অটোগ্রাফ চাইলাম, তিনি তাতে লিখে দিলেন, “খায়রুল ভাই আর ভাবীকে কাব্যময় শুভেচ্ছা”, নীচে স্বাক্ষর। আর মুখে বললেন, “Something tells me, you’ll like it”. কবি ঠিকই বলেছেন, তার এ বই এর কবিতাগুলো আমি খুবই ‘লাইক’ করেছি। বইটি স্বমহিমায় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে, এ প্রত্যাশা রাখি।

সামগ্রিক মূল্যায়নঃ ১০ এর ভেতরে ৭.১


ঢাকা
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭