এখন থেকে প্রায় একষট্টি বছর আগে কোন এক শীতের বিকেলে অগ্রহায়নের শেষ দিনে, এক রোববারে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীতে আমার জন্ম হয়। এমনিতেই ছোট দিন, তখন দিনেরও প্রায় শেষ, নামাজীরা আসর এর  নামাজ পড়ে মাসজিদ থেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। ক্লান্ত সূর্য্টা দিগন্তে রক্তিমাভা ছড়িয়ে অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পাখিরা ঘরে ফেরার। এমনি এক সময়ে আমি দিনের শেষ আলোটুকু ধরার জন্যই যেন পৃ্থিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ হ’লাম। পুরো জীবনটাকে যদি একটা দিন হিসেবে ধরি, তবে বলা যায়, আমার জন্মের সময় যেমন পড়ন্ত বিকেল ছিলো, আজও এখন এই লেখাটা লেখার সময় আমি যেন জীবনের সেই পড়ন্ত বিকেলেই উপনীত। কর্মময় জীবন শেষ করে অবসর জীবনে এসে সুযোগ হচ্ছে পিছু ফিরে তাকাবার। জীবনের নানা বাটে ঘাটে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধ দর্শনকে স্মরণ করে বিদগ্ধ পাঠককূলের সাথে আমার হৃদয়ের  অনুভূতিগুলো শেয়ার করার মানসে শেষ বিকেলে কিছু লেখালেখি শুরু করেছি।

খুবই সংক্ষেপে বলছি। আমি আজন্ম অনুসন্ধিৎসু। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয়, অকাজে। তা না হলে আমার মনে যত জিজ্ঞাসা ছিল, নিষ্ঠার সাথে সেগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করে গেলেতো আজ নির্ঘাত এক মস্ত বিজ্ঞানী হয়ে উঠতাম, নইলে কোন দার্শনিক, নইলে বড় কোন লেখক। তবে দিনশেষে ওসব কিছুই হয়ে উঠিনি। আমি এ আসরের বেশীরভাগ কবি আর আলোচক/লেখকদের মতই একজন অতি সাধারণ কবিতা প্রেমিক, কবিতা রচয়িতা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, কবি হিসেবে সম্বোধিত হবার সময় এখনো আসে নি, হয়তো আর আসবেও না।

শৈশব আর বাল্যকালে খুবই লাজুক ছিলাম। তবে তখন থেকেই নিজের মধ্যে এক সংবেদনশীল মন ধারণ করতাম। আর নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধেও খুব ছোটবেলা থেকেই সচেতন হতে শিখেছিলাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। তাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার সাথে বেশ ভালভাবে পরিচিত। এখানে এই স্বল্প পরিসরে জীবনের সব কথা বলা সম্ভব নয়। যারা আমার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হবেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আমি সামহোয়্যার ইন ব্লগে “আমার কথা” নামে একটি সিরিজ লিখে চলেছি। সেখানে অল্প বিস্তর ডিটেলস সহকারে জীবনের কথা বলে যাচ্ছি। এ আসর ছাড়াও আমি অন্য একটি কবিতার আসরে কবিতা লিখে থাকি। আর সামহোয়্যার ইন ব্লগ ছাড়াও ক্যাডেট কলেজ ব্লগেও আমি লিখে থাকি। সব জায়গাতেই আমি স্বনামে লিখে থাকি। ছদ্মনাম গ্রহণের কোন আগ্রহ আমার কোনকালেই ছিলনা, এখনো নেই। তবে যারা ছদ্মনামে লিখে থাকেন, তাদের ছদ্মনামে লেখার স্বাধীনতার ব্যাপারে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কারণ, অনেকেরই ছদ্মনামে লেখার অনেক কারণ থাকতে পারে। আর তাছাড়া বড় বড় অনেক প্রথিতযশা কবি লেখকগণও তাদের জীবনে কখনো না কখনো ছদ্মনামে লিখে গেছেন।

পেশায় আমি একজন সামরিক অফিসার ছিলাম। আমার স্কুল আর কলেজ জীবন কেটেছে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে। আমাদের সময় এই ঐতিহাসিক নামেই সেই বিদ্যাপীঠটা স্বনামধন্য ছিল। পরবর্তীতে আঞ্চলিকতার কুফলে এই সুন্দর নামটা পরিবর্তিত হয়। আমরা কলেজ ত্যাগ করার কয়েক বছর পর একদিন জানতে পারলাম, কলেজটাকে এখন থেকে 'মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ' নামে ডাকা হবে। সেই থেকে এটা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ নামে পরিচিত। কলেজ জীবন শেষ করার পর বুয়েটে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। সাথে সাথে সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হবার জন্য আইএসএসবিতেও উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বিএমএ তে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেই। সেটা ছিল আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।  

সেনাবাহিনীতে থাকার কারণে আমি দেশের বিভিন্ন দূর্যোগের সময় জনসেবার সুযোগ পাই।এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর শীতকালীন অনুশীলনের সময় জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হতো। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আমি ওমান সালতানাতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব (শ্রম) হিসেবে কর্তব্য পালন করি। তখন দেখেছি বাঙালীরা কিভাবে নানাকারণে দূর্ভোগ আর হেনস্তার শিকার হতো। সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছি তাদেরকে সাহায্য করার, নির্ধারিত অফিস সময়ের অনেক পরেও তাদের জন্য কাজ করতাম। আমি ওমানে যাবার সময় বাঙালীর সংখ্যা যা ছিল, আমি আসার সময় তার প্রায় পাঁচগুণ বেশী রেখে এসেছিলাম। ২০০১ সালে আমি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে এনডিসি কোর্স সম্পন্ন করি। ঐ কোর্সে আমার লেখা দুটো পেপারই দুই বিভাগে “বেস্ট পেপার এ্যওয়ার্ড”  পেয়েছিলো। একটা রিসার্চ পেপার, অন্যটা পলিসি পেপার। ১৯৭৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জীবনের ৩১ টা বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন করে ২০০৭ সালের ০১ জানুয়ারী সম্মানের সাথে কর্ণেল পদবীতে স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করি। অবসর গ্রহণের পর কিছু সমাজকল্যাণ মূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়েছি। এ সম্পর্কিত দুটো ক্ষুদ্র সাফল্যের কথা এখানে জানা যাবেঃ
http://www.somewhereinblog.net/blog/KA13/30080558

ছাত্র জীবনে কিছু লেখালেখি করতাম। আমি আমার কলেজ ম্যাগাজিনের ইংরেজী সেকশনের সহকারী সম্পাদক ছিলাম। সম্পাদক ছিলেন কলেজের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক। সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন এই ৩১ বছর লেখালেখির কলমটাকে একেবারে বন্ধ রেখেছিলাম। অবসর গ্রহণের কয়েক বছর পর নিজের জন্মদিনে একদিন স্রষ্টাকে যখন কৃ্তজ্ঞতাভরে স্মরণ করছিলাম, তখন হঠাৎ ভেতর থেকে এক কবিতার উদগীরণ হলো। সেই থেকে পুনরায় সাহিত্যচর্চা শুরু। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হতে পারে, তবে মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। আমি ইংরেজীতেও কবিতা লিখে থাকি। ইংরেজী কবিতার আসর “পোয়েমহান্টার” এ আমি নিয়মিত লিখে থাকি। সেখানে কবিতা লেখার মাধ্যমে কবি রূমা চৌধুরীর সাথে পরিচিত হই। তিনি এই আসরেরও একজন বিশিষ্ট কবি। তাঁর হাত ধরেই আমার এখানে আসা।  

ব্যক্তিজীবনে আমি তিন সন্তানের জনক। আমার বড় দুই ছেলে আইবিএ থেকে বিবিএ এবং এমবিএ পাশ করে  এখন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত। তৃতীয় ছেলে মূলতঃ তড়িৎ প্রকৌশলী হলেও, সেও এখন আইবিএতে এমবিএ করছে এবং সাথে সাথে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরীও করছে। ওরা তিনজনই বিবাহিত ও প্রতিষ্ঠিত, তাই বলা যায় যে আমি এখন পরিবারের বাইরেও কিছু দায়িত্ব পালন করার জন্য মনোনিবেশ করতে পারি। এজন্য স্রষ্টার প্রতি আমি সর্বান্তঃকরণে কৃতজ্ঞ। আমার বড় ছেলে ১৯৯৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে (তথা দেশের সকল বোর্ড মিলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে) মানবিক শাখার মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। আর তার স্ত্রী (একই ব্যাচের) ২০০১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মানবিক শাখায় দেশের সকল বোর্ড মিলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। পড়াশোনায় আমার ছেলেদের সাফল্যের কৃতিত্ব অনেকটাই তাদের মায়ের। তিনি তাদের পড়াশোনার প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও আপোষহীন ছিলেন। আমিও ছোটবেলায় ওদেরকে অল্প স্বল্প পড়িয়েছি, যেমন আমাকে আমার আব্বা আর আমার আব্বাকে আমার দাদা পড়িয়েছিলেন।

বাংলা কবিতার আসরে আমি এপার ওপার উভয় বাঙলার নানা বয়সের কিছু ভালো বন্ধুর সাহচর্য পেয়ে ধন্য। আমার মতে নিঃসন্দেহে এ আসরটা খ্যাত অখ্যাত সকল কবিদের জন্য একটা অভয়াশ্রমের মত। দুনিয়া জুড়ে এ আসরের কবিদের বসবাস। আপনাদের সহমর্মিতা, দোয়া আর শুভকামনা আমাকে আপ্লুত করে। নাম নিতে গেলে স্মৃতিভ্রমের কারণে বিড়ম্বনা হতে পারে। তাই বিশেষ কারো নাম না নিয়েই বছরের শুরুতে আপনাদের সবাইকে অন্তর থেকে শুভকামনা জানিয়ে আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি। যারা আমার কবিতায় মন্তব্য করে, সমালোচনা করে, প্রশংসা করে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তাদের নাম এ হৃদয়ের মনিকোঠায় সর্বদাই জ্বলজ্বল করে জ্বলবে।  

লেখাটা বোধহয় একটু বেশী দীর্ঘ হয়ে গেলো। অতিকথন হয়ে থাকলে নিজগুণে মার্জনা করে দেবেন।

ঢাকা
০৩ জানুয়ারী ২০১৬