কবি ও সঙ্গীতশিল্পী ইতি ইব্রাহিম এর সাংস্কৃতিক জীবন


শিল্পী ইতি ইব্রাহিম এর গ্রামের পাশে যে নদী সেখানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়েছেন, গড়াই-পদ্মা নদীর তীরে । তার লেখায় বহুবার এ নদী দুটির প্রসঙ্গ এসেছে। গড়াই নদীকে কবি লিখতেন গৌরী নামে। আবার কখনো কখনো গোড়াই নামেও লিখেছেন তার কবিতায়। গড়াইয়ের নদীতীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে অত্যন্ত নান্দনিকভাবে:

গোড়াই নদীর চর

নূতন ধানের আঁচল জড়ায়ে ভাসিছে জলের পর
একখানা যেন সবুজ স্বপন একখানা যেন মেঘ
আকাশ হইতে ধরায় নামিয়া ভুলিয়াছে গতিবেগ... ... ... ...
দুপুরের রোদে আগুন জ্বালিয়া খেলায় নদীর চর
দমকা বাতাসে বালুর ধূম্র উড়িছে নিরন্তর
রাতের বেলায় আঁধারের কোলে ঘুমায় নদীর চর
জোনাকি মেয়েরা স্বপনের দীপ দোলায় বুকের পর।


কবি রবীন্দ্রনাথ, উনার কবিতায় আঁধার আলোকিত করার যে জোনাকি মেয়েদের কথা বলেছেন হয়তো সে রূপেই জন্ম
একবিংশ শতাব্দীর তরুণ আইডল শিল্পী ইতি ইব্রাহিম।


যখন প্রথম ইতি ইব্রাহিমকে আবিষ্কার করি

আমি যখন কবিতা লিখি বা কোনো কিছু লিখবো বলে সময় খুঁজি, তখন মধ্যরাতটাকে বেছে নিই, এটা ছোটবেলা থেকে বর্তমান পর্যন্ত  জীবনের একটা মুদ্রাদোষও বলা যেতে পারে। তবে চারদিক নিরব এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলে ধ্যান বিধ্বংস হবার সম্ভাবনা কম থাকে, তাই মধ্যরাতে লিখতে পছন্দ করি। যদি কোনো দিন লিখতে না পারি তো সেদিন গান শুনতে শুনতে সময় কাটাতে হইতো।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তেমনি এক  ঝড়ো বৃষ্টি রাতের দ্বিতীয় প্রহরে যখন...

"থাক থাক তোরা জাত কূল লয়ে
আমি যাই চাঁদ গৌর বলে।
আমার দুঃখ বুঝবিনা রে
এক মরণে না মরিলে"।।

'লালন সাঁই' এর এই পদ গুলো শুনছিলাম, এবং যিনি গাইছিলেন উনার মধুমোহ সুর, এবং বিসর্জনে ব্যথিত গৌরীর ব্যাকুলতা মাখা কণ্ঠ শুনে একরকম চমকে উঠেছিলাম, এভাবেও কেউ গাইতে পারে! আর আমার একটা অভ্যাস হচ্ছে যাকে ভালো লাগে তাকে পাঠ করতে চাই, সেদিন রাতে নেটে সমস্যা থাকার কারণে শিল্পীকে নিয়ে আর তেমন কিছু জানা হলো না, পরেরদিন আর কোনো তথ্য না পেলেও ভিডিওতে শিল্পীকে দেখার পরে, উনার পরিধানরতো সাদা শাড়ী, ধ্যানমগ্ন গায়নশৈলী এবং আবেগপ্রবণ সুরের যে মায়াকরী মাধুর্য, একজন গান পাগল মানুষের হৃদয় চিঁড়ে আসন পেতে বসতে এর থেকে বেশি কিছু লাগে বলে মনে হয়না। যদিও তখন অনুমান করেছিলাম হয়তো লালনভূমিকন্যা। এর থেকে বেশি শিল্পী সম্পর্কে আর কিছু জানা হয়নি। চেষ্টা করিনি ঠিক তেমনও নয়, তবে কোনো মাধ্যম না থাকায় ব্যর্থবৈঠাই বাইতে হইলো। এর মধ্যে অনেক শিল্পীর কণ্ঠে এই গানটি শুনেছি কিন্তু ইতি বয়াতির কণ্ঠে যেনো প্রথম প্রেমের মতো একটা আলাদা দুর্বলতা কাজ করে, সবকিছু বাদ দিয়ে সেটাই শুনি যখন পিপাসা পায়। উনার গাওয়া অনেক গান সংগ্রহ করতে শুরু করি, ইউটিউবে উনার আর তেমন কোনো গান ছিলোনা, তাই বেশি সংরক্ষণ করতে পারিনি, বর্তমানে উনার হাজার হাজার গান পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে বাংলাভাষী বা ভীনদেশী সবার কাছে খুবই সহজে পৌঁছে গেছে।


শিল্পীকে নিয়ে আমার ধারণা

বাংলাদেশের অগোছালো লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধির জন্য যাঁরা নিজের জীবনের বাহ্যিক চাওয়া পাওয়া, অনুভূতি, অভিলাষ সবকিছু ভুলে একমাত্র শুদ্ধ সঙ্গীত প্রচার,  প্রসার যাঁদের লক্ষ্য তাঁদের মধ্যে তরুণ শিল্পী ইতি ইব্রাহিম আমার দেখা অন্যতম একজন। গত কয়েকবছর ধরে  সাক্ষাৎ করার প্রচুর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সময়ের সোনার হরিণ আমার দ্বারপ্রান্তে কখনো পৌঁছায়নি। সুসময়ের অপেক্ষায় প্রবোধ দিয়েছি কাঙাল হৃদয়কে, প্রায় বছরখানেক হবে কোনো এক টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে উনার ফেসবুকে এড হই, তখন থেকে এমন কোনোদিন মিস হয়ছে বলে মনে হয়না।  প্রাণভরে গান শুনি, নিষ্পাপ শিশুর মতো হাসি দেখি, কখনো কখনো সঙ্গীদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে থাকতেও দেখা যায়। তবে একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে পারি, সুর, তাল যন্ত্র থাক বা না থাক উনি যেখানেই যান কণ্ঠে সবসময় সঙ্গীত ধারণ করেন, শুনে মনেহয় উনার কণ্ঠ যেনো এক একটা সুর, তাল, লয়ের সাধনাযন্ত্রের মতো মোহময়তা ছড়াচ্ছে।

ইতি ইব্রাহিম এর কণ্ঠে মহাত্মিক সকল মহাজনদের গান শুনা যায়,  লালনসঙ্গীত, মলয়াসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত,  নজরুলসঙ্গীত, রামপ্রসাদী,  বিজয়সঙ্গীত, জালালগীতি, চণ্ডিদাস, দ্বিজ দাস, জ্ঞানদাস, এবং বিদ্যাপতির পদাবলী সহ প্রাচীন ও মৌলিক আধুনিক, লোক, কাওয়ালী সহ অনেক ধরণের গান শুনা যায়। বর্তমান তরুণ অনেক লেখকদের লেখা বা সুর করা গানও গাইতে শুনা যায়।  কয়েকদিন আগে  লোকসাহিত্যের মহান সাধক ও তার বাহকদের নিয়ে আমার ভাবনা উনার সাথে বিনিময় করি, আমি যেমনটা ভেবেছিলাম প্রাণখোলা এবং দ্বিধাহীন এক সহজ মানুষ, ঠিক তেমনি সহজভাবে একজন মার্জিত শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন, যদিও বর্তমান সময়ে এতো সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই, তবুও হয়তো উনাদের ধারণা বিশ্বাসেই মূল বস্তু, বা অমূল্য কোনো রত্ন,  মানুষের এই  ক্ষণভ্রমণকালে যেনো মানুষই থাকুক মানুষের জয়গান গেয়ে। আপনাদের সবার কাছে আজকে আমার প্রিয় শিল্পী ইতি ইব্রাহিম এর জীবনবৈচিত্র এবং কিছু যাপনাচিত্র তুলে ধরলাম, আশা করি যাঁরা সংস্কৃতি অথবা সঙ্গীতযাপন করতে আগ্রহী, কোনো অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন না, উনার জীবনপাঠের সংগ্রাম হয়তো আপনাকে আরো শক্তিশালী ও উদ্যমী করে তুলবে।


কর্ম কর্ম বলিহারি, কর্ম জানো কি?
কর্ম হলো মূল ধর্ম কর্ম সমীক্ষিত..

কথা ও সুর : কবি ইতি ইব্রাহিম ~

ইতি ইব্রাহিম এর স্বরচিত কিছু কবিতাংশ

অভাবী হও পরমের জন্য..
নিজের জন্যে নয়..
তাকে স্মরণ করো..
স্মরণে মরণ নেই।

ইতি ইব্রাহিম

শোনো.. কান বন্ধ করে..
দেখো.. চোখ বন্ধ করে..
বলো.. কথা না বলে..
সব করো..  কিছু না করে..
চুপে যাও..!

ইতি ইব্রাহিম ~

প্রেম দিয়ে মানুষের অন্তে বসবাস করো..
প্রেম ই মানুষ কে উজ্জীবিত করে..
মানুষের নিকট মহান হওয়ায়..
প্রেম সকলের ত্বরে বিলিয়ে দাও.. বিলিয়ে দাও তাদের মাঝে যারা প্রেমহীন।
তারাও বোধ করুক প্রেম দ্বারা সকল কিছু জয় করা যায়.. তারা যেন প্রেম দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেয়। এবং এমন প্রেম বিলিয়ে দাও যা তোমার শুদ্ধতার প্রতিচ্ছবি...
একটা সময় সকলেই এই সাধ গ্রহন করতে শিখবে..!
বিশ্বাস হয়না?..
করে দেখো..
প্রেমে জগত মাতিয়ে দাও... জ্বালাও প্রেমের চেরাগ!
জয় প্রেম"
জয় সর্বময় ~
বিশ্বের সকল জীব প্রেমের আস্বাদ গ্রহণ করুক।

ইতি ইব্রাহিম ~

সব শুন্য..  
শীতল হাওয়া বইছে..
সব কিছুর উর্ধ্বে ওই হাওয়াটা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে..
একটু গুণগুণ করে শোনা যায়...
কি ভালো লাগছে?
পরিপ্রেক্ষিতে আমার উত্তর শুধুই তৃপ্ততার মৃদু হাসি উড়ালো..
ক্ষানিকক্ষণ পর থেমে গেল..
তারপর আবার নড়ে বসে অপেক্ষা করি.. আবার কখন দোলা দিবে শীতল হাওয়া।।।

ইতি ইব্রাহিম ~
২৬/৩/২০২৫

তুমি..  আছো?
কেন, দেখতে পাও না?
পাচ্ছি আবছা...
ওহ চোখ মুছে দেখো!।
কই কই, কই তুমি?
আবছাতে হলে ও তো ছিলে
চোখে মুছে তোমাকে যে আবছাতেও পাইনে..!
এ কেমন বিধান তোমার...?
তুমি, আবছা কে খুঁজো না..
ভাল করে দেখো আমি তোমার গহীন কোণে আলোড়ন ফেলেছি...
দেখতে পাও না..?
তুমি কি জানোনা ওই আলোড়নে তোমার অন্তজ্জল হয়..!
আমি একটু একটু করে তোমার কাছে আবছা ধোয়াশা থেকে আলোকিত হই।
আমিই তোমার রুপ, তোমাতেই ধাবিত হই...  
নিরিখে চোখ বাঁধো..
আমি তো আছি, তোমার দেখা বাকী মাত্র"!

ইতি ইব্রাহিম
২৫/৩/২০২৫




একজন শিল্পী কিভাবে প্রাজ্ঞ কবি হয়ে যান সেটা হয়তো শিল্পী কখনোই অনুধাবণ করতে পারেন না, কারণ শিল্পীরা এমন একটি জীবন পরিচালনা করেন যেখানে সৃষ্টিকর্তার সাথে তাদের ভিন্ন এক হার্দিক যোগাযোগ থাকে, সেরকম চিন্তা এবং পরিশালীত উপলব্ধিতে একসময় শিল্পী নিজেই নিজের ভিতরে আবিষ্কার করেন অন্য এক পরম সত্ত্বা।  উপরের দুটো লাইন দেখলেই বুঝা যায় কতোটুকু আধ্যাত্মিক জীবন প্রবাহিত করছেন, কতো গভীরভাবে ইহ ও পরকালকে পর্যালোচনা করেন, আমি যদি এখানে 'কর্মই হলো মূল ধর্ম ' এর পাঠপ্রতিক্রিয়া করতে চাই তাহলে হয়তো একটানা তিন দিন ২৪ ঘন্টা করে লিখলেও তা শেষ হবে না। আশা করি যারা সেরকম চিন্তা করেন আপনারা বুঝতে পারবেন, আজকের বিষয় যেহেতু  শিল্পী ইতির জীবন সংগ্রাম নিয়ে তাই আর কোনো আলোচনা না বাড়িয়ে মূল কর্মে মনোযোগী হলাম।

জন্ম ও সঙ্গীত সাধনা

সময়টা আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের, ০১/০৩/২০০০ খ্রি.।  জননীর কোলের প্রথম প্রহরে যিনি সবার মতোই কান্নার সুরে পৃথিবীভ্রমণ শুরু করেন, হয়তো সেদিন বসন্তের রঙ চারদিক রঙিন করে রেখেছিলো, হয়তো কোনো সুরেলা কোকিল তাঁর আগমনী কান্না থামাতে গান গাইছিলো, যে কারণে  উনার কণ্ঠে বাঁশির মতো সুখ ও শোকের বাহারী সুর শুনে উদাস হয়ে যাই,  পরমপ্রভু যেনো নিজহাতে সুরের মালা উনার কণ্ঠে গেঁথে দিয়েছেন।
অবশ্য প্রভু সবাইকেই সামর্থ্য বা শক্তি দান করেন, যে সেগুলোর যত্ন ও পরিচর্যা করে সে সেই দানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু যে অযত্নে অবহেলা করে দৈব আশায় শুধু প্রহরই গুণে তার জীবনটাই যায় প্রহর গুণে সুময়ের অপেক্ষায়, কিন্তু প্রকৃত প্রেমি যাঁরা তাঁরা এই দানকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তাদের চেষ্টা, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে।  আসলে যা সহজে পাওয়া যায় তার কদর এই মনুষ্য জীবন কখনোই করেনা, কিন্তু সঙ্গীত বিষয়টা শ্রোতা হিসাবে শুনতে যতোটুকু সহজ মনে হয়, বিষয়টা আসলে একদম বিপরীত! সঙ্গীত অনেক কঠিন ও সাধনার বিষয়, যার কাছে যতো গভীর পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা এবং সুক্ষ্ম শ্রবণশক্তিমত্ত্বা রয়েছে তার কাছে সঙ্গীত অনেকটাই সহজ হতে পারে।

যদিও ইতি ইব্রাহিম এর ছেলেবেলা কেটেছে অসচ্ছলতা ও অপূর্ণতায়, তবুও আত্মবিশ্বাস মজবুত থাকার কারণে নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করেছেন খাঁটি সোনায়, যেগুলো বেশি পোড়ে সেগুলো হয়তো ভষ্ম ছাই হয় নয়তো খাঁটি হয়, ইতি নিজেকে খাঁটি করে তুলেছেন সেভাবে। উনার বাবার নাম ইব্রাহিম হোসেন ( দিপু শাহ্) যিনি নিজেও একজন সঙ্গীত সাধক, ইতি ইব্রাহিম এর গানের প্রথম গুরুও বলা যায়। যদিও মেয়ের গান শেখাতে প্রথম প্রথম বাধা দিয়েছিলেন,

এর কারণ হিশাবে অনুমান করা যেতে পারে বর্তমান সময়ের মানহীনতা, সামাজিক কুপ্রভাব, শিল্পীদের পণ্যের মতো ব্যবহার, মানুষের অশালীন মনোভাব, আর্থিক অসচ্ছলতা সহ আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, যেহেতু আমি গবেষণার কাজে অনেক প্রোগ্রামে যাই তাই বর্তমান সময়ে একজন মেয়ে শিল্পীকে মানুষ কোন চোখে দেখে সেটা আমি অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারি। ইতি নিজের স্বপ্ন ও একাগ্রতায় সবকিছু জয় করে ইতিমধ্যেই নিজেকে একটা সম্মানিত জায়গায় অধিষ্ঠিত করেছেন।  এর পেছনে উনার মমতাময়ী মা আমিরা বেগম এর অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থহীন ভালোবাসা উনাকে সাহসী করেছেন, উনার আম্মা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন,
গানের প্রথম গুরু আমার মা। আমি অনেক জায়গায় বিনা পয়সাতেই গান শিখেছি। লালন একাডেমি তে আক্কাস উস্তাদ সারগাম, সেমি ক্ল্যাসিক্যাল গান, কিছু লালন গান নিয়ে প্রাথমিক সঙ্গীত অধ্যায় শুরু হয় ৷ তারপর,  ভাবনগর শিল্প চর্চা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া হতো। প্রথম অবস্থায়  মানুষ ওতোটা পাত্তা দিতো না। আগেই বলেছি বেশ অগোছালো আর নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম,
তো সব মিলিয়ে গানে এসে প্রথম দিক টা বেশ সংগ্রাম করেছি আমার মা এবং আমি। সবার থেকে  বিশেষ অবদান ছিলো আমার মায়ের। এভাবে ভাবনগর প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সকল শিক্ষক ও পরিচালক টুকটাক গান দেখিয়ে দিতেন, তার মধ্যে হবিবুর রহমান বিশু কাকু, রতন শাহ ভাইয়া, সহ মায়ের পরে বিশেষ অবদান আমার গুরু প্রদীপ অধিকারীর । উনার পরামর্শ ও পরিচর্যায় সেই অবহেলিত ইতি থেকে শিল্পী ইতি হিসাবে পরিচিত করেছেন, এই অব্দি শিল্পী হয়ে উঠার পিছনে উনি আমার পাশে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। এখনো তার পরামর্শ সাপেক্ষে চলি। সব মিলিয়ে আমার গানের জীবনে অনেকের অবদান রয়েছে।
বর্তমানে উনার স্বরচিত গানের সংখ্যা ৫০/৬০ টির মতো।
পরিবারে বাবা মা সহ চার বোন ও দুই ভাই আছেন, ইতি সবার ছোট। গ্রামের নাম পূর্বমিলপাড়া।

১৮৬২ সালে ব্রিটিশরা কুষ্টিয়া জেলায় বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন জগতি রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করে। তখন থেকেই শুরু হয় কুষ্টিয়া জেলার নগরায়ন। ০৯ বছর পর কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশন স্থাপিত হয়। এই কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল মিল পাড়া। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫ সালে তাঁর ব্যবসায়িক কাজের উদ্দেশ্যে মিলপাড়ায় টেগর লজ প্রতিষ্ঠিত করেন। মিল পাড়ায় রয়েছে কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ১৯০৮ সালে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত তাঁত ব্যবসায়ী মোহিনী মোহন চক্রবর্তী মিল পাড়ায় একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান মোহিনী মিল গড়ে তোলেন। সচল অবস্থায় এটি ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় তাঁত শিল্প কারখানা। এই মোহিনী মিলের নাম অনুসারেই যায়গাটি মিল পাড়া নামে পরিচিত পায়। এরই পূর্বদিকে উনার জন্মস্থান।
কুষ্টিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ইতি ইব্রাহিম পড়াশোনা করেছেন। উনার ভাষ্যমতে মা-বাবা বেশ কষ্ট করেই তাদের সবাইকে বড় করেছেন।

গানের প্রতি উনার আগ্রহ একদম ছোট বেলা থেকে। আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন বয়স হয়তো ৫ বছর তখন ক্লোজ আপ ওয়ানের সালমা আপুর গান শুনে, মাথায় উড়না পেচিয়ে, পাটকাঠি দিয়ে মাইক্রোফোন বানিয়ে গান গাইতেন নিজেদের বাসার সামনেই। এবং ছোট থেকেই  গানপাগল এবং অগোছালো মানুষ। উনার মা বিষয় টা লক্ষ্য করতেন,তারপর থেকেই ইতির গানের পথ শুরু এবং মায়ের দোয়া ও আপ্রাণ চেষ্টার মাধ্যমে উনি এই অব্দি এসেছেন।

শিল্পীসত্তার পরিচিতি বিষয়ে জানতে চাইলে বিনয়ের সাথে বলেন শিল্পীসত্তায় এখনো পূর্ণ হয়ে উঠিনি। চর্চায় আছি যখন মন বলবে এবার ঠিক আছে, তখন আমার উপলব্ধি জানাবো।
২০১৯ সালে 'ম্যাজিক বাউলিয়ানা' (মাছরাঙা টেলিভিশন) উনার জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা।  সেখানে যৌথ ভাবে বিজয়ী হয়েছেন। এবং দ্বিতীয় বার আরটিভি আয়োজিত "সুফিয়ানা " রিয়েলিটি শো তে বিজয়ী হয়েছেন।

অনুকরণ-অনুসরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, এখন পর্যন্ত তেমন কাউকেই অনুসরণ করেননি, সব সময় ই চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে কিছু করতে। নতুন কিছু গানের মাঝে পরিবেশন করতে। আর এটা উনার গুরু প্রদীপ অধিকারী বুঝিয়েছিলেন,  যাই করো নিজের মতো করে। তো সেই অনুপ্রেরণায় থেকেই অনুসরণ জিনিস টা নেই। উনার
শিল্পী জীবনে ইচ্ছা একটাই, নিজের কিছু সৃষ্টি মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার। অনেক বড় হতে চাননা,অনেক টাকার মালিকও হতে চাননা। যা চান, তা মানুষের মাঝে নিজের কিছু সৃষ্টি উৎসর্গ করতে।  আস্তে আস্তে আরো বেশি মৌলিক গান লেখার ইচ্ছা আছে এবং সেই গান গুলো, সুর করে মানুষের মাঝে উৎসর্গ করতে চান। বর্তমানে সরকারি সংগীত কলেজে স্নাতক অধ্যায়নরত।
নিজেকে নিয়ে যাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু গানটা চর্চা করে যেতে চান,মানুষ হতে চান,মানুষের সেবা করতে চান আজীবন। উনার জীবনের জন্য অবিরাম শুভ কামনা সবসময়। ভালোবাসায় সমৃদ্ধ থাকুক সবকিছু।


তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা
যোশেফ হাবিব
কবি, নাট্যকার, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক।