মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,
কহিলাম, শোনো তবে —
শুনিতে লাগিল সবে,
শুনিল কুমার;
কহিলাম, দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,
ঘুমানো সে এক মেয়ে — নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে:
সেইখানে আর নাই কেহ —
এক ঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ
পড়ে আছে — পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুঁজে খুঁজে
তারপর — তারে আমি দেখেছি গো — সেও চোখ বুজে
পড়ে ছিল — মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি
বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি!
আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু — পায়ে,
পাথরের মতো শাদা গায়ে
এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় —
কিংবা ছিল — আমার জন্য তা নয়!
আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে,
পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে
রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে;
তবুও, হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে
তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার!
ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার।
তারপর, কহিল কুমার,
আমিও দেখেছি তারে — বসন্তসেনার
মতো সেইজন নয়, কিংবা হবে তাই —
ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!
মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে
নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে —
(পদ্ম — ভাগীরথী — মেঘনা — কোন্ নদী যে সে –
সে সব জানি কি আমি! — হয়তো বা তোমাদের দেশ
সেই নদী আজ আর নাই,
আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!)
সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায়
পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায়
কান দিয়ে তার শব্দ শুনে,
দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে।
দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে
সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে
রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,
আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় —
বসন্তের দেশে
জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে!
জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে
নদীর কিনারে!
হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন
শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্ধবে স্তন
রেখেছে সে ঢেকে!
বাকিটুকু — থাক্ — আহা, একজনে দেখে শুধু — দেখে না অনেকে
এই ছবি!
দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! —
আজও তবু খুঁজি
কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি!
কুমারের শেষ হলে পরে —
আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন,
কহিল সে উত্তর — সাগরে
আর নাই কেউ! —
জোছনা আর সাগরের ঢেউ
উচুনিচু পাথরের পরে
হাতে হাত ধরে
সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন!
ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা
আর তারা ঢেউয়ের মতন
জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে!
ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে।
সেই জলমেয়েদের স্তন
ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন!
তাহাদের মুখ চোখ ভিজে,
ফেনার শেমিজে
তাহাদের শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাঁদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে —
কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে!
রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্মিক্ করে
উত্তর সাগরে
বরফের কুঁচির মতন
সেই জলমেয়েদের স্তন
মুখ বুক ভিজে
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
উত্তর সাগরে!
সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে
কল্পনার গল্প সব বলে;
তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে;
এক কবি — তন্ময়, শৌখিন,
আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে!
আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে
হীরের ছুরির
মতো গায়ে
আরো ধার লবে সে শানায়ে!
সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ —
মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ
এমনি পড়িয়া রবে পাল্ঙ্েকর পর —
ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর।
চার পাশে তার
রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড়
গড়েছে পাহাড়!
এ রূপকার এই রূপসীর ছবি
তুমি দেখিবে এসে,
তুমিও দেখিবে এসে কবি!
পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত —
শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত!
হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা
ছিল কই! — তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা
তোমার রক্তের তাপ পেয়ে? —
আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে!
কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা —
তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা!
হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা;
কিন্তু, শোনো — স্বপ্ন নয় — আমাদেরই দেশে কবে, আহা! —
যেখানে মায়াবী নাই — জাদু নাই কোনো —
এ দেশের — গাল নয়, গল্প নয়, দু — একটা শাদা কথা শোনো!
সেও এক রোদে লাল দিন,
রোদে লাল — সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন
একদিন, সেই একদিন!
ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে,
ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে
চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে!
মায়াবীর ঘরে
ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন;
রূপ ঝরে যায় — তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন —
যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়,
যারা ভয় পায়
আয়নায় তার ছবি দেখে! —
শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে
ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,
দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে! —
দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ,
চোখে ঠোঁটে অসুবিধা — ভিতরে অসুখ!
কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে! —
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে
দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!..
সবাই উঠিল বলে — ঠিক — ঠিক — ঠিক!
আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক,
আমায় বলেছে সে কী শোনো —
আর একজন এই —
পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও;
বলেছে সে, কাল সাঁঝরাতে
আবার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? — তুমি আসিবে তো!
দেখা যদি পেত!
নিকটে বসায়ে
কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে
ফিক্ করে হেসে!
তবু আরো কথা
বলিতে আসিতে — তবু, সব প্রগল্ভতা
থেকে যেত!
খোঁপা বেঁধে, ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
সরে যেত, দেয়ালের গায়ে
রহিত দাঁড়ায়ে!
রাত ঢের — বাড়িবে আরো কি
এই রাত! — বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি
হয় নাই দেখা
আমাদের দুজনার! দুইজন, একা! —
বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে!
কেন বা এমন করে বলে,
কাল সাঁঝরাতে
আমার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? তুমি আসিবে তো! —
আমি না কাঁদিতে কাঁদে.. দেখা যদি পেত!..
দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি? — বলিল সে তোমার বকুল,
মনে আছে? — এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’, — ভালোবাসো?’ — হাসি পেল — হাসি!
ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’
আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে
নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে
চলে এল কাছে —
জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে —
আজও এত চুল!
চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল
একবার চুপে তুলে ধরি;
চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি!
থুত্নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি —
সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি!