সেই যুবা পুরুষের (অথবা সে প্রৌঢ় নাকি) আবির্ভাব হয়েছিল আমাদের হেমন্তের পথে
তখন আকাশ ঢালু হয়ে এসে নদীর কিনার দিয়ে নিষ্প্রভ জল
ছুঁয়ে আছে – এ সব সান্ত্বনা নয়, শান্ত কথা মনে পড়ে শুধু
বিকেলের হলুদ আলোক ভুলে কুড়ুনি উপুড় হয়ে আরো ঢের পাতা
হৃদয়ে গণনা ক’রে তুলে নেয় – আমি সেই মেয়েটির একটি শরীর
প্রান্তরের নানাদিকে নানাবিধ নারীর মতন
কেমন নিঃশব্দ ভাবে দেখা দেয় মানুষের একক জীবন
অনেক নারীর মত খুলে যায় একটি নিমেষে
টের পাই; আমাকেও যুগপৎ প্রান্তরের সব দিকে দেখি।
এই সব অস্বীকার ক’রে নিয়ে (বাংলার) দু’চারটে মুখর কৃষাণ 
এখন স্তিমিত হয়ে চ’লে যায় মাঠ ছেড়ে অঙ্গারের দিকে
দু একটি থেকে যায়; সহসা নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে
মানুষের আত্মা এক আমাদের ব্যাপ্ত পৃথিবীতে চ’লে এল
সবেকে উপেক্ষা ক’রে উপেক্ষিত হয়ে সেই জীব
ধীরে ধীরে চ’লে গিয়ে কোন এক আধেক ভূতুড়ে
ছাউনির কাছে থেমে আম, নিম, জামরুল, ধানের ভিতরে
কোনো এক মহিলার সাথে কথা ব’লে গেল হাজার খানেক
বছরের পরে এসে – দু এক নিমেষ (শুধু) – তারপর একা
জীবনের অন্য সব গুরুতর কাজের কিনারে
চলে যায় পুনরায় এক লক্ষ বৎসরের দিকে
দু পকেটে হাত রেখে ভ্রূকুটিল মুখ তুলে ভাবে
প্রণয় – রমণী –  মৃত্যু – নিসর্গের চেয়ে কিছু বেশী 
হয়তো বা কোনো এক নগরীর ব্যবস্থার কথা
অথবা কি ক’রে ঘুঁটি চালালে শত্রুর পরাজয়

অথবা ফ্রয়েড – প্লেটো – পতঞ্জলি – মার্ক্স – এঙ্গেলস
বিশদ জ্ঞানের কাছে এরাও সকলে শিশু নাকি?
ভেবে তার মুখে এক অমেয় নির্জ্জন বিষ
লেগে আছে। আমাদের কাহার হৃদয় এই পৃথিবীতে এসে
কোন্‌ঠিক বস্তু চায় কি ক’রে তা’ জানি?
ঐ যুবা জানে তবু – তাই তার মুখের বিভূতি
সাধারণ বিমর্ষের মত নয়; ছ’ হাজার  ন’ হাজার বছর আগেও
এমনি পথের বাঁকে তাকে আমি দেখেছি কোথাও
সাধারণ গালগল্প কল্পনার চেয়ে ব্যতিরেকী
বিভা নিয়ে তবুও সে আমার প্রসাদ
ম্লান ক’রে দিয়ে যায় – আমাকে সে বারবার দেখে
তবুও দেখেনি ভেবে কাচের রঙের মত আমার জীবন
ভেদ ক’রে চেয়ে থাকে কোন দিকে? উপেক্ষিত কাচ
সহসা মানবাত্মা পেয়ে তাহা অনুভব করে
সেই যুবা, নারী নিয়ে ত্রিভুজের স্থূলতর কোণের ভিতরে
যতই অধিক স্থান, ইচ্ছা, জ্ঞান অধিকার ক’রে নিয়ে আমি
সময় বাড়ায়ে যাই অনারূঢ় দেয়ালের কাছে এসে থামি।

** (কলকাতা শহরে অবস্থিত ভারতের জাতীয় লাইব্রেরির রেয়ার কালেকশন সেকশনে রক্ষিত কবি জীবনানন্দ দাশের ৩৫ (খ) চিহ্নিত খাতা থেকে সম্প্রতি পাঠোদ্ধার করেছেন জীবনানন্দ-বিশেষজ্ঞ ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী কবিতাটি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট-সেপ্টেম্বর কাল পরিসরে লিখিত। কবি এসময় বরিশালে অবস্থান করছিলেন। কবিতার শিরোনাম ‘দেয়াল’ জীবনানন্দ কর্তৃক প্রদত্ত।)**