কবি প্রণব মজুমদার গতকাল (০৫-০৩-২০১৮) আলোচনা পাতায় কবির কাম্য কি - প্রশংসা, নাকি সমীহ - এই বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন l এই প্রসঙ্গে স্বল্প পরিসরে প্রশংসা ও সমীহের ধারণাটি তিনি স্পষ্ট করেছেন l লেখা বিষয়টি মানুষের সহজাত স্বভাবের হলেও এটা ঠিক যে লিখে এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায় l প্রশংসা বা সমীহ এই তৃপ্তির জায়গাটিকে দৃঢ় করে l মৃত্যুর পরেও মানুষ কবির কবিতা পড়ে প্রশংসা বা সমীহ করে যাবেন - নশ্বর পৃথিবীতে অমরত্বের এই প্রলোভনও থাকে l
কিন্তু একজন কবি কি শুধু এই প্রাপ্তিটুকুর কথা ভেবেই লেখেন ?
তাহলে যে আমরা বলি, কবি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, কবি সময়ের দিনলিপি লিখে যান, ইত্যাদি ইত্যাদি ?
কবি কেন লেখেন ? কবি অমিয় চক্রবর্তী বলছেন,"সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে প্রাণের অপরিমেয় রহস্য নিহিত আছে l"
কবি লেখার মধ্যে দিয়ে যেন কিছু বলতে চান l কাকে বলতে চান ? মানুষকে l লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি কিছু একটা করতে চান l কি করতে চান ? কি করা সম্ভব ? মানুষকে আনন্দ দেয়া সম্ভব l লেখার মধ্যে দিয়ে মানুষকে ভাবিয়ে তোলা যায়, তার মননকে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করে তোলা যায় l
কবি যে সৃষ্টি করেন, সেটা মানুষের কি কাজে আসে ? বলা হয় কবিতা মানুষের সহযোগী হতে পারে l সহযোগী হতে পারে তার সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনায় l কবিতা আমাদের এক অভূতপূর্ব জগতের সন্ধান দেয় l সেই অভূতপূর্ব জগত প্রত্যক্ষ করার আনন্দে যাপিত জীবনের দুঃখ কষ্ট, শোক ভুলে যাই l অর্থাৎ কবিতা যাপিত জীবন থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে আমাদের এক ধরনের স্বস্তি দেয় l তাহলে মানুষকে যাপিত জীবনের অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেবার লক্ষ্যে কি কবি কবিতা লেখেন ?
কবি জীবনানন্দ দাশ বলছেন - সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উত্কর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা l কবি অমিয় চক্রবর্তী বলছেন, তিনি যে উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন, যে উপমা ব্যবহার করেন, শেষ পর্যন্ত দেশ জাতির প্রেক্ষিতে তার অর্থ বদলে যায় l অর্থাৎ কবিতা ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি হলেও তাকে শেষ পর্যন্ত সার্বজনীন হতে হয় l
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কল্পনার একটা ভূমিকা আছে l জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, কল্পনাপ্রতিভাই কবিতার উত্স l
কিন্তু কার কল্পনা ? কবির নিজের ? নিজের কল্পজগতকে, নিজের কল্পবাস্তবতাকে পাঠকের সামনে হাজির করা ? না ঠিক তা নয় l পৃথিবীর সব মানুষের নিজস্ব কল্পবাস্তবতার জগত আছে l কবিরও আছে l কবির সেই জগতে কবি ব্যথা পান, আনন্দ পান, নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন l কবিমানুষ বলেই বেশ আকর্ষণীয় করে তিনি সেটা লিখেও ফেলতে পারেন l কিন্তু সেটাই কবিতা হয়ে ওঠে না যতক্ষণ না পর্যন্ত কবি মানুষের কল্পবাস্তবতাকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে শেখেন l নিজের চোখের বদলে মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে না পারলে দেখার ফাঁকিটুকু ধরা পড়ে যায় l কবি তাঁর একক জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করছেন সেই অভিজ্ঞতা যখন তিনি মানুষের ভাষায় লিপিবদ্ধ করছেন, মানুষ তার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছে, তখনই সেটা কবিতা হয়ে উঠছে l
মানুষ তার চলার পথে নানাভাবে জীবনকে বুঝতে থাকে l তার অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে l সেই অভিজ্ঞতাই মানুষকে কবিতার কাছে নিয়ে আসে l জীবন অভিজ্ঞতার অভাব কবিতা থেকে মানুষকে দূরে নিয়ে যায় l
জীবন কি ? জীবন হলো একটি প্রবাহ l একটা চলতে থাকা l গড়ে ওঠা, ভেঙে যাওয়া, উঠে দাঁড়ানো, আবার চলতে থাকা l একটা অস্তিত্ব l জীবন নিত্য রহস্যময় l পদে পদে বিস্ময়, অনিশ্চয়তা l এই জীবনকে উদ্ভাসিত করে কবিতা l এই উন্মোচনের প্রয়াসই কবিতার জন্ম দেয় l যেমন জীবন, তেমনি মৃত্যু - এক বিচিত্র প্রহেলিকা l ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু তাতে জীবনের প্রবাহ থেমে থাকে না l জীবন- মৃত্যুর সত্যকে মেনে নিয়ে প্রবহমান এই জীবনের মধ্যে সমগ্রের যে ধারণা - তার অনুভব ও প্রকাশই কবিতা l