২৮-০৪-২০১৮ "বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটের কলকাতা কবি সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলাম l তার প্রথম বিষয় ছিল - কবিতা কেন লিখি ? সময় সংক্ষিপ্ত ছিল l কাটছাঁট করে বলেছিলাম l
যা বলেছিলাম, সেটিকেই পরিমার্জন, সম্পাদন করে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করলাম - সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের জন্য l
__________________________

কেন লিখি কবিতা ? কি পাই কবিতা লিখে ? বস্তুত যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা কবিতা না লিখে ঐ সময়টা অর্থকরী অন্য কাজে নিয়োগ করলে লাভবান হবেন বলে মনে হয় l তবু কেন কবিতার জন্য এত সময় ব্যয় ? নাকি অপচয় ?
প্রতিটি ভাষায় যাঁরা খুব বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠিত কবি, তাঁরা কবিতা লিখে কিছু উপার্জন করেন হয়তো l হয়তো বা কবিতা লেখা তাঁদের কাছে পেশা, যার উপার্জন থেকে তাঁদের জীবন জীবিকার ব্যয় নির্বাহ হয় l কিন্তু অনেক শ্রেষ্ঠ কবিরও কবিতা লিখে অর্থাগম হয় নি, যেহেতু জীবিতকালে তাঁদের সেরকম স্বীকৃতি মেলে নি l দারিদ্র্য অভাবের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার পর মরণোত্তর স্বীকৃতি মিলেছে l কবিতার জন্য ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে অনেক l জেলে যেতে হয়েছে l চাকুরী খোয়াতে হয়েছে l 'ক্যাম্পে' কবিতা লেখার কারণে অশ্লীলতার দায়ে কলেজে অধ্যাপনার কাজ হারিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ l এত ক্ষতি স্বীকার করেও কেন কবিতা লিখে যান কবিরা ? অর্থ পাওয়া তো দূরের কথা, গাঁটের কড়ি খরচ করে কবিতার বই বার করতে হয় অনেক কবিকে l সেই বই বিক্রি করাও দুষ্কর হয় l সৌজন্য সংখ্যা বিলিয়ে যেতে হয় l কবিতা যে হারে লেখা হয়, কবিতার বই বা কবিতার পত্রিকার স্বতঃপ্রণোদিত ক্রেতা সেই হারে বাড়ে নি l তবু এই অনাদরের মধ্যেও কবিতা লেখার বিরাম নেই l কবিতার ওয়েবসাইট হয়েছে এখন বেশ কিছু l সেখানে কবিতা প্রকাশ চলছে নিয়মিত l পত্র পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে l নবীন প্রবীণ কবিরা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে চলেছেন  ধারাবাহিকভাবে l
কেন এত কবিতা লেখা হয় ? কবিরা কেন লেখেন এত কবিতা ? একই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খায় মনে l
একটা বয়স আছে l উঠতি বয়স l সব ছেলেমেয়েদের একটা রোগ পেয়ে বসে l কবিরোগ l হঠাৎ করে কবিতা লিখতে শুরু করে তারা l
এখনকার বিচিত্র সব বিনোদন, গ্যাজেট এর যুগে উঠতি বয়সের সব ছেলেমেয়েরা এই রোগে আক্রান্ত হয় কি না জানি না, তবে কয়েক দশক আগে পর্যন্তও এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে l তারা সবাই যে কবিতা লেখার এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করত তা নয় l অনেকের ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে লেখায় ছেদ পড়ত l উৎসাহ কমে যেত l লেখা থেমে যেত l কিন্তু অল্প কিছুজন নিয়মিতভাবে জীবনভর লিখে যান l তাঁদেরই একটা অংশ পরবর্তীতে কবি হিসেবে নাম যশ পান l
কবিতা হচ্ছে হৃদয় উৎসারিত আলো l সেই আলো আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় l সেই ভাবনা থেকে আমরা কবিতা লিখি l জীবনের অন্য সব ছোটখাটো চাওয়া পাওয়া সেখানে মিথ্যা হয়ে যায় l মনের আনন্দে কবিরা লিখে চলেন l সত্য সুন্দরের সাধনা চলে l কবিগুরুর ভাষায়,
"অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
       সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
       সেই তো তোমার ভালো।"

আমরা যদি বিষয়টিকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করি তাহলে কবিতা লেখার কতকগুলি আপাত গ্রহণযোগ্য কারণ মনে আসে l যেমন, আমরা খুব অসুবিধার মধ্যে আছি, অথচ চারিদিকে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে দেখছি, তখন মনের মধ্যে কেমন একটা ভাব জাগে l সেই ভাবনা কবিতা রচনাকে প্রণোদিত করতে পারে l
বিশেষ কাউকে খুব ভালো লেগে গেল l প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতো l মনের মধ্যে গান গাওয়া শুরু হলো l সেই গান কবিতা হলো l প্রেমের কবিতা l
সম্পর্ক যেমন গড়ে, তেমনি আবার ভেঙেও যায় l তখন গভীর জীবনবোধের, বিরহের কবিতার জন্ম হয় l
জীবন অভিজ্ঞতাপূর্ণ l বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা কবিতার প্রেরণা l যখন বিচ্ছেদের আঘাত আসে জীবনে, বন্ধুবিচ্ছেদ, স্বজন হারানোর বেদনা, তখন কবিতার জন্ম হয় - শোককবিতা l
বলা হয়, কলমের শক্তি তরবারির চেয়েও বেশি l এই ভাবনা থেকে কবিতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন অনেকে l কবিতা সেখানে প্রতিবাদের ভাষা l যাঁরা বঞ্চিত, শোষিত - কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁরা বিপ্লব সংগঠিত করতে চান l শোষকের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি যখন কথা বলতে পারা যায় না, তখন পরোক্ষভাবে শাসকের বুক বরাবর কবিতার তীর ছুঁড়ে মারা হয় l কবিতা প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে l
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম উৎস হলো আবেগ l আবেগতাড়িত না হলে কবিতা লেখা যায় না l বহুবিচিত্র, বহুমাত্রিক ঘটনাবলী আবেগের জন্ম দেয় l সুখ-দুঃখ, বিজয়-পরাজয়, হর্ষ-বিষাদ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আবেগের জন্ম দেয় l কবিতার মধ্যে দিয়ে সেই আবেগ প্রকাশিত হয় l
দায়বদ্ধতা থেকে কবিতা লেখেন অনেকে l দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি অপরিসীম মমতা কবিতায় প্রকাশিত হয় l  
কিছু মানুষ আছেন, কবিতা যাঁদের কাছে প্রাণের দোসর l কবিতা না লিখলে তাঁদের দম বন্ধ হয়ে আসে l কবিতা তাদের কাছে নেশার মতো l
যন্ত্রণা, প্রবঞ্চনা, ব্যর্থতা বা প্রতারণার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে কবিতা লেখায় প্রাণিত হন অনেকে l
ঈশ্বর থেকে অলৌকিক ধী-শক্তি প্রাপ্ত হয়ে প্রভূত জ্ঞানের কবিতা লেখেন অনেক কবি l
থাকে প্রতিভা বিষয়টি l তার তাড়নাতে কবিতা লেখা হয় l
পরিবারে, সমাজে যে বিভিন্ন সম্পর্কে আমরা আবদ্ধ, সেই সম্পর্কের নানা অভিঘাত আমাদের কবিতা লেখায় প্রণোদিত করে l মায়ের জন্য, বাবার জন্য, প্রেমিকার জন্য, প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য, সন্তানের জন্য, বোনের জন্য, ভাইয়ের জন্য, দেশের জন্য বহু বহু কবিতা লেখা হয় l  
আরও কতো কতো কারণে কবিতা রচিত হতে পারে l ব্যক্তিভেদে কারণ ভিন্ন হতে পারে l কখনো কখনো ইতিহাস হবার জন্যই কিছু কবিতার জন্ম হয় l সেটা খুব অক্ষয় কবিতা l যার প্রতিটা চরণ সোনার হরফে ক্ষোদিত হয় কালের পাতায় l