উত্তর আধুনিকতা একটি নতুন যুগ নয় l এটি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আধুনিকতার ধারণার প্রতিক্রিয়া l এই সময়কালে পরপর কতকগুলি ঘটনায় যেভাবে মানব অধিকার হরণের বিষয়গুলি ঘটেছিল এটি তারও প্রতিক্রিয়া l জেনেভা কনভেনশনে (১৮৬৪-১৯৪৯) মানবধিকার এর কথা বলা হল l যুদ্ধকালে যুদ্ধবন্দী, যুদ্ধে আহত সৈনিক ও সাধারণ সিভিলিয়ানদের প্রতি কি মানবিক ব্যবহার করা হবে, তার চুক্তিপত্র হল l অথচ পরপর ঘটলো -
১) Nankin এর গণধর্ষণ ও গণহত্যা ( জাপানের সেনাবাহিনী ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ছয় সপ্তাহ ধরে টানা তৎকালীন চীনের রাজধানী Nankin এর অধিবাসীদের গণহত্যা ও নারীদের গনধর্ষণ করেছিল )
২) বাটান মৃত্যুমিছিল (জাপানী সেনাবাহিনী ১৯৪২ সালের ৯ এপ্রিল প্রায় ৮০০০০ ফিলিপিন ও আমেরিকান যুদ্ধবন্দীদের বলপূর্বক বাটান এর অন্তর্গত বালজাক এর সাইসাই পয়েন্ট ও মেরিভিল থেকে Pampagna র অন্তর্গত San Fernando হয়ে Tarlac এর অন্তর্গত Capas এর Camp O'Donnell এ যেতে বাধ্য করেছিল l দূরত্ব ছিলো প্রায় ১১০ কি. মি. l বলা হয় এই যাত্রাকালে প্রায় ১৮০০০ ফিলিপিন ও ৬০০ আমেরিকান যুদ্ধবন্দী মারা যান )
৩) ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ই আগস্ট আমেরিকা কর্তৃক জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ
৪) Holocaust ( একটি ব্যাপক হত্যাকান্ড যা জার্মানীর সর্বাধিনায়ক আ্যডলফ হিটলার ও তার নাজী সেনাবাহিনী সংঘটিত করেছিল যেখানে পরিকল্পিতভাবে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয়েছিল l তৎকালীন মোট ইহুদী জনসংখ্যা যা ছিলো প্রায় ৯০ লক্ষ তার দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬০ লক্ষ এই Holocaust এ নিহত হয়েছিলেন l এর মধ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ শিশু ছিলো l মানব ইতিহাসে এত বড়ো গণহত্যার উদাহরন বিরল l)
৫) Dresden এ বোমাবর্ষণ (বৃটেন ও আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জার্মানীর Saxony প্রদেশ এর Dresden শহরে বোমারু বিমান থেকে  ৩৯০০ টন এরও বেশী "high explosive bombs" নিক্ষেপ করেছিল l এই বোমাবর্ষণ ও তার থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৬০০ একর এলাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল l প্রায় ২৫০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল l)
৬) জাপানের টোকিও শহরে বোমাবর্ষণ (১৯৪২ সালের  মার্চ-এপ্রিল মাসে আমেরিকান বিমানবাহিনী কর্তৃক জাপানের টোকিও শহরে পরপর বোমাবর্ষণ l প্রচুর সম্পদহানি এবং প্রায় দশ লক্ষের অধিক মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ l)
৭) The internment of Japanese Americans ( বলা হয়, আমেরিকার পার্ল হার্বার বন্দরে জাপানী বোমাবর্ষণের পর আমেরিকা নিরাপত্তার অঙ্গ হিসাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছিল l আমেরিকায় বসবাসকারী প্রায় ১২০০০০ জাপানী মানুষকে ওয়াশিংটন, ক্যালিফোর্নিয়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল থেকে সরিয়ে অন্য স্থানে relocate করা হয়েছিল l জাতিবিদ্বেষও এর কারণ ছিলো বলে অভিযোগ ওঠে l এই স্থানান্তরকরণের সময়
মানব অধিকার হরণের প্রচুর অভিযোগ উঠেছিল l)
৮) দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর Cold War ইত্যদি ইত্যাদি l

মানব অধিকার হরণের এই যে ঘটনাগুলি পরপর ঘটল, আধুনিকতা ও তার প্রধানতম উপাদান রোমান্টিকতা দিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানানো যাচ্ছিলো না l প্রয়োজন ছিলো নতুন প্রকাশভঙ্গির l তাই শুধু সাহিত্যে নয়, একই সঙ্গে দর্শন, চিত্রকলা, স্থাপত্য, নাট্যকর্ম, সমালোচনা কর্ম - সর্বত্র এলো উত্তর আধুনিকতা l নতুন যুগ হিসাবে নয় l কোনো আন্দোলন হিসাবে নয় l নতুন প্রকাশভঙ্গি হিসাবে l আধুনিকতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে l
আধুনিকতার দুর্বলতার কারনে এর পূর্বেও বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নানা সময়ে নতুন প্রকাশভঙ্গি হিসাবে শিল্পে সাহিত্যে কিছু ধারণার জন্ম নিয়েছে l প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পরে এসেছে দাদাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ l সুররিয়ালিজ্ম যখন মধ্য গগনে তখনই এল উত্তর আধুনিকতা l এই সব ধারনাগুলি পরস্পর সম্পর্কিত l আধুনিক সভ্যতার মানব অধিকার হরণের যে চেহারা, বাইরে সভ্যতার চাকচিক্য, আর ভেতরে দানবরুপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যাদের কাছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবন মুল্যহীন - তার প্রতিক্রিয়ায়, আধুনিকতার প্রতিক্রিয়ায় নতুন প্রকাশভঙ্গি হিসাবে এগুলির সৃষ্টি l

উত্তর আধুনিকতা যেহেতু একটি যুগ নয়, কেবল প্রকাশভঙ্গি, তাই এর কোনো সুনির্দিষ্ট তত্ব নেই l
উত্তর আধুনিকতাবাদ বিষয়ে যে সকল দার্শনিক ব্যক্তিগণের কথা বলা হয় যেমন- ফ্রিডরিক নিৎসে, লিয়েতার, দেরিদা, হাইডেগার বা লাকা এঁরা কেউই উত্তর আধুনিকতাবাদ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেননি। তাঁরা কেবল নিজ নিজ দার্শনিক অবস্থান থেকে তাঁদের ভাবনা, বিশ্বাস তথা দার্শনিক অবস্থান সমূহকে উপস্থাপন করেছেন।
ইংরাজী  সাহিত্যে অষ্টাদশ শতাব্দী যেমন ছিল নিও ক্লাসিসিস্ম এর যুগ, রোমান্টিক যুগ এল ১৭৯৮ সালে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ এর যুগ্ম প্রকাশনা "Lyrical Ballads" কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ দিয়ে, আধুনিকতার শুরু বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, উত্তর আধুনিকতার শুরু নিয়ে তেমন সর্বসম্মত মত নেই l কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ আন্দোলনের আকারে এটা আসে নি l বিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে প্রসার লাভ করেছে l কিছু মতান্তরও আছে l একটি মত হল, ১৯৪১ সালে জেমস জয়েস ও ভার্জিনিয়া উল্ফ এর মৃত্যু হয় এবং সেটিই আধুনিকতার শেষ ও উত্তর আধুনিকতার শুরু l এটিই বিভেদরেখা l আইরিশ উপন্যাসিক Flann O'Brien প্রথম উত্তর আধুনিক উপন্যাস লেখেন "The Third Policeman" ১৯৩৯ সালে, যদিও সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে l কারও মত হলো John Hawkes এর "The Cannibal" যা ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সেটিই প্রথম উত্তর আধুনিক রচনা l কেও বলছেন "Waiting for Godot" যা ১৯৫৫ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল, সেটিই শুরু l এরকম ১৯৫৬ সালে "Howl" এর প্রকাশ, ১৯৫৯ সালে "Naked Lunch" এর প্রকাশ - এগুলিও দাবীদার l অনেকে বলেন, জ্যাক দেরিদা ১৯৬৬ সালে "Structure, Sign, and Play" এই শিরোনামে যে  lecture দিয়েছিলেন, অথবা ইহাব হাসান ১৯৭১ সালে "The Dismemberment of Orpheus" নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে উত্তর আধুনিকতা ধারণাটি এনেছিলেন l
আধুনিকতার সঙ্গে তুলনা করে একটি বিষয় বলা হচ্ছে l  আধুনিকতা দর্শনের শাখা epistemology (জ্ঞানতত্ব - জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করে) ভিত্তিক এবং উত্তর আধুনিকতা দর্শনের শাখা Ontology (তত্ত্ববিদ্যা - সত্তার বা অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্বন্ধীয় অধিবিদ্যার একটি শাখা l) ভিত্তিক l
উত্তর আধুনিক যুগে বিকশিত Theatre of the Absurd, the Beat Generation,  Magic Realism এই বিষয়গুলির সঙ্গে উত্তর আধুনিকতার ধারণার উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায় l এগুলিকে সম্মিলিতভাবেই  উত্তর আধুনিকতা বলা হয় l
Samuel Beckett, William S. Burroughs, Jorge Luis Borges, Julio Cortázar, Gabriel García Márquez - উত্তর আধুনিকতা ধারণার বিকাশে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অবদানের কথা স্বীকার করা হয় l
এঁদের মধ্যে বেকেট এর অবদান অসাধারণ l ১৯৪৫ সাল নাগাদ বেকেট অনুভব করেন, জেমস জয়েস এর ছায়া থেকে মুক্ত হতে হলে তাঁকে ভাষার দুর্বলতার ওপর ফোকাস করতে হবে, মানুষ সর্বশক্তিমান এই মিথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং মানুষকে ব্যর্থ হিসাবে দেখাতে হবে l বেকেট এর লেখায় তাই দেখি এমন চরিত্র যে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যার থেকে বেরিয়ে আসতে সে অক্ষম l Narrative form নিয়ে এবং "disintegration of narration and character in fiction and drama" নিয়ে সফল পরীক্ষা নিরীক্ষার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৬৯ সালে বেকেট সাহিত্যে নোবেল পান l তাঁর পরবর্তী কাজগুলিও deconstruction of  literary forms সম্পর্কিত l তিনি নিসন্দেহে উত্তর আধুনিক সাহিত্যের একজন স্থপতি l

"Beat generation" হল আমেরিকার এক যুবগোষ্ঠী l সাহিত্যে এঁরা automatism ধারনা নিয়ে আসেন l  "spontaneous prose" ধারনা জন্মায় l এর মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর Black Mountain poets, the New York School, the San Francisco Renaissance এবং আরও বহু গোষ্ঠী l উত্তর আধুনিক লেখক বলতে এদের ধরা হয় l  

William S. Burroughs ১৯৫৯ সালে প্যারিসে এবং ১৯৬১ সালে আমেরিকায় "Naked Lunch" প্রকাশ করেন l কেউ কেউ এটিকেই প্রথম উত্তর আধুনিক উপন্যাস মনে করেন l এটি ছিল fragmentary, কোনো কেন্দ্রীয় narrative ছিল না, pastiche এর ব্যবহার ছিল, এটা parody, paradox, playfulness এ ভর্তি ছিল - যেগুলি সবই উত্তর আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য l

Magic Realism একটি কৌশল যা লাতিন আমেরিকান লেখকদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো l এখানে supernatural বিষয়কে mundane অর্থাৎ জাগতিক হিসাবে দেখা হতো l Gabriel Garcia Marquuez এর "A Very Old Man with Enormous Wings" প্রকৃষ্ট উদাহরণ l
উত্তর আধুনিকতাবাদ এর শুরুর সময় যেমন নিশ্চিত নয় তেমনই এর শেষ কবে তাও সুনিশ্চিত নয় l বলা যেতে পারে ৬০ ও ৭০ এর  দশকে এটি চরমে ছিলো l ঐ সময় প্রকাশিত হয় "Catch-22" (১৯৬১),  "Lost in the Funhouse" (১৯৬৮), "Slaughterhouse-Five" (১৯৬৯) ইত্যাদি l
একশ্রেণীর সাহিত্য আলোচকের বক্তব্য, ১৯৮০ সালে সাহিত্যে realism গুরুত্ব পাওয়ায় উত্তর আধুনিকতাবাদের দিন শেষ হয় l একঝাঁক নতুন লেখক আসে l David Foster Wallace, Giannina Braschi, Dave Eggers, Michael Chabon, Zadie Smith, Chuck Palahniuk, Jennifer Egan, Neil Gaiman, Richard Powers, Jonathan Lethem, Denvor Fernandez প্রমুখ l উত্তর আধুনিক যুগ পরবর্তী সাহিত্য ধারাকে পথ ছেড়ে দেয় l

আধুনিকতাবাদের দর্শনকে উপেক্ষা করে উত্তর আধুনিকতাবাদের জন্ম l তাই আধুনিকতাবাদের
সাপেক্ষে উত্তর আধুনিকতাবাদকে বোঝার চেষ্টা করি l
। আধুনিকতাবাদ একটি বৈচিত্র্যময় বহুমাত্রিক জটিল নকশা। এক কথায় বলা যেতে পারে আধুনিকতাবাদ হলো তন্ময়-মন্ময়তার একটি বহুমাত্রিক বিন্যাস। সেই সাথে আসে প্রথাবিরোধিতা, ইন্দ্রিয়ের প্রসারণ ও  আত্মমগ্নতা যা রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্য l  আধুনিকতাবাদের সাথে রোমান্টিকতাবাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। রোমান্টিক কবিরা ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে নতুন পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলেন। প্রতীকের ব্যবহার, চিরন্তন প্রেমের আদর্শ, সংগীতধর্মীতা ছিল। ছিল  চিত্রকল্প।  এছাড়াও নানান চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি, যেমন, ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, ফবিজম, ফিউচারিজম, ফেমিনিজম, প্রভৃতির প্রভাব ছিল।

এদের মধ্যে ইম্প্রেশনিজম এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যের বেশিরভাগই উত্তর আধুনিকতাবাদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। ইম্প্রেশনিস্টরা সাধারন বলে কোন কিছুকে অবহেলা করেন না l ধ্রুপদী শিল্পের শৃঙ্খল ভেঙে বিপরীত কিছু সৃষ্টি করেছেন। প্রতিক্ষণে প্রকৃতির বদলে যাওয়া রূপকে ধরতে চেয়েছেন। আলোছায়ার স্বরূপ প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং নিজের ভেতর কল্পনাপ্রসুত বা ধারণাগত বিষয় সমূহকে প্রাধান্য না দিয়ে চোখের সামনে যা দেখেছেন তাকেই সত্য বলে জেনেছেন। ফলে সাহিত্যে এল বিকৃতমুখিতা, বিশৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাচরিতা। তাছাড়া ফ্রয়েডিয় মনোঃসমীক্ষণতত্ত্বও (অর্থাৎ চেতন, অবচেতন, অচেতন কাঠামো) একটি বিশেষ মাত্রা পায়। যা পরাবাস্তবতা নামেই সুপরিচিত। পরাবাস্তবতা- বাস্তবতা ও অবাস্তবতার মধ্যে একটা ফ্যান্টাসী তৈরী করে।  
উত্তর আধুনিকতাবাদ স্থাপত্য বা চিত্রকলার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুরু হয় l কিন্তু তার ব্যাপ্তি অসীম।  
মেটান্যারেটিভ সমূহের ভেতরকার সকল অসংগতি, অমিল বা কন্ট্রাডিকটরি বিষয় সমূহকেও উপভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে চায়। অর্থাৎ একটা অখন্ড সমগ্রতা।  উত্তর আধুনিকতা একটি অগ্রসরমান প্রক্রিয়া, কালে কালে উত্তর আধুনিকতায় নতুন নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হবে এবং পুরোনো বিষয়গুলো বাজেয়াপ্ত হবে l

জ্যা পল সার্ত্রেই সর্বপ্রথম অস্তিত্ববাদের সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতার সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, অস্তিত্ববান হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ যেভাবে ইচ্ছা প্রকাশ করে মানুষ মূলত তাই l মানুষ যখন কিছু হবার ইচ্ছা করে তখন তার মস্তিষ্কে যে ভাবের সঞ্চার হয় সেই ভাব হচ্ছে বিশিষ্ট সত্তা এবং যখন সে তা হয়ে ওঠে সেই অবস্থা হচ্ছে সার্বিক সত্তা। কেবল তখনই সে অস্তিত্ববান। কিন্তু মানুষ যখন কিছু হতে চায় এবং হতে পারে না, তখন তার উপস্থিতি থাকলেও সে অস্তিত্বহীন। সার্ত্রে আরও বলেছিলেন যে, কোন রকম সঙ্গত কারণ ছাড়াই আমরা পরিত্যক্ত। মানুষ স্বাধীন হবার জন্য নিন্দনীয়, দোষী। দোষী, কেননা ঐ স্বাধীনতার ভেতরেও সে নিজেকে ঠিকভাবে তৈরি করতে পারে না । অর্থাৎ অস্তিত্ববাদে ব্যক্তি স্বাধীনতার চরম উৎকর্ষ ও উত্তর আধুনিকতার অখন্ডসমগ্রতা এক অর্থে প্রায় একই।

উত্তর আধুনিকতা অতীত ও বর্তমান চিন্তার মিশ্রণকে বোঝায়, কিন্তু নন্দনতত্ত্বকে অস্বীকার করে l সাহিত্যের নানা শাখা যেমন, উপন্যাস, গীতিকবিতা, মহাকাব্য, ছোটগল্প প্রভৃতির ভেদকেও অস্বীকার করে। উত্তর আধুনিকতাবাদীদের বক্তব্য হলো শিল্পে এমন দেয়াল তুলে দেয়া যাবে না।

মেটান্যারেটিভ বা গ্রান্ডন্যারেটিভ হলো সেই সকল বৃহৎ আদর্শসমূহ যা অনেক মানুষকে এক একটা বৃহৎ ছাদের তলে আশ্রয় দিয়েছে। যেমন ধর্ম, মার্কসবাদ, সাম্যবাদ, ইতিহাস প্রভৃতি। এই সকল মেটান্যারেটিভের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লিয়েতার প্রত্যক্ষ করেছেন যে সব কিছুর ভেতর একটা ভাঙন ক্রিয়া কার্যকর রয়েছে। লিয়েতারের উদ্দেশ্য মেটান্যারেটিভ সমূহের ভাঙন এবং ভাঙনের ফলে উদ্ভুত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা। যেহেতু মেটান্যারেটিভ সমূহের প্রত্যেকটাই আদর্শগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন তাই এদের ভাঙনের প্রকৃতি বা প্রক্রিয়াও ভিন্ন। কিন্তু ভাঙনের প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু লিয়েতার বলেন নি।

উত্তর আধুনিকতা চিত্রকলা, স্থাপত্য, সাহিত্য, দর্শন কোন কিছুকেই পৃথক মনে করে না। পাশাপাশি দার্শনিকের কবল থেকেও দর্শনকে মুক্ত করতে চায়।

উত্তর আধুনিকতা শিল্পকে সস্তা করে দিয়ে সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে চাইছে। শিল্পের উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের ভেদ বাতিল করে সকল কাজকেই শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে। বাজারী বা নিম্নমানের সাহিত্যেরও একটা বিশাল পাঠক সমাজ রয়েছে। সমাজ থেকে তাদেরকে তো তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পাঠকনির্ভর সাহিত্যচিন্তার  আশ্রয় নিতে হয়। যার যতটুকু প্রয়োজন প্রবহমান সাহিত্যধারা থেকে সে ততটুকু নেবে। অর্থাৎ কোন একটি কবিতাকে একজনের যদি মনে হয় যে এটি কবিতা হয়নি তাতে কিছু আসে যায় না। অন্তত একজন পাঠকের কাছে ভালো লাগলেও কবিতাটি সার্থক।

উত্তর আধুনিকতাবাদ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন ডিসকোর্স গড়ে ওঠেনি l তাই উত্তর আধুনিকতা বিষয়টিকে অনুধাবন করা বেশ শক্ত। তবে দর্শন তত্ত্বগুলোর পরম্পরা জেনে নিলে বিষয়টি বুঝতে কিছুটা সহজ হয়। যেমন- মধ্যযুগীয় দর্শন তত্ত্বে ঈশ্বর ছিলেন কেন্দ্রে। যা কিছু হবে তা ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই হবে l এর পরে এলো রেনেসার যুগ l কেন্দ্র দখল করলো মানবতাবাদ। এরপর কেন্দ্রে  আসলো জ্ঞান l জ্ঞাননির্ভর এই দর্শনের নাম দেয়া হলো এনলাইটমেন্ট। তারপরে সব কিছুকে সরিয়ে কেন্দ্রের স্থানটাকে দখল করলো আধুনিকতাবাদ। এখানে এসে খন্ডিতভাবে প্রচুর মৌলিক চিন্তা হল l এই পর্যায়ের চিন্তকরা অনেক দিনের প্রথা, সংস্কার, কাঠামোর ছাঁচ এগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করলেন l ব্যর্থ হলেন l পরে ভাবলেন, কোন কাঠামো বা সংস্কারের ভেতর না থাকাই ভালো। এই ভেবে পরে তাদের মনে আনন্দের সঞ্চার হলো। ক্রীড়াময়তা এলো l আর এই আনন্দের যে উল্লাস বা চিৎকার তার  নাম উত্তর আধুনিকতা।

পরিশেষে, আধুনিকতার সঙ্গে উত্তর আধুনিকতার তুলনামুলক লক্ষণসমুহ চিনে নিলে সাহিত্য বিচারের কাজটি সহজ হয় l বিশিষ্ট আরব-আমেরিকান সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ও তাত্বিক সমালোচক ইহাব হাসান এভাবে তুলনাটি করেছেন -

আধুনিকতা                       উত্তর-আধুনিকতা
                  
রোমান্টিসিজম                প্যাটাফিজিক্স/ডাডাইজম
প্রতীকধর্মিতা              
ফর্ম                                 এ্যান্টিফর্ম (চক্রহীনতা,
(কাঠামোর চক্রাবদ্ধতা)           উন্মুক্তি)
উদ্দেশ্য নির্ভরতা               ক্রীড়াময়তা
শ্রেণীলগ্নতা                         নৈরাজ্য
যুক্তির শাসন                   নিস্পন্দন, নীরবতা
ফলাফলপ্রধান,
শিল্প সৃষ্টি                       অংশগ্রহণ, প্রক্রিয়াপ্রধান

সৃজন/সমগ্রায়ন             অবনির্মাণ/বিনির্মাণ
সমন্বয়                            বিরোধাভাস
উপস্থিতি                        অনুপস্থিতি
প্রকরণ/সীমা                বয়ান/অবয়ান
নির্বাচন একত্রায়ন
ব্যাখ্যা/পাঠ                     অ-ব্যাখ্যা/ভুল পাঠ
দ্যোতিত                           দ্যোতক
লক্ষণ                                 বাসনা
প্যারানইয়া                      সিজোফ্রেনিয়া
পিতা, ঈশ্বর                   পবিত্র ভূত (পবিত্র আত্মা)
অধিবিদ্যা                       আয়রনি
সিদ্ধান্ত, মীমাংসা             অমীমাংসা

** ছবিটি Samuel Beckett এর l
তথ্যসূত্র :  Wikipedia, হাসান মেহেদী