সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয় l যতো রকম শিল্পকলার কথা আমরা জানি, তার মূলত দুটো রূপ দেখতে পাই, শাস্ত্রীয় ও লোকজ l গানের ক্ষেত্রে বলতে গেলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আবার লোকসঙ্গীত l সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তেমন বলা যায় ক্লাসিক্যাল সাহিত্য এবং লোকসাহিত্য l লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চোখে পড়ে l
সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দীর্ঘকাল ধরেই হয়ে আসছে l যেমন উপন্যাসে, নাটকে একটি অঞ্চলের বিশিষ্টতা তুলে ধরার জন্য, একটা বিশেষ আঞ্চলিক চরিত্র উপস্থাপন করার জন্য আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় l
তুলনায় কাব্যকবিতায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার একটু পরে এসেছে l বিষ্ণু দে সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেছেন l লোর্কার প্রভাবে একদা ‘নববাবুভাষা’ ছেড়েছিলেন তিনি,
‘রেখো না বিলাসী কোনো আশা,
নববাবু ভাষা ছাড়ো মন ..
গ্রামে ও শহরে পাবে কবিতার ভাষা ।’
মনীশ ঘটক, অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের হাত ধরে কাব্যে আঞ্চলিক ভাষার চর্চা শুরু হয়েছে l এখন অনেকেই করছেন l সাহিত্যরসিকদের মধ্যে তার কদর বাড়ছে l
সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা দুভাবে আসতে পারে l এক, মান্য ভাষায় রচিত সাহিত্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চরিত্রের সংলাপ হিসাবে l দুই, গোটা রচনাটাই আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হওয়া l
ভাষাকে আমরা তিনভাবে পেতে পারি l
এক, কোনো একটি মূল উৎস থেকে সৃষ্টি হয়ে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে l যেমন বাংলাভাষা মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে সৃষ্ট হয়ে নানা প্রাকৃতের মধ্যে দিয়ে এসেছে l
দুই, সেই ভাষায় যাঁরা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তাঁদের হাত ধরে l বাংলাভাষা যেমন চর্যাপদের যুগ পেরিয়ে তারপরে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের হাত ধরে পূর্ণতায় পৌঁছেছে l তাঁদের হাত ধরেই বাংলা ভাষা মান্য রূপ পেয়েছে এবং ভাষার এই রূপেই মূলত বাংলা সাহিত্যের চর্চা চলেছে l
তিন, ভাষার দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে l মানুষের জীবনযাপন, তার ধরণে নিত্য পরিবর্তন, কতো নতুন জিনিসের আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি - প্রতিনিয়ত শব্দভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দ সংযোগ করে চলেছে l মানুষ তার জীবনযাপনে এই পরিবর্তনগুলিকে যেমন আপন করে নিচ্ছে, ভাষাও তেমন এই পরিবর্তনগুলির সূত্র ধরে নিত্য নতুন সাজে সেজে উঠছে l এছাড়াও ভাষার একটি ধর্ম হলো প্রতি দশ কি. মি. অন্তর ভাষার যে কথ্য রূপ তা পরিবর্তিত হয়ে চলে l তার সঙ্গে রয়েছে নানা ভৌগোলিক অঞ্চলের, তার ইতিহাসের নিজস্ব কিছু শব্দভান্ডার l মানুষের দৈনন্দিন জীবন ভাষার এই বহু বিচিত্রতা এবং নিত্য পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে চলে l এর মধ্যে দিয়ে ভাষা জীবন্ত থাকে l ভাষার যেরূপ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তা বেঁচে থাকে সেই রূপকে সাহিত্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন l এজন্যই সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কাঙ্খিত l এই ধরণের রচনায় শব্দ চয়ন ও শব্দ প্রয়োগ, আঙ্গিক ইত্যাদিও লক্ষ্যণীয় l বিশেষ করে কবিতায় ভাবগত দিক, রূপগত নির্মিতির দিকও তাৎপর্যপূর্ণ l
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিভিন্ন ধরণের আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত আছে, যেমন বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া প্রভৃতি লালমাটির দেশের ভাষা, মালদা দিনাজপুর অঞ্চলের ভাষা, কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার অঞ্চলের ভাষা - প্রত্যেকের নিজস্ব আকর্ষণ আছে l আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সাহিত্য খুবই জনপ্রিয় l সরকার থেকেও উৎসাহ দান করা হয় l সম্প্রতি সাহিত্যিক নলিনী বেরার ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাস (১৪২৫ সালে) আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে । লেখক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, ‘আজ গ্রামের লোকেদের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার লেখা সেখানকার মানুষজনকে নিয়েই।’ যে জনপদ ঘিরে এই রচনা সেখানকার মানুষজনের ব্যবহৃত ভাষা উঠে এসেছে এই রচনায় l
মানুষ পরিব্রাজক। জীবনের অন্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে কোথা থেকে কোথায় সে পৌঁছে যায় নিজেও জানে না। নলিনী বেরার জন্ম ও বেড়ে ওঠা জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রামে। । সুবর্ণরেখা নদীর তীরের মানুষদের জীবনযাত্রা কী রকম ? উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে কত কত পরিবার। তাঁদের যাপনচিত্র ইত্যাদির কথাই ফুটে উঠেছে ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাসে l উৎস থেকে মোহনায় এসে সমুখে শান্তি পারাবার দেখে তার মনে পড়ে শেকড়ের কথা। শেকড়ের খোঁজে সে ফিরতে চায় স্মৃতি-বিস্মৃতির পথ বেয়ে তার প্রত্ন-ইতিহাসে। যে ইতিহাস চর্চা থেকে উঠে আসে প্রান্তিক জনপদের কাহিনি, সাম্প্রতিককালে যা সাবল্টার্ন ইতিহাস। সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী, উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত, কত জনপদ, জনজীবন আর কত শত পরিবার। এমনই এক পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা, বিবর্ধিত ও আলোড়িত এক আশ্চর্য আখ্যান শুনিয়েছেন দলিত সাহিত্যিক নলিনী বেরা। তাঁর এই আশ্চর্য আখ্যানই এবারের আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে l
সাময়িক পত্রপত্রিকা, অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সাহিত্যকে সামনে নিয়ে আসতে হবে l সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রকৃত চর্চার মধ্যেই ভাষা বেঁচে থাকবে l