কবি লেখক লেখেন তাঁর ভেতর থেকে উঠে আসা তাগিদে l সকলে লেখেন না l যারা লেখেন তারাও সবাই একরকম তাগিদ অনুভব করেন না l লেখা একটি সাধনা এবং লেখকভেদে এই সাধনার রকমফের আছে l প্রাথমিকতা একেকজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন l প্রতিভার চরিত্রও বিভিন্ন রকমের l সবাই একরকম হতে পারেন না l দায়বদ্ধ সবাই l কিন্তু একেকজন লেখক একেক রকম দায় অনুভব করেন l বা হয়ত সচেতনভাবে কোনো দায় অনুভব করেন না l এমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখেন l লেখার নানা উদ্দেশ্য থাকে l বিনোদনের জন্য, নির্মল সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য, আবার সচেতনভাবে সমাজ সংশোধনের মানসিকতা নিয়ে l
'ঐকতান' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে দুটো কথা বলছেন l প্রথমে বলছেন
"আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,"
পরের পংক্তিগুলিতেই বলছেন,
"এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-
রয়ে গেছে ফাঁক।"
ঠিক এই সুরেই কবিগুরু তাঁর ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার কথা নানা কবিতায় নানা কথায় তুলে ধরেছেন
'এবার ফিরাও মোরে' কবিতার শুরুতে বলছেন,
"সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।"
একটু পরেই বলছেন,
"এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে, রঙ্গময়ী! দুলায়ো না সমীরে সমীরে
তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায়।
বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায়
রেখো না বসায়ে আর।"
দায়বদ্ধতার প্রশ্নে এই দ্বিধা, সংশয় বরাবর রবীন্দ্রনাথকে ভাবিত করেছে l তুলনায় নজরুল ছিলেন সংশয়হীন l নিজেকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে, "আমি যুগের কবি নই, আমি হুজুগের কবি"। নজরুল বলতে চেয়েছিলেন, যে দক্ষতার গুণে একজন কবি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকেন, সেই গুন তাঁর নেই। তাঁর যেটা আছে সেটা হলো বর্তমান সময়কে ধরে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়ার ক্ষমতা l সেটাই তিনি করে গেছেন।
'আমার কৈফিয়ত' কবিতার অন্তিম অংশে কবি বলছেন,
"বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক' মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে !
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে !
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে ।
প্রার্থনা ক'রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ ।"
তারপরেও কবি নজরুল টিকে আছেন যুগ যুগ ধরে। প্রশ্ন হলো, যদি তাঁর রচনা হুজুগে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তা কেন আজও বেঁচে আছে ? কেন মরে যায়নি ? আর এই হুজুগটাই বা কি ছিলো ?
কবি নজরুলের সাহিত্যচর্চার স্থায়িত্ব ছিল খুব কম, মাত্র চব্বিশ বছর। ১৮৯৯ সালে জন্ম, ১৯৭৬ সালে মৃত্যু, ৭৭ বছরের তাঁর আয়ুষ্কালের শেষ ৩৬ বছর ছিল সৃষ্টিহীন l ১৯৪২ সালে এক ভয়াবহ দুরারোগ্য অসুস্থতার (পিক্স ডিজিজ) মধ্যে দিয়ে নতুন করে কিছু ভাবা বা সৃজন করার ক্ষমতা হারান তিনি l তখন থেকে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি l
তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটা সত্য যে তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর অনেক ধ্রুপদী রচনা রয়েছে l রয়েছে তিন হাজারের মতো গান l
সময়টা ছিল পরাধীনতার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও দাসত্বের। ঐ সময়টার দাবী ছিল এইসব অন্যায়-দুঃশাসনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। তাই তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, গল্প সকল সৃষ্টির মধ্যে এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই সমসাময়িকতার দাবীকেই তিনি হুজুগ বলে অভিহিত করেছেন এবং এই হুজুগের লেখনী দিয়েই তিনি তাঁর সময়কে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়ার চেষ্টা করে গেছেন। তাই নিজেকে হুজুগের কবি বলে অভিহিত করতে তিনি দ্বিধা করেননি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল l ইংরেজ বিদেয় হলো। দাসত্ব গেল ঘুচে। হুজুগ তো আর থাকলো না l নজরুল কি তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন ? কিন্তু বাস্তবে তা ঘটলো না। যত দিন যেতে লাগলো নজরুল ততো বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে লাগলেন বাঙালীর কাছে।
১৯৭১ সালে নজরুলের চাহিদা অনুভূত হলো প্রবলভাবে। যে নজরুলকে দরকার হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগে, ১৯৭১ সালে সেই নজরুলের জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করলো ওপার বাংলায়। নজরুল স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধলেন নির্যাতিত মানুষের মুক্তিতে উদ্দীপনা যোগাতে l নজরুল অত্যাচারী, শোষক রাজা-হটানো বিপ্লবের আর এক নাম । সেই সূত্রে ওপার বাংলায় আরেক প্রস্থ রাজা বদল হলো l স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো l
১৯৭১ এর প্রয়োজনও মিটেছে l প্রশ্ন, তাহলে কি নজরুল অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন ? এর উত্তর হলো, প্রথমত, সমাজ থেকে শোষণ অত্যাচার এখনও পুরোপুরি মুছে যায় নি l যতদিন তা মুছে যাচ্ছে না, ততদিন নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকবেন l
দ্বিতীয়ত, হুজুগের লেখা ছাড়াও নজরুলের প্রচুর ভাল ধ্রুপদী রচনা আছে l তার জন্যই তিনি চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবেন l এছাড়াও যেগুলোকে হুজুগের লেখা বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যেও প্রচুর কালজয়ী লেখা রয়েছে l
আলোচনার মূল বিষয় ছিলো লেখক কবিদের দায়বদ্ধতা l কবি লেখক যে সমাজে বাস করেন, যে সময়ে বাস করেন, সেই সমাজ, সেই সময় কখনো কখনো অস্থির হয়ে ওঠে l বলা যেতে পারে সকল সময়ই কিছু না কিছু কারণে অস্থির l মানুষ যে পেশায় নিযুক্ত থাকেন, মানুষ যে সমাজে বাস করেন সেখানে নিয়ত একটা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাকে চলতে হয় l এই সংগ্রাম আসে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থেকে l যখন পরস্পরের স্বার্থ মেলে না, কোনো এক পক্ষ তার স্বার্থ আদায় করে নেবার জন্য বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে, তার মধ্যে দুর্নীতির পথ, হিংসার পথ থাকে l দুর্নীতি ও হিংসার পথ অবলম্বন করলে যেটা হয় যে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত, সে ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে l বলা যায় পুরো সমাজেরই স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে l
আমাদের বহুত্ববাদী এই যে সমাজব্যবস্থা, সেখানে একটি পক্ষের সঙ্গে অপর একটি পক্ষের সংঘাত লাগলে অন্য বহু পক্ষের আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে l এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রভাব পড়ে l যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি হয়, অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় l এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও আছে l কারণ রাষ্ট্রও একটি পক্ষ l
এমন সংকট যখন দেখা দেয় সেই সময়ে যারা লেখক কবি থাকেন তাদের কলম থেকে বেরিয়ে আসে, প্রথমত সেই সময়ের একটি বস্তুনিষ্ঠ চিত্র এবং দ্বিতীয়ত, তার থেকে মুক্তির পথ l এক্ষেত্রে লেখক, কবিকে সততার সঙ্গে সময়কে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এবং সাহসের সঙ্গে এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাজকে তার সঠিক পথ চিনিয়ে দেবার জন্য লেখনীর কাজ পরিচালনা করতে হয় l
কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি ? আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি বা বিভিন্ন সময়ে চলে থাকি, সেই সময়ে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে l নির্ভয়ে লেখার পরিবেশ নেই l একটা আতঙ্কের পরিবেশ রচনা করা হয়েছে l পত্রপত্রিকা, সংবাদপত্রগুলি যে সঠিকভাবে ও নিরপেক্ষভাবে বিষয়কে মানুষের সামনে তুলে ধরবেন সেই পরিবেশ যেন দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে l সংবাদপত্রগুলি একটি গোষ্ঠীর দখলে চলে যাচ্ছেন l একটা বিশেষ দল ও মতের পক্ষে সমস্ত খবরা-খবর লেখালেখি প্রকাশিত হচ্ছে l প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলিকে দেখা যাচ্ছে তারা যেন এই বিষয়গুলোতে একটি পক্ষ অবলম্বন করছেন l এমন অবস্থায় সত্তিকারের একটা নিরপেক্ষ অবস্থান কবি লেখকদের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে l
এটা কিন্তু একটা বড় সংকট l চারিদিকে অন্যায় অত্যাচার শোষণ নিপীড়ন পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে সেটা একটা সমস্যা l কিন্তু তার থেকেও বেশি সংকট হচ্ছে সেই সংকটকে যথাযথভাবে অন্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারার অক্ষমতা এবং যথার্থ পথনির্দেশ দেবার মত সাহসের অভাব l
এক্ষেত্রে লেখক-কবিদের একটা বিরাট সামাজিক দায়িত্ব আছে এবং এটা চিরকালই দেখা গেছে যে গণ আন্দোলনের পরিণতিতে অত্যাচার শোষণের এক একটি পর্ব যখন সমাজ থেকে মুছে গেছে সেক্ষেত্রে লেখক-কবিদের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল l যে সমস্ত কবি লেখক নিজের সময়ের দ্বারা আতঙ্কিত না হয়ে দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন এবং যথার্থ পথে লেখনী পরিচালনা করেছেন তারাই কালজয়ী লেখক হয়েছেন এবং তাদের লেখাগুলোই সময় ধরে রেখেছে l সময়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে আমাদের মহাসময়ের জন্য লিখে যেতে হবে এবং বর্তমান সময়ের প্রকৃত অবস্থার সঠিক চিত্রন করতে হবে এবং সেই অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বার করতে হবে l সমাজ সংস্কারের জন্য মানুষের মন সংস্কারের প্রয়োজন l তার জন্য কবি-লেখকদের নির্ভয়ে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে l
যখন লেখক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি নিরবচ্ছিন্ন সংস্কারচিন্তা ও কর্ম থেকে সরে আসেন, তখন সেটা সমাজের পক্ষে খুব বড় দুর্দিন। তখন মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দুঃশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মানুষের সামাজিক চরিত্রে সংস্কারপ্রক্রিয়া চালু রাখার কাজটা লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এই কাজ রাজা হটানো বিপ্লবের চেয়েও জরুরী ও উন্নত। একটা সর্ববঞ্চিত জাতি তার বঞ্চনা থেকে উঠে আসার জন্যে যে জিনিসটা লেখক কবিদের কাছে দাবী করতে পারে সেটা আর কিছু না, সেটা তার আবহমান কালের সামাজিক চরিত্রের সংস্কার। সেই সংস্কারপ্রক্রিয়া নিরবিচ্ছিন্নভাবে লেখক কবিদের দ্বারা চালিত হয় l
** দীপশিখা শারদীয়া সংখ্যা ১৪২৮ - ২০২১ তে প্রকাশিত