১২-০১-২০১৮ রায়গঞ্জ শহরে স্থানীয় এক সাংস্কৃতিক সংস্থার (রায়গঞ্জ কালচারাল ফোরাম) রজত জয়ন্তী বর্ষ উদযাপন এর অঙ্গ হিসাবে রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউ হলে অনুষ্ঠিত হলো সাহিত্য বাসর l রায়গঞ্জের কবি ও সাহিত্যিকেরা বাসরে স্বরচিত কবিতা ও অনুগল্প পাঠ করেন l বাংলার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এর উপস্থিতিতে এই বাসর অনুষ্ঠিত হয় l বর্তমানে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের জগতে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অতি পরিচিত নাম l বিগত বছরগুলিতে যে তিনজন মাত্র কবি পশ্চিমবাংলা থেকে মার্কিন মুলুকের আইওয়া ইউনিভার্সিটির পৃথিবী বিখ্যাত সারা পৃথিবীর সেরা কবি-সাহিত্যিকদের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে এই মানুষটি একজন।
এরকম একজন মানুষ সাহিত্যবাসরে ছিলেন বলে উপস্থিত সকলের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো l স্থানীয় কবি গল্পকারদের কবিতা গল্প পাঠ শেষে কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাকেন্দ্রিক আলাপচারিতায় অংশ নেন এবং সবশেষে কিছু স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান l
কবিতাকেন্দ্রিক আলোচনায় উঠে আসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন l যেমন,
১) কবিতার 'আমি' এবং কবি স্বয়ং এর সম্পর্ক
২) কবিতায় দুর্বোধ্যতা
৩) কবিতা কেন পড়ব ? ইত্যাদি l
প্রথম প্রসঙ্গে কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন কবিতার 'আমি' কে কবি স্বয়ং মনে করা ঠিক নয় l কবিতা একটি মুহূর্তের অনুভূতির ফল l বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন অনুভূতির কারণে নানা ধরনের 'আমি' আসতে পারে কবিতায় l এর কোনো একটি 'আমি' বা সমগ্র 'আমি'র গড় কোনোটাই সেই কবি নন l কবি হলেন এক বহমানতা l সমগ্র এক ব্যক্তিত্ব l একটি নদী কোথাও সর্বনিম্ন দু ফুট, কোথাও সর্বোচ্চ ষোলো ফুট গভীর হতে পারে l যদি কেউ দুই এবং ষোলোর গড় নয় ফিটকে নদীর গভীরতা ভেবে, নদী যেখানে বারো ফিট সেখানে নদী পেরোতে যায় তাহলে সে ডুবে মরবে l কবিতার 'আমি'কে কবি মনে করলে আমাদেরও এই ভুল হবার আশঙ্কা থাকে l
কবিতায় দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গ ওঠে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনার সময় l কবি বলেন, কেউ যখন কবিতা লেখেন, সেই কবিতা তিনি ছিঁড়ে ফেলেন না, আগুনে পুড়িয়ে দেন না, কবিতা লেখা কাগজটিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন না l তিনি কি করেন ? কবিতাটিকে প্রকাশ করেন l প্রকাশ করেন কেন ? কারণ তিনি চান যে এই কবিতা কেউ পাঠ করুক l অর্থাৎ তিনি পাঠক চান l তাহলে কবিতা রচনার সময় কবিকে পাঠকের কথাও ভাবতে হবে l কবিতা যদি পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে থাকে, তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়, তাহলে সেই কবিতা পাঠক পাঠ করবেন কেন ? আর পাঠক যে কবিতা পাঠ করবেন না, সেই কবিতা কবি লিখবেনই বা কেন ? লেখেন যদি, সেই কবিতা প্রকাশ করবেন কেন ? এরকম একশ্রেণীর দুর্বোধ্য কবিতার কারণেই আজ বাংলা কবিতার পাঠক কমছে l
কবিতা কেন পড়ব এই প্রসঙ্গে কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমরা কবিতা পড়ব যন্ত্রণা সহ্য করা শেখার জন্য l চারিদিকে আজ মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় l অর্থ, খ্যাতির পেছনে ছুটছে মানুষ l ভালোবাসা হেরে যাচ্ছে অর্থশক্তির কাছে l কবিতা এই মানবিক বিপর্যয়ের থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে l একের অনুভব থেকে লেখা কবিতা বহুজনের অনুভবকে উদ্দীপিত করে বাঁচার পথ দেখায় l
সাহিত্যবাসরে উপস্থিত মানুষজন কিছুক্ষণের জন্য যেন এক মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েন l