আজ ২৫শে বৈশাখ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ l ইংরাজি ৯ মে, ২০১৭ সাল l কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭ তম জন্মদিবস l প্রতিটি বাংলাভাষী ব্যক্তির কাছে আজ একটি পবিত্রতম দিন l স্মরণে মননে আজ বিশ্ব জুড়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হচ্ছে l
রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল মহীরুহ l বহুমুখী তাঁর প্রতিভা l অসীম তার ব্যাপ্তি l একজন বাঙালী তার শৈশব থেকে শুরু করে তার বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে পান, কিভাবে কবিগুরু আমাদের জীবন যাপনের প্রতিটি স্তরে তাঁর প্রাণের স্পর্শে আমাদের জীবনকে রূপ রঙ রসে পূর্ণ করে তোলেন এবং সাধারন জীবন-যাপনকে সুরভিময় করে তোলেন তার কিছু পরশ  পাবার চেষ্টা করবো এই আলোচনায় l
বাংলাভাষার লিখিত রূপের সাথে শিশুর যখন পরিচয় হয়ে ওঠে নি, তখনই মা কাকিমার কাছ থেকে শুনে শুনে শিশু বলে ওঠে,
"পাড়াতে এসেছে এক নাড়ী-টেপা ডাক্তার;
দূর থেকে দেখা যায় অতি উঁচু নাক তার l"
কিংবা
"কুমোর-পাড়ার গরুর গাড়ি -
বোঝাই-করা কলশি-হাঁড়ি l"
তারপর যখন ভাষার লিখিত রূপের সাথে তার পরিচয় হয়, দুলে দুলে বলে ওঠে সে,
"আমাদের ছোট নদী         চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার              হাঁটুজল থাকে l
পার হয়ে যায় গোরু          পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার,               ঢালু তার পাড়ি l  
ছন্দে তালে শিশু আবৃত্তি করে,
"নাম তার মোতিবিল,         বহুদূর জল,
হাঁসগুলি ভেসে ভেসে         করে কোলাহল l"
একটু বড়ো শিশুরা পাঠ করে,
"এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
       লেগেছে হাওয়ার 'পরে,
সকাল বেলায় ঘাসের আগায়
        শিশিরের রেখা ধরে l"
পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ছোট্ট মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে শিশু আবৃত্তি করে,
"যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি,
তবে আমি এক্ষনি হই ইচ্ছামতী নদী l"
বিদ্যালয়ের ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠানে উদাত্ত কণ্ঠে বীরদর্পে  আবৃত্তি করে,
"আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে l"
অন্য কেউ পড়ছে,
"মধু মাঝির ওই যে নৌকাখানা
        বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে -
কারো কোনো কাজে লাগছে না তো,
       বোঝাই করা আছে কেবল পাটে l"
হাসি মজা করে কেউ বা পড়ছে,
"অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি l
মুড়কির মোয়া চাই, চাই ভাজা ভেটকি l"
আবার কেউ একটু গুরুগম্ভীর স্বরে পিতার ভূমিকায় আবৃত্তি করছে,
          "ছোট্ট আমার মেয়ে
     সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে
সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে
     অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে থেমে থেমে l"
             হাতে ছিল প্রদীপখানি,
আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে চলছিল সাবধানী l"
একটু বড়ো হয়ে কিশোর বয়সে কবিকল্পনায় পূর্ণ "তালগাছ" পাঠ করে সে,
"তালগাছ          এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                         সব গাছ ছাড়িয়ে
                                উঁকি মারে আকাশে
মনে সাধ            কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
                         একেবারে উড়ে যায়  -
                                কোথা পাবে পাখা সে l"
কবিগুরুর লেখা হালকা নরম রসের রচনা, আধা বাংলা, আধা হিন্দি, তার সঙ্গে পরিচয় হয় বাঙালী কিশোরের,
"সর্বদা মন কেমন করতা, কেঁদে উঠতা হৃদয়
ভাত খাতা স্কুল যাতা সুরেনবাবু নির্দয় l"

এইভাবে বেড়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে অবস্থান করেন l তারপর শিশু যখন কলেজে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় তখন সে রবীন্দ্রনাথকে আরও নানারূপে আবিষ্কার করে l সে দেখে রবীন্দ্রনাথ শুধু শিশু কিশোরের জন্য মন ভোলানো ছড়া-কবিতাই লেখেন নি, প্রয়োজনে তাঁর কলম গর্জে উঠেছে এক বিপ্লবী নায়কের ভাষায় l নৃশংস জালিওয়ানাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেছেন এবং তৎকালীন বড়োলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠি লিখেছেন জ্বালাময়ী ভাষায় l কবি লিখলেন, "......The disproportionate severity of the punishments inflicted upon the unfortunate people and the methods of carrying them out ..... are without parallel in the history of civilised governments."
রবীন্দ্রনাথ দৃপ্ত কণ্ঠে কবিতায় বলছেন,
"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
  তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে l"
দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত রবীন্দ্রনাথ বীর বিপ্লবী সুভাষচন্দ্রকে দেশনায়ক পদে বরণ করেছেন,
"বাঙালীর কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি l"
সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে ভর্ত্সনা করে কবি লিখছেন,
"ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে l"

১৯০৫ সালে যখন বৃটিশ সরকার "Divide and Rule" এর পথ ধরে বাংলা ভাগের উদ্যোগ নেয়, তখন বাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় l এই আন্দোলনের অংশ হিসাবে বাংলা জুড়ে রাখিবন্ধন উৎসব পালন করা হয় l হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ - বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভাইবোনেরা প্রকাশ্য রাজপথে পরস্পরের হাতে রাখি পড়িয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তি দান করেন l এই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন  রাখি-সঙ্গীত,
"বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পূণ্য হউক, পূণ্য হউক,
পূণ্য হউক হে ভগবান ॥

বাংলার ঘর, বাংলার হাট,
বাংলার বন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক,
পূর্ণ হউক হে ভগবান ॥

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য হউক, সত্য হউক,
সত্য হউক হে ভগবান ॥

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক,
এক হউক হে ভগবান ॥"

আজ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় "একটি গাছ একটি প্রাণ" মন্ত্রকে সামনে রেখে সরকারী স্তরে গাছ লাগানোর প্রকল্প নেয়া হয় l  কতোদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে "বৃক্ষরোপণ উৎসব" পালন করেছেন l নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতায় হাঁপিয়ে উঠে কবি লিখছেন,
"দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর l"
অন্যত্র লিখছেন,
"আমি     ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক,
আমি      চাই না হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক l
........
যদি       পরজন্মে পাই রে হতে ব্রজের রাখাল-বালক
তবে      নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক l"

কথা, সুর ও ছন্দের জাদুকর এই রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পর্বে এসে উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব একটা ভাষা আছে যা মানুষের ভাষা থেকে আলাদা l বিশ্বপ্রকৃতির ভাষা অর্থছুট l এখানে শুধু আকারের খেলা এবং ভঙ্গির ইশারা l মানেহারা এই ভাষার জগৎটাই অন্য রকম l কিন্তু মানুষের ভাষা অর্থভারগ্রস্ত l তাই কবি অনুভব করেন মানুষের ভাষার ক্ষমতার সীমা l অসহায় বোধ করেন তিনি l তাঁর মনে হয় মানুষের ভাষা দিয়ে যা ধরা যায় না সেই অধরাকে হয়তো ধরা যায় রেখায় রঙে l তাই এই পর্বে তিনি আশ্রয় করেছিলেন চিত্রকলাকে l শব্দ ও বাক্যে - কবিতা, গল্প, শিশুসাহিত্য, উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা, গান, প্রবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, পত্রসাহিত্য - এই সব কিছুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে দৃষ্টিকে পাওয়া যায় না, তা ধরা দিয়েছে তাঁর চিত্রকলায় l
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের সাধারণ দেখাকে দৃষ্টিতে পরিণত করেন l  সকলের জন্যই তিনি কিছু না কিছু রেখে গেছেন l রবীন্দ্রনাথ সকলের l
জন্মদিনে কবিকে জানাই সশ্রদ্ধ  প্রণাম l