কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে নজরুল ইসলাম ৩৮ বছর ছোট ছিলেন l বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সাহিত্য আকাশের মধ্য গগনে নিজ প্রতিভায় দীপ্ত হয়ে বিরাজ করছেন, তখন নজরুলের আবির্ভাব l ১৯১৩ সালে ৫২ বছর বয়সে যখন কবিগুরু সাহিত্যে নোবেল পাচ্ছেন, তখন নজরুল নেহাতই ১৪ বছরের এক বালক l সবে লিখতে শুরু করেছেন l এরপর নজরুল সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন l সেখানে লড়াই সংগ্রামের অবসরে সাহিত্যচর্চা তাঁর অব্যাহত ছিল l আর ছিল রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি, রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ l নজরুলের অনেকগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ ছিল l সুযোগ পেলেই গাইতেন তিনি l তখনো পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ বা সাক্ষাত পরিচয় হয় নি l বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কিছু লেখা পাঠের সুবাদে কবিগুরু কবি, গীতিকার নজরুলকে জানতে শুরু করেছেন, ভালোবাসতে শুরু করেছেন l
সৈনিকের চাকুরি শেষ করে কবি নজরুল ইসলাম ২১ বছর বয়সে কলকাতা ফিরে আসেন ১৯২০ সালের মার্চ মাসে। কলকাতায় তাঁর আবাস হয় ৩২, কলেজ স্ট্রিট ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিস l তখন তাঁর সম্বল বলতে ছিল একটা টিনের বাক্স l যার মধ্যে ছিল কিছু কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক কিছু পত্রিকা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিছু স্বরলিপি l
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হওয়ার সুযোগ হলো ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নজরুল শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন l বাংলা সাহিত্যের দুই মহান রথীর সাক্ষাত হলো l নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে আবৃত্তি শুনতে চাইলেন l উল্টে কবিগুরুই নজরুলকে গান ও আবৃত্তি শোনাবার জন্যে জেদ করলেন l নজরুল সেদিন 'অগ্নিবীণা'র 'আগমনী' কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন l এছাড়াও কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ "মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।" আবৃত্তি করে শোনান l
এরপরও বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁদের মধ্যে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে l রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য।
১৯২১-এর ডিসেম্বর মাস নাগাদ নজরুল 'বিদ্রোহী' কবিতা রচনা করেন l এরপর নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে "দে গরুর গা ধুইয়ে" গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করেন l নজরুল রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘ 'বিদ্রোহী' কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন l রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন "সত্যিই তুই আমাকে আজ খুন করেছিস !"
১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সভাপতি l তিনি নজরুলকে ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বিশেষ স্নেহ করতেন এটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ l যদিও সমসাময়িক অনেক কবি সাহিত্যিক বিষয়টিকে ভালো চোখে নেন নি l এরকম বহু উদাহরণ আছে যেখানে রবীন্দ্রনাথ অন্যের আপত্তিকে খারিজ করে নজরুলকে গ্রহণ করেছেন l নজরুল যখন 'ধূমকেতু' পত্রিকা প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ তার জন্য আশীর্বানী লিখে দিয়েছিলেন -
"আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,
আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’
আছে যারা অর্ধচেতন!"
'ধূমকেতু' পত্রিকার ১২শ সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক প্রতীকধর্মী কবিতাটি প্রকাশিত হয় l
"আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?"
এই কবিতা লিখে ইংরেজ শাসকের রোষানলে পড়েন তিনি l নজরুলকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। ১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো মামলার রায় দেন। নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
মাত্র কয়েকদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি l নজরুল কারাগারেই আছেন l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এটি ছিল ঠাকুর পরিবারের বাইরে কাউকে বই উৎসর্গ করার প্রথম দৃষ্টান্ত l পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে কবি বলেন, "জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।"
পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, "নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।"
বইটি পেয়েই নজরুল বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, "এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।"
বইটি নজরুলকে উৎসর্গ করায় রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক খুশি হতে পারেননি। তাদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি, ... জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।"
অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।"
রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা ও নাটকেও কোথাও কোথাও বৈপ্লবিক চেতনার রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর "রথের রশি", "ওরা কাজ করে", "বাঁধ ভেঙে দাও", "তাসের দেশ" বা "রক্ত করবী"তে বিপ্লবের ঝঙ্কার অনুভব করা যায়।
১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে নজরুল অনশন করেন। এই অনশন ভঙ্গ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রাম এসে পৌঁছয় প্রেসিডেন্সি জেলে l কবিগুরু লেখেন, "Give up hunger strike, our literature claims you."
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ হলো রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে বাধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
ইংরাজি ১৮৯৬ সালে (১৩০২ বঙ্গাব্দ ফাল্গুন মাস)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি লেখেন । রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরের পাঠককে উদ্দেশ্য করে লিখছেন -
"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!"
কাজী নজরুল ইসলাম এর ঠিক ৩২ বছর পর ইংরাজি ১৯২৮ সালে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ আষাঢ় মাস) তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, প্রেম ও ভক্তি।
"আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে!"
কবি নজরুলও তাঁর 'সঞ্চিতা' কাব্যগ্রন্থটি কবিগুরুকে উৎসর্গ করেছিলেন l
বাংলা সাহিত্যের এই দুই মহান কবির মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল এই ঘটনাগুলিই তা প্রমাণ করে l যদিও এই সম্পর্কে চিড় ধরানোর জন্য সমকালে অনেক প্রয়াস হয়েছিল l "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় বা ব্যক্তিগত অনেক লেখনীতে এবং আলাপচারিতায় দুই কবির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর প্রয়াস অব্যাহত ছিল l কিন্তু সে সবকে অস্বীকার করে বাংলা সাহিত্যের এই দুই মহান কবি চিরকাল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন l মাঝে ছোটখাটো ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে l কিন্তু দুই কবির শ্রদ্ধা ও স্নেহের মৌলিক সম্পর্ক কখনও বিচলিত হয়নি। মানুষ, মানবতা নিয়ে দুজনের ভাবনায় কোনো প্রভেদ নেই। নেই ধর্মপরিচয়ের বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখার।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, "মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’" l
নজরুল লিখেন, "গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।"
সাম্য, মৈত্রী, মানবপ্রেম তথা মানবিকতার প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অগ্রনায়ক l রাজনৈতিক বিষয়-সংলগ্ন হয়েও নজরুলও তাই। রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধবিরোধী, শান্তিবাদী, বিশ্বনাগরিক এবং মানবপ্রেমী। সাধারণ মানুষের কল্যাণে নজরুলের মানবিক চেতনা সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে এক হয়েছে l
কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, "তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?" নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, "গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি...।"
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন আশি বছর, ১৯৪১ সাল, কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ কবিতাটি l
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন l তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। ঐ দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। আবৃত্তি করেন স্বরচিত ‘রবিহারা’ কবিতা l রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’, ‘সালাম অস্তরবি’, এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ কবিতাগুলি।
দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল - বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই মহান স্থপতি। তাঁদের মধ্যে গুরু শিষ্যের এই সম্পর্ক আমাদের চিরকালের সম্পদ l