কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২০ তে প্রকাশিত হলো প্রবন্ধগ্রন্থ "প্রাসঙ্গিকতায় ভাষা ও সাহিত্য" l
গ্রন্থটির ভূমিকায় 'প্রাসঙ্গিকতা' শিরোনামে রচনার প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করেছি l
সেটাই হুবহু এখানে তুলে দিলাম l
##
সাহিত্যচর্চার পথে পারস্পরিক আলোচনা, মত বিনিময়, পরস্পরের বক্তব্য শোনা, নানা সময়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক রচনা পাঠ, কখনো নিজের লেখার তাগিদে প্রাসঙ্গিক পড়াশোনা, সে সব প্রয়াসের যোগফল এই গ্রন্থ l
প্রকাশকামিতার একটি পর্যায়ে ভাষার জন্ম l ভাষা বিকাশলাভ করে, আবার ব্যবহারের অভাবে মারাও যায় l শক্তিশালী জাতির ভাষা দুর্বল জাতির ভাষাকে আক্রমণ করে l এই আক্রমণ প্রতিহত করে অনেক ভাষা টিকে থাকে l অনেক ভাষা আত্মসমর্পন করে নিশ্চিন্হ হয় l ভাষা জাতিসত্তার পরিচয় l যে জাতি তার ভাষাকে বিসর্জন দিয়েছে, সেই জাতিও বিলুপ্ত হয়েছে l অন্য জাতির সঙ্গে মিশে গেছে l ভাষাকে ঘিরে আন্দোলন একটি রাষ্ট্রেরও জন্ম দিয়েছে l
ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম l সব প্রানীরই নিজস্ব ভাষা আছে l কিন্তু একমাত্র মানুষ পেরেছে তার ভাষাকে গ্রাফিক অর্থাৎ চিত্ররূপ দিতে l কতকগুলো সাংকেতিক চিন্হ আকারে ভাষাকে লিপিবদ্ধ করেই মানুষ থেমে থাকে নি, তার সৃজনশীল মন ভাষাকে বিচিত্র রকমের শিল্প সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছে l এই পথেই এসেছে সাহিত্যচর্চা l
প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষ সবথেকে বেশি অনুকরণশীল l কিন্তু মানুষ যেহেতু একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল, তাই তার অনুকরণের মধ্যে একটা সৃজনপ্রয়াস থাকে l ফলে তা সরাসরি অনুকরণ না হয়ে শিল্পীর নিজস্ব শিল্প বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়ে প্রকাশ পায় l একই বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত হলেও শিল্পীর সৃষ্টির বৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন শিল্প সৃষ্টি হয় l এখানেই অন্য প্রাণীজগতের সঙ্গে মানুষের পার্থ্যক্য l বাবুই পাখির বাসা নির্মাণ, মৌমাছির মৌচাক নির্মাণ, উই এর ঢিবি উঁচুমাপের শিল্প l নৈপুণ্য আছে, কিন্তু তার মধ্যে বৈচিত্র্য নেই, উত্তরণ নেই l হাজার হাজার বছর আগে যেমন ছিলো, এখনো তাই আছে l কিন্তু মানুষের অনুকরণ এমন বৈচিত্র্যহীন নয় l এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব l এই বৈচিত্র্যের পথ ধরেই নানা ধরণের শিল্পকর্ম, তার নানা রূপ - চারু, কারু, ভাস্কর্য, চিত্র, সুর-সঙ্গীত সাহিত্য ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছে l
প্রকাশকামিতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি l সে প্রকাশ করতে চায় l প্রকাশ করতে চায় তার আবেগ, অনুভূতি, ধারণা, বিশ্বাস ইত্যাদি l কোথাও এই প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত, কোথাও বা ব্যাকরণ প্রকরণের সীমায় বন্দী l মানুষ দুঃখ পেলে কাঁদে, আনন্দে হাসে - এটা তার স্বাভাবিক প্রকাশ l কিন্তু ব্যাকরণ-প্রকরণ সিদ্ধ প্রকাশে হাসি কান্না আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয় l কতোটা হাসি কান্না ? কোথায় এবং কিভাবে ? এমন নিয়ম রীতি ব্যাকরণ প্রকরণসিদ্ধ প্রকাশই হয়ে ওঠে যথার্থ শিল্প l
সাহিত্য শিল্পে প্রকাশের বিষয় মানুষ খুঁজে পায় তার সমাজে, তার পারিপার্শ্বিকতায় l এই বিষয়ের সঙ্গে সে যোগ করে তার মেধা, মনন, কল্পনাশক্তি l সে নিজেকে দেখতে চায় নিজের বাইরে l নিজেকে পেতে চায় অপরের মধ্যে l তার আকাঙ্খা পরিতৃপ্তির পথ খুঁজে বেড়ায় l বাস্তব জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা তার সব আকাঙ্খ্যাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না l তাই কল্পনার জগতে সে এই পথ খুঁজে বেড়ায় l জীবনে যা পাওয়া গেলো না, কল্পনায় তা খুঁজে পেয়ে সে পরিতৃপ্ত হয় l নিজে হয়, অপরকে পরিতৃপ্তি দান করে l
মানুষ স্বভাবতই রূপ বিলাসী, সৌন্দর্য পিয়াসী l নিজের ভাবনাকে রূপাশ্রয়ী করে তোলে সে l ভাবনা যতোই সীমাহীন হোক কল্পনায় তাকে সীমার মধ্যে সৌন্দর্য্যের বাঁধনে বেঁধে সে শান্তি খোঁজে l এ সব কিছুই সাহিত্য সৃষ্টির উৎস l নিজের মনোজগতের ভাবনা প্রকাশ এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া - এটাই সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য l বহির্জগতের রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দকে আত্মগত অনুভূতির রসে সিক্ত করে প্রকাশ করা l এটাই সাহিত্যের কাজ l
কিন্তু এই প্রকাশ যথেচ্ছ নয় l তা হবে ব্যাকরণ প্রকরণের সীমার মধ্যে l এই ব্যাকরণ প্রকরণ যুগোপযোগী l যুগের প্রয়োজনে নতুন প্রকরণ এসেছে l ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এসেছে কতো আন্দোলন, কতো যুগ l বাংলা সাহিত্যের জগতে পরিবর্তন বিবর্তন প্রধানত ইউরোপীয় সাহিত্যের জগতে যে আন্দোলনসমূহ তার প্রভাবে এসেছে l এই সব কিছুই ঘুরে ফিরে যে রচনাগুলি লিখতে আমাকে প্রবৃত্ত করেছিল, বর্তমান সংকলন তারই ফলশ্রুতি l
কিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে l সম্পাদকবৃন্দ এগুলি প্রকাশ করে আমার উৎসাহ বর্ধন করেছেন l তাঁদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই l অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে "বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটে l সেখানে শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, কবি সমীর প্রামানিক, কবি সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও বহু কবি নিয়মিত গঠনমূলক মন্তব্য করে আমাকে সঠিক দিশা দিয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি l কৃতজ্ঞতা জানাই ঈশপ প্রকাশনার কর্ণধার অর্ক পাঠক মহাশয়কে যিনি সঙ্কলনটি করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছেন l