ছড়া বলতে শিশু মনোরঞ্জনের জন্য রচিত এক প্রকার ছন্দবদ্ধ পদ্য রচনার কথা ভাবা হয় l
ছড়া সাহিত্যের এক উজ্জ্বল শাখা l ছেলেভুলানো পদ্য হিসাবে এর জন্ম l কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ছড়া কেবল শিশুর জন্য রচিত হয়নি l শিশু-কিশোর, যুবক, বয়স্ক - সকল শ্রেণীর জন্য রচিত হয়েছে, ছড়ার বিভিন্ন প্রসঙ্গ থাকে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ঘটনার নরনারী বিষয়ক বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ছড়া রচিত হয় l
ছড়ায় ছন্দ ও অন্ত্যমিলের দ্বারা চটুল শব্দের সহযোগে যে কোনো বিষয়কে মজাদার ও রসাত্মক করে তোলা হয় l ছড়ায় থাকে হালকা বা চটুল চাল এবং তা পড়তে হয় দ্রুততালে l ছড়ার ক্ষেত্রে আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, এখানে অর্থ প্রকাশের ব্যাপারটিও জরুরী নয় l শুধুমাত্র অন্ত্যমিল আছে, ছন্দ আছে, কিন্তু ব্যবহৃত পদসমষ্টির কোনো অর্থ হয় না, ছড়ার ক্ষেত্রে এটা হতে পারে - ইংরাজি ভাষায় এই ধরনের ছড়াকে non-sense poetry বলা হয় l
সাধারণত ছড়া হাস্য রসাত্মক/শিক্ষামূলক/ব্যঙ্গার্থক হয় এবং ছড়া মূলত লেখা হয় শিশুদের জন্য।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া সম্পর্কে বলছেন ‘ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমানকাল প্রচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না। মিশ খাওয়ানোটাই আমার লক্ষ্য। যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারি তবেই আমার ছড়া মিশ খাবে, নয়তো নয়।’
বুদ্ধদেব বসু ছড়া সম্বন্ধে বলছেন, ‘আধুনিক কবির হাতে ছড়া বের হতে পারে শুধু এই শর্তে যে, তিনি বক্তব্য কিছু দেবেন, অথচ সেটুকুর বেশি দেবেন না যেটুকু এই হালকা ছোট চটুল শরীরে ধরে যায়। একেবারে সারাংশ কিছু না থাকলে তা নেহাতই ছন্দের টুংটাং হয়ে পড়ে, মাত্রা একটু বেশি হলেও আর ছড়া থাকে না।’
ছড়াকার আবদুর হাসিব ছড়া প্রসঙ্গে বলছেন, ‘ছন্দ আর অন্ত্যমিলের প্রতি যত্নশীল হয়ে হালকা চালে সহজ শব্দের সমন্বয় সাধন করে বিষয়কে প্রকাশ করবার জন্যে যে পদ বা পদ সমষ্টির সৃষ্টি করা হয় তাকে ছড়া বলে।’
অনেকেই ছড়াকে শুধু শিশু ভোলানোর উপায় হিসেবে দেখে থাকেন l তার বাইরে যেতে পারেন না, ভাবতে পারেন না l বড় মনের, সময় উপযোগী, বলিষ্ঠ বক্তব্যযুক্ত ছড়াকে শিশুতোষ নয়, এই যুক্তিতে বাতিল করেন l তাঁরাই দায়ী থাকেন ছড়ার জগৎকে এইভাবে শুধু শিশুদের খুশি করা, শিশুদের তুষ্ট করা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর উপাদান হিসেবে সংকুচিত করে রাখার জন্য l ফুল, পাতা, জীবজন্তু, কিছু প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে সুর তাল ছন্দে গেঁথে শিশু ভোলানোর মাধ্যম করে তারা ছড়াকে বেঁধে রেখেছেন l ছড়া মানুষ উপযোগী, সময় উপযোগী, চিন্তাশীলতা বহনকারী, এবং সমাজ ও জীবন পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি ধারণকারী l কবিতা যা পারে, সেই বক্তব্য ছড়া অনেক বেশি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে এবং সেটা খুব সহজে মানুষের মনের কাছে পৌঁছে যায়, যেহেতু ছড়া সহজবোধ্য l ছড়ার ছন্দ, শব্দের ঝংকার এগুলি তার অস্ত্র l ভারী বক্তব্য বহনকারী ছন্দবদ্ধ ছড়ার পদগুলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবাদ বাক্যসম মনে হয়, যার আবেদন কালকে ছাড়িয়ে যায় এবং এখনও এ ধরনের ছড়া লেখা হচ্ছে l কিন্তু ছড়া সম্বন্ধে কিছু পশ্চাৎপদ ধারণার কারণে ছড়ার শক্তি দৃষ্টিগোচর হয় না l ছড়াকে তাঁরা ননসেন্স রাইম করেই রেখে দিতে চান l ছড়া যে সেন্সযুক্ত হতে পারে এবং অসাধারণ সেন্সযুক্ত হতে পারে, সমসাময়িক নানা বিষয়ে অসাধারণ টিপ্পনী করতে পারে, এই সহজ-সরল সাহিত্যিক সত্য মেনে নিতে হবে l আসলে সাহিত্যচর্চা শুধু আরামকেদারায় বসে বিলাস বিনোদন নয় l ছড়া যে মানুষের জীবনযুদ্ধের সাথী হয়ে উঠতে পারে, তার প্রতি মূহুর্তের জীবনযাপন, তার জীবনসংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে একথাটা ভাবতে হবে l
ছড়াকারদের নিয়ত চর্চার মধ্যে দিয়ে ছড়াকে তার উপযুক্ত স্থানে উন্নীত করতে হবে এবং প্রকৃত বলিষ্ঠ ছড়াকারদের দ্বারাই এটা সম্ভব l
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ছড়া কেবল ছেলেভুলানো খেলনা নয়, ছড়া প্রকৃত অর্থেই মানব জীবনের বেঁচে থাকার একটা রসদ l সব বয়সের, সব মনের, এবং সব কালের l ছড়ার দোলা, ছড়ার ঝঙ্কার একটি আধো আধো কথা বলতে শেখা শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকেই সমানভাবে আকর্ষণ করে l
ছড়া কোনোকালেই শুধু শিশুতোষ ছিলনা l যখন - বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যা দান - এই ছড়া এলো তখন সে ছড়ার মধ্যে শিশু কল্পনা কম, সমাজ বাস্তবতা ছিলো বেশি l এর মধ্যে বহু বিবাহের চিত্র আছে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার যে বেদনা, অসহায়তা, সেটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল l কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বাধ্য হচ্ছেন একজন পাত্রকে তিন কন্যা সমর্পণ করতে l শিব ঠাকুর নামে মাত্র পৌরাণিক, তাঁর স্ত্রী সংখ্যা তিন l বাঙালি এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে স্ত্রীর সংখ্যা একাধিক l এখানে কল্পনা কোথায়? সবটাই বাস্তব। অতীত তিক্ত স্মৃতি কতগুলি শব্দচিত্রে জমাট বেঁধে আছে l বিবাহে এক কন্যাকে বধূরূপে এবং তার বোনকে যৌতুক হিসেবে পাওয়ার প্রথা আছে যে পরিবারে, সেই পরিবারে এরূপ ছড়ার জন্ম হয়েছেl 'গোপীচন্দ্রের গান' নাথসাহিত্য, নাথ সম্প্রদায়ের উচ্চ পরিবারে এরূপ বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল l একই পরিবারে একাধিক কন্যার পানিগ্রহণ প্রথা নৃতত্ত্বের পরিভাষায় sororal polygamy নামে অভিহিত।
ছেলে ভোলানো এমন অনেক ছড়ার কত অংশ স্বপ্ন, আবার কত অংশ বাস্তব l স্বপ্ন সামান্যই, বাস্তব কথা অনেক বেশি। এই ছড়াগুলিতে মানুষ, সমাজ, সংসার, প্রকৃতি, বিশ্বলোকের নানা বাস্তব চিত্র আছে l "যাদু এত বড় রঙ্গ" ছড়ায় বোন সতীনের উল্লেখ আছে l
যখন - শিশু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে ? - ছড়া এলো তখন তার মধ্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপর উচ্চ বর্গের মানুষের যে অত্যাচার, খাজনার জুলুম, এই বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে l জমিতে আবাদ নেই, তবু রাজাকে কর দিতে হবে, কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর যুগে যুগে শাসকশ্রেণীর এই যে শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার - সেটাই ছড়াতে ফুটিয়ে তুলেছেন কতো নাম না জানা কবি ছড়াকার l
অন্নদাশঙ্কর রায় যখন লেখেন - তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকির পরে রাগ করো, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা ? - তখন এই ছড়া আর শুধু শিশুতোষ ছড়া থাকে না l দেশভাগের যে যন্ত্রণা, তা ফুটে ওঠে l
ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য আছে l গুরু, লঘু - সব ধরনের বিষয় এবং হাস্য, ব্যঙ্গ, করুণ, শান্ত - নানা ধরনের রস নিয়ে ছড়া নির্মিত হয়।
ছড়া শুধু শিশুদের ঘুম পাড়ায় না, বড়দের ঘুম তাড়ায়ও l