বাংলা কবিতার যাত্রাপথ হাজার বছরেরও বেশি l এই চর্চা শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে চর্যাপদ দিয়ে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ l এ নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে কিছু মতভেদ আছে l যেমন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন। বর্তমানে আমরা রয়েছি ২০২৩ সালে l মাঝের এই যে প্রায় হাজার বছর সেই সময়ে বাংলা কবিতা যে পথ পরিক্রমা করেছে, চর্যাপদের যুগের পর এসেছে আদি মধ্যযুগে বড়ু চণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস রচিত বৈষ্ণব পদাবলী, কবি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণ এর অনুবাদ, বিভিন্ন কবির লেখা মনসামঙ্গল কাব্য প্রভৃতি l অন্ত মধ্যযুগে পাই বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাস রচিত পদাবলী, কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের শাক্ত পদাবলী, মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্য, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্য প্রভৃতি, কিছু প্রেমকাব্য, ময়মনসিংহ গীতিকা, নাথ কাব্য, বিভিন্ন গাথা কাব্য, মহাভারতের অনুবাদ, বাউলগান, কিছু অপ্রধান মঙ্গলকাব্য, সর্বোপরি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য প্রভৃতি l এছাড়াও ধাঁধা, ভাদুগান টুসুগান অন্ত মধ্যযুগের সৃষ্টি l আধুনিক যুগের পথ চলা শুরু হল ঈশ্বর গুপ্ত, বিহারীলাল চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখের হাত ধরে l বলা চলে, রবীন্দ্রনাথে এসে বাংলা কবিতা একটা সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছিল,  বিশ্বমান ছুঁয়েছিল l পরেও অনেক কবি এসেছেন এবং  বাংলা কবিতার যাত্রাকে চলমান রেখেছেন l
আধুনিক যুগে শুরু হলো গদ্যের প্রচলন l ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উক্ত কলেজের লেখকরা নতুন করে গড়ে তোলেন বাংলা গদ্য। এ গদ্য বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে অনেকখানি পরিষ্কার করেছে। মুদ্রণযন্ত্র অর্থাৎ ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিশেষ সাহায্য করেছে। এর ফলে সাহিত্যে আসে নতুন বৈচিত্র্য। এ সময় গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। প্রথম উপন্যাস রচনা করেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভরা মজার কাহিনী লেখেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

সময়ের বিচারে বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ এরকম l প্রাচীন যুগ (৯০০-১২০০), মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০), আধুনিক যুগ (১৮০০- চলছে) l  ১২০০ থেকে ১৩৫০ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ, বন্ধ্যা যুগ, মাৎস্যন্যায় যুগ l কেন এমন নামকরণ ? কারণ এই সময় কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি l তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তার কারণ কি ? এই সময়ে জাতীয় অবস্থা ছিল খুব খারাপ, তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙালি জাতি ছিল বিপর্যস্ত l রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা ছিল ডামাডোলগ্রস্ত l তাই হয়তো এই যুগের কোন সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি l

আমরা মোটামুটিভাবে বাংলা কবিতা তথা সাহিত্যকে তিন ভাগে ভাগ করে বুঝলাম l কিন্তু যখন আমরা "বাংলা কবিতায় আধুনিকতা" বিষয়টির আলোচনায় যাব তখন আমরা এই যুগ বিভাজন আর মাথায় রাখবো না l কারণ আধুনিক কবিতা বলতে আমরা বিশেষ কোনো সময়ের কবিতাকে ধরি না, কেউ ধরেন না, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ধরেন নি l রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "পাঁজি মিলিয়ে মডারনের সীমানা নির্ণয় করবে কে ? এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা । নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডারন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক । এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে ।"  তাহলে রবীন্দ্রনাথ যেটা বলছেন আধুনিকতা কোন সময় সাপেক্ষ বিষয় নয়, সব যুগেই আধুনিক মর্জির কবিতা রচিত হয়েছে l সেটা প্রাচীন যুগেও হতে পারে, মধ্যযুগেও হতে পারে আবার আধুনিক যুগেও হতে পারে l তাহলে এটাই দাঁড়ালো যে আধুনিকতা বিষয়টি কোন সময়নির্ভর নয়, কতগুলি বৈশিষ্ট্য নির্ভর। যখন আমরা আধুনিক কবিতা বিষয়টি বলি তখন আমাদের মনের মধ্যে যে চিন্তা, যে ভাবনা কাজ করে যায় সেটা হলো পুরনো সংস্কারগুলি ভেঙে যাচ্ছে, নতুন সংস্কার নির্মিত হচ্ছে, পুরনো মূল্যবোধগুলি ধাপে ধাপে পাল্টে যাচ্ছে, নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ভাষার ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। কবিতায় যে রূপকল্পগুলি ব্যবহৃত হয়, চিত্রকল্পগুলি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর ক্ষেত্রেও হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। সময়ের একটা সাক্ষ্য থাকছে রচনার মধ্যে l বিভিন্ন সময়ে আমাদের সমাজ যে পরিবর্তন বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে, ইতিহাস প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন হচ্ছে, যুগে যুগে যে নতুন আবিষ্কারগুলো হচ্ছে সেগুলি কবিতার গায়ে, সাহিত্যের গায়ে তার সাক্ষ্য রেখে দিয়ে যাচ্ছে l যখন টেলিফোন আবিষ্কার হলো তখন টেলিফোনকেন্দ্রিক কিছু সাহিত্যের বিষয় আসলো l দূরদর্শন আবিষ্কার হলো, মোবাইল আবিষ্কার হলো, পেনিসিলিন আবিষ্কার হল, এই সব কিছু সাহিত্যের গায়ে তার  সাক্ষ্য রেখে গেল l যে সাহিত্য এই সাক্ষ্য বহন করে সেটাই আধুনিক l পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গেল l এই যে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেল, এই বিষয়কে কেন্দ্র করে যদি কোন সাহিত্য রচিত হয় সেটা পেনিসিলিন আবিষ্কারের আগে সম্ভব ছিল না। অবশ্য কল্পবিজ্ঞানে অনেক ভবিষ্যৎ আবিষ্কারকে বিষয় রেখে সাহিত্য রচিত হয় l যেমন যখন ডুবোজাহাজ আবিষ্কৃত হয় নি তখন ডুবোজাহাজ কল্পনা করে জুল ভার্ন লিখেছিলেন *টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি* l কিন্তু এটা ভিন্ন বিষয়, এটাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই চিহ্নিত করব l তাহলে দেখা যাচ্ছে আধুনিক কবিতা সময়নির্ভর নয়, তার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং সেই বৈশিষ্ট্যগুলি বহন করে যে কবিতা সেটাই আধুনিক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন কবিতা লিখছেন তখন সেই যুগে কবিতাচর্চার যে ভাষা বিদ্যমান ছিল, যে রীতি বিদ্যমান ছিল, তিনি তার মধ্যে না গিয়ে এক নতুন ছন্দ আবিষ্কার করলেন, অমিত্রাক্ষর ছন্দ l অর্থাৎ চরণ অন্তে অন্তমিলের বাধ্যবাধকতা থাকল না l ভাব এক চরণ থেকে অন্য চরণে প্রবাহিত হল, ছেদ যতির স্বাধীনতা এলো l অর্থাৎ ভাবকে তিনি পয়ারের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে চরণান্তে প্রবাহিত করলেন l মিলটনের ব্ল্যাংক ভার্স ছন্দের অনুকরণে বাংলায় এল অমিত্রাক্ষর ছন্দ, যা প্রবহমান পয়ার নামেও অভিহিত l মধুসূদন যে শব্দগুলি তার কাব্যে ব্যবহার করলেন সেটাও তৎকালীন ব্যবহৃত শব্দ থেকে অনেক আলাদা l তিনি সংস্কৃত ভাষা থেকে বহু শব্দ নিলেন l বাংলা শব্দ ভান্ডার থেকে অনেক জানা-অজানা শব্দ নিয়ে তিনি তাঁর কাব্যে ব্যবহার করলেন l মূল্যবোধের প্রশ্নে মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্যে রাবনকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত করলেন l
ইশ্বর গুপ্ত, তাঁর লেখার ধরনটিও ছিল অভিনব, সেই অর্থে তিনি আধুনিক l কিন্তু যাঁর হাতে বাংলা কাব্য সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তিনি সর্বার্থেই আধুনিক।

কিন্তু এরপরেও বিংশ শতাব্দীর ৩০ এর দশকে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে একটা আন্দোলন হয়েছিল যেটা ত্রিশের আন্দোলন নামে পরিচিত, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পঞ্চপান্ডব কবি। এটাকে বলা হচ্ছে রবীন্দ্র উত্তর সময় l এই সময়ে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে একটা আধুনিকতার আন্দোলন হয়েছিল l আবু সয়ীদ আইয়ুব এই সময়ের সাহিত্যকে সংজ্ঞায়িত করছেন এইভাবে, "সময়ের দিক থেকে মহাযুদ্ধ উত্তর এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত বা মুক্তি পিয়াসী" l
রবীন্দ্র উত্তর সময় বলছি বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই সময়ের মধ্যে থেকে গেছেন l এই যে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই সময়ে আন্দোলনটি হল তা কতগুলো ঘটনা পরম্পরার পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছিল l প্রথমত ছিল, রবীন্দ্রনাথের কাছে এই কবিদের নিজেদের নতুন প্রমাণ করার তাগিদ, যেহেতু তখন বাংলা সাহিত্য পুরোটাই ছিল রবীন্দ্র প্রভাবময় l এছাড়াও এই যুগে কতগুলো ঐতিহাসিক, সামাজিক ঘটনাও দায়ী ছিল l যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ l রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে মানুষের একটা কল্যাণময় চিত্র তুলে ধরেছিলেন, বলেছিলেন "অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো", মানুষকে তিনি ঈশ্বরসদৃশ করে এঁকেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন l কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মানুষের হিংস্র রূপ, যেখানে মানুষ তার স্বজাতিকেই নৃশংসভাবে হত্যা করছে l ফলে মানুষের সেই কল্যাণময়,  ঈশ্বরসদৃশ রূপ আর থাকলো না l এই সময় ইংরাজি সাহিত্যে কিছু নতুন ধারার কবিতা লেখা হতে লাগলো l টি,এস, এলিয়ট লিখলেন "দা ওয়েস্ট ল্যান্ড" (১৯২২),  লিখলেন "হলো ম্যান"l যে ভূমিরূপকে আমরা কল্পনা করেছি "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা", কিংবা "সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং, শস্য শ্যামলাং", এলিয়ট সেই ভূমিরূপকে চিত্রিত করলেন অনুর্বর জমি হিসেবে, বিশ্বযুদ্ধে অতিরিক্ত বোমাবর্ষণের ফলে জমিগুলো এই রূপ নিয়েছে। l যে মানুষকে রবীন্দ্রনাথ হৃদয়বান করে এঁকেছেন এলিয়ট সেই মানুষকে আঁকলেন যেন তার মধ্যে রক্ত মাংস নেই, খড়কুটো দিয়ে পূর্ণ আছে তার দেহ l এজরা পাউন্ড, ডাব্লু বি ইয়েটস একই ধারার কবিতা লিখতে থাকলেন l মানব জীবন নিয়ে নানা সংশয়, নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হল এই শ্রেণীর কবিতায় l ইংরেজি সাহিত্যে সুশিক্ষিত পঞ্চপান্ডব কবিদের হাত ধরে এর প্রভাব পড়ল বাংলা কবিতায় l নতুন ধারার কবিতা লেখা হতে লাগলো বাংলা ভাষায় l এবং এই যে নতুন ধারার কবিতাচর্চা শুরু হলো, সেগুলো হল বিভিন্ন পত্রপত্রিকাকে আশ্রয় করে l প্রথমত কল্লোল পত্রিকা l তার দেখাদেখি পরিচয় পত্রিকা, কবিতা পত্রিকা এলো l এই বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ যে কাব্য পরিবেশ রচনা করেছিলেন, মানুষ প্রকৃতির যে ছবি এঁকেছিলেন, সেটাকে ভেঙে দেয়ার প্রয়াস হল এবং মানব জীবনের যে সংশয়, যে জটিলতা, যে রুক্ষতা, সেগুলোকে কবিতার মধ্যে আনা হলো l এবং যেহেতু তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন ফলে তাঁদের কবিতায় বিশ্ব সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ এলো, গ্রিক পুরাণ ইত্যাদি, ফলে ধারে, ভারে, জটিলতায় কবিতাগুলো সাধারণ পাঠকের বোধসীমার বাইরে থেকে গেল l পঞ্চপান্ডব কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ বাদে বাকি সকলের (সুথীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে) কবিতায় একটা মননচর্চা লক্ষ্য করা গেল, তারা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখলেও তাদের নজর ছিল সারা বিশ্বের দিকে, ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তো বটেই, এই আন্তর্জাতিকতার শিক্ষা তারা রবীন্দ্রনাথ থেকেও গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু এদের মধ্যে অনেকের কবিতাই এই চিন্তনের ভারে, এই মননের ভারে, বেশ খানিকটা জটিল হয়ে গিয়েছিল, এইখান থেকেই আসছে বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, যেন এই কবিতা অল্প কিছু নির্বাচিত পাঠকের জন্য রচিত। এমন পাঠক যিনি মননশীল হবেন, ফোকাসড হবেন l এমন পাঠকই কেবল সুধীন্দ্রনাথ পড়বেন, অমিয় চক্রবর্তী পড়বেন, বিষ্ণু দে পড়বেন  l
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের সবথেকে বড় অবদান হলো এই যে একই ধারায় প্রবাহিত হয়েও তিনি দেখালেন বাংলা কবিতা একইসঙ্গে মেধাজীবি হবে এবং হৃদয়বান হবে l অর্থাৎ কবিতার আবেদন থাকবে মগজ এবং আবেগ উভয়ের কাছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমাদের কাছে এই সত্য নতুন করে আবার উপস্থাপিত করল l জীবনানন্দ দাশের কবিতা পঞ্চপান্ডবের অন্য কবিদের মতো তত্ত্ব ভারাক্রান্ত নয়, গ্রিক পুরাণ এবং ভারতীয় পুরাণ কথাকে এত আচ্ছন্ন করে নেই l সেখানে আছে আমাদের সকলের পরিচিত পৃথিবী, তার প্রকৃতি l পৃথিবীর কান্না, হাসি আবেগ আছে, এবং নতুনত্বের মোড়কে আছে l যেটা নেই সেটা হলো কাঠিন্যের মোড়ক l ফলে জীবনানন্দের কবিতা হয়ে উঠলো পাঠকপ্রিয় l এইখানেই তিনি স্বতন্ত্র l তাঁর কবিতায় একইসঙ্গে আছে বুদ্ধির দীপ্তি এবং আবেগের বিচ্ছুরণ l জীবনানন্দ ছিলেন প্রখর ইন্দ্রিয় সচেতন কবি। তাই তিনি অনুভব করেন ঘুমের ঘ্রাণ, রৌদ্রের গন্ধ, নরম জলের গন্ধ, ঝিঁঝির গন্ধ, মেয়েলি হাতের স্পর্শ প্রভৃতি। তাঁর রচিত চিত্র গুলি যেন দু-একটা টানেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে l জীবনানন্দ  দাশের কবিতার বিরুদ্ধেও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল কিন্তু তার কবিতার চিত্রময়তা, আবেগময়তা, রোমান্টিকতা এই অভিযোগ  টিকতে দেয় নি l বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কবি বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বলছেন "ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর নিপুণতা অসাধারণ। তার উপর ছবিগুলো শুধু দৃশ্যের নয়, গন্ধের ও স্পর্শের ও বটে" l তিনি রূপসী বাংলার কবি l বাংলার গ্রাম প্রকৃতির যে চিত্রায়ন তাঁর কাব্যে ফুটে উঠেছে এমনটি আর কোথাও নেই l রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "চিত্ররূপময়তা"- ই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি ও জীবনের নানা চিত্র রচনায় তিনি অসামান্য।

রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজেদের নতুন প্রমাণ করার তাগিদে এই যে ৩০ এর দশকে পঞ্চপান্ডব কবিদের এবং পরবর্তীকালে আরো বহু কবির সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন থেকে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে রাখা যায়নি, রবীন্দ্রনাথও নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার বহু কবিতা লিখেছেন l রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ কাব্য জীবনের সুবাদে নিজেই একাধিক যুগকে দেখেছেন এবং তার অংশ হয়েছেন l বাংলা কবিতায় আন্তর্জাতিকতার প্রবেশ তাঁর হাত দিয়েই শুরু l
একটা বিষয় বলে এই আলোচনা শেষ করব l সাহিত্যের জগতে, কবিতার জগতে বিভিন্ন সময়ে যে পরিবর্তনগুলি হয়, আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো সেই পরিবর্তনগুলি কোন ক্ষেত্রে হয় l সাহিত্যের মধ্যে দুটি বিষয় আছে - একটি তার কন্টেন্ট, আরেকটি তার ফর্ম l সাহিত্যের কনটেন্ট চিরকাল এক থাকে l সাহিত্যের মূল বিষয় হচ্ছে মানুষ। এই মানুষ নিয়েই সব যুগে সাহিত্য রচিত হয় l মানুষকে নিয়ে যত রকমের ভাবনা সেটাই সাহিত্যের বিষয়, সব যুগে, সব দেশে, সব ভাষায় l মানুষের আনন্দ, তার দুঃখ, তার রাগ, স্বপ্ন, তার প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, তার ভালোবাসা, বিরহ - এগুলিই কাব্য কবিতা সাহিত্যের বিষয় l এই বিষয় সব যুগেই সমান l মানুষকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় না। তাহলে পরিবর্তনগুলি কোন ক্ষেত্রে হয় ? তার রূপের ক্ষেত্রে হয়, ভাষার ক্ষেত্রে হয়, উপমা অলংকার রূপকল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে হয়, অভিনব উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে হয় l যে ভাষায় চর্যাপদের কবিরা পদ রচনা করে গেছেন, মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের কবি বা বৈষ্ণব পদাবলীর রচয়িতারা সেই ভাষায় কাব্য রচনা করেননি l যে ভাষায় মধ্যযুগের কবিরা কবিতা লিখেছেন পরবর্তীকালে আধুনিক যুগের কবিরা সেই ভাষায় কবিতা লেখেন নি l ভাষার ক্ষেত্রে, শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে, অলংকার উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে, চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে, উপস্থাপনের ক্ষেত্রে, নানা ধরনের নতুন প্রয়োগ দেখা গেছে, সেখানেই কবিতা বা সাহিত্য আধুনিকতার চরিত্র অর্জন করেছে l এর সঙ্গে থাকছে সময়ের একটি সাক্ষ্য l যে সময়ের যা ঘটনা, যা আবিষ্কার, সেগুলি সাহিত্যের গায়ে, কবিতার গায়ে তার সাক্ষ্য রচনা করে যাচ্ছে।   এটাই আধুনিকতা l তাহলে আধুনিকতা বলতে আমরা কোন নির্দিষ্ট সময় বুঝি না, আমরা বুঝি কিছু চরিত্রের কথা, কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা, এমন বৈশিষ্ট্য সম্বলিত রচনাই আধুনিক l আধুনিকতার আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রশ্ন করার মানসিকতা l যারা আধুনিক কবি তারা যে যুগেই বাস করুন না কেন, তারা তৎকালীন সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করে গেছেন l এই প্রশ্ন যিনি করবেন তিনিই আধুনিক l তিনি যে যুগেই থাকুন না কেন l

** চাতক সংকলনে প্রকাশের জন্য প্রেরিত