আসরে অনুবাদ কবিতার প্রকাশ নিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে আসরের পাতায় l কবি অর্ক রায়হান, প্রবীর চ্যাটার্জি, কবীর হুমায়ুন তাঁদের মতামত রেখেছেন l মন্তব্য আকারে পেয়েছি মাননীয় এডমিন এবং কবি প্রণব মজুমদারের বক্তব্য l অনুবাদ কবিতার প্রকাশ বিষয়ে সকলেই সদর্থক মতামত দিয়েছেন l যা কিছু সংশয় ছিল, সম্প্রতি ৩১-১২- ২০১৭ আসরে প্রকাশিত কবি হুমায়ুন কবীরের আলোচনায় করা মন্তব্যে মাননীয় এডমিন তার নিরসন করেছেন l
এডমিন ০১/০১/২০১৮, ০৭:৫০ মি:
".... এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে মৌলিক অনুবাদ কবিতার আসরেই প্রকাশযোগ্য।
....
মনে রাখতে হবে, কবিতার আসর শুধুমাত্র কবিতার জন্য। এখানে প্রকাশিত প্রতিটি লেখায় তাই কবিতাই শুধু মূল উপাদান হতে হবে। অনুদিত কবিতার সাথে মূল কবির পরিচিতি সহ অন্যান্য আরও তথ্য যোগ করা হলে সেটা আর শুধু কবিতা থাকছে না। তাই এরকম বিস্তারিত আলাপন শুধুমাত্র আলোচনা সভায় প্রযোজ্য।
....
নতুন নিয়ম (খ-৭):
ভিন্ন ভাষার কোনো কবিতার মৌলিক অনুবাদও কবিতার আসরে প্রকাশ করা যাবে। তবে সেক্ষেত্রে মূল কবিতার নাম, কবির নাম, কোন ভাষা থেকে অনুদিত হয়েছে এসব তথ্য অনুদিত কবিতার নিচে উল্লেখ করতে হবে। সম্ভব হলে মূল কবিতাটি কিংবা কবিতার লিঙ্কও দেয়া যেতে পারে কবিতার সাথে। তবে কবিতার বাইরের অন্যান্য সব তথ্য সংক্ষেপে দিতে হবে, যেন এখানে কবিতাটিই মুখ্য হয়, আনুষঙ্গিক আলোচনা না। মূল কবির পরিচিতি, অথবা মূল কবিতার ওপর অন্যান্য তথ্য বা অভিমত দিতে হলে সেটা আলোচনার পাতাতেই কেবল হতে হবে, আসরে না।"
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অনুবাদ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন l এর ফলে উভয় ভাষার সাহিত্যই সমৃদ্ধ হয় l অনুবাদের মধ্যে দিয়ে মূল সাহিত্য বেশি বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় l আর যে ভাষায় অনুবাদ হলো সেই ভাষার সাহিত্য মূল ভাষার সাহিত্যের বহু প্রয়োগ আত্মস্থ করে l এভাবেই বাংলা সাহিত্য ঊনবিংশ-বিংশ শতকে ইংরাজি, ফরাসি, জার্মানি সাহিত্যের বহু প্রয়োগের সার্থক অনুশীলন করেছে
অনেক কবি সাহিত্যিকের কাছেই অনুবাদ বিষয়টি খুব প্রিয় l এক ভাষায় প্রকাশিত কবিতা অন্য একটি ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হওয়া সেই কবিতার জন্য এবং সেই ভাষার জন্য গৌরবের l অনেক পাঠকের পক্ষেই অনেকগুলি ভাষা জানা সম্ভব নয় l অনুবাদের মধ্যে দিয়ে একজন পাঠক যে ভাষা তিনি জানেন না সেই ভাষার সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারেন l
কবিতার ক্ষেত্রে যদিও অনুবাদ বিষয়টি বেশ কঠিন এবং মূল ভাষার ভাব ও রস অনুবাদে কতখানি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব এবিষয়ে অনেকেই সন্দিহান l ইংরেজ কবি ডব্লু বি ইয়েটস ১৯১২-১৩ সাল নাগাদ কবিগুরুর ইংরাজি 'গীতাঞ্জলী' কাব্য, যা ছিল কবির অন্য কিছু বাংলা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত বাংলা কবিতার ইংরাজি অনুবাদের একটি সংকলন, তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন l 'গীতাঞ্জলি'র ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন l সেই ইয়েটসই ১৯৩৫ সাল নাগাদ কবিগুরুর ইংরাজি অনুবাদের সমালোচনা করেছিলেন l এটা অনেকেরই মত যে কবিগুরুর বাংলা কবিতাগুলি পড়ার পর তার ইংরাজি অনুবাদগুলি পড়লে সমান সন্তুষ্টি আসে না l গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রেও কথাটি খাটে l রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাহিরে' এর ইংরাজি অনুবাদ প্রসঙ্গে ই. এম, ফরস্টার মন্তব্য করেন, "এর বিষয়বস্তু এত সুন্দর, কিন্তু তার মনোহারিত্ব হারিয়ে গেছে অনুবাদে" l
বিশিষ্ট দার্শনিক ভলতেয়ার, বোদলেয়ার কবিতার ক্ষেত্রে অনুবাদ বিষয়টিকে অনুমোদন করেন নি l
অনুবাদ বিষয়টি নিয়ে তাই বিতর্ক আছে l দুটি ভাষার মধ্যে মৌলিক ভাবগত পার্থক্যের কারণে এটা হয়ে থাকে l এর সঙ্গে স্থান-কাল-পাত্র বিষয়গুলিও থাকে। অর্থাৎ একটি সাহিত্যকর্ম যে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যে সমাজশৈলীতে সত্যদ্রষ্টা লেখকের মননে স্বতস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠে, অন্য একটি ভাষা-সংস্কৃতিতে তা হুবহু সৃজন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার । তাই অনুবাদসাহিত্যে মূল সমাজের অনুভূতি ও মিথস্ক্রিয়াগুলো পাঠকের কাছে একটা আধো ছায়া, আধো আলোর মতো মনে হয়। পাঠক যেন তার যথার্থতায় বিশ্বাস করে না। একটা অজ্ঞাত অবিশ্বাস নিয়েই শুরু হয় পড়া। তবে মূল ভাষার অন্তর্নিহিত সারসত্তা যখন নিংড়ে বেরিয়ে আসে অনুবাদে, অনুবাদ শিল্পকর্মটি তখন যথার্থ হয় l
এখন অনুবাদ বিষয়টি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে l অনেকেই করছেন l শুরুটা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু l তাঁর করা বোদলেয়ার এর কবিতার বাংলা অনুবাদ বাংলা কবিতার চলন-ধারা বদলে দিতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল।
অনেক সময় অনুবাদের অনুবাদ হয় l একটি ফরাসি ভাষার কবিতা ইংরাজিতে অনূদিত হয়েছে l ইংরাজি থেকে অন্য একটি ভাষায় হয়তো পুনরায় অনুবাদ হলো l দ্বিতীয় অনুবাদকের পক্ষে মূল লেখার আস্বাদ বজায় রাখার কাজটা আরো কঠিন ।
এই সবকিছুর মধ্যেও যুগ যুগ ধরে অনুবাদ চলছে l অনুবাদের মধ্যে দিয়েই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলি আমরা পাঠ করতে পেরেছি l অনুবাদের কারণেই সমকালের বিশ্বসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি এখন আমরা মাতৃভাষাতেই জানতে পারি।
ইংরেজি সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে আজ আমাদের কাছে উপলব্ধ l রুশসাহিত্যের সম্ভার প্রকাশনার প্রযত্নে আমরা আস্বাদন করেছি l করেছি আমেরিকান সাহিত্য l তুলনায় আফ্রিকার কালো মানুষের সাহিত্যের স্বাদ তেমন করে পাইনি। আফ্রিকার জীবন উপনিবেশবাদী বর্বরতা ও বর্ণবৈষম্যের অন্ধকারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সেখানকার সাহিত্য ঔপনিবেশিক অত্যাচার ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা, জ্বালা ও প্রতিরোধস্পৃহার প্রকাশ l আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয় l অনুবাদের মাধ্যমে চিলির কবি পাবলো নেরুদার কবিতা আমাদের কাছে অতি জনপ্রিয় l কিন্তু
বিশ্ববন্দিত বহু বই এখনও অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের পড়ার টেবিলে পৌঁছয় নি l 'দি আউট সাইডার'-এর লেখক অ্যালব্যেয়র কামুর বই l চেকোসস্নোভাকিয়ার জার্মানভাষী ফ্রাঞ্জ কাফ্কার বই l ব্যতিক্রমী লেখক ও কবি গুন্টার গ্রাস বরাবরই প্রথাগত স্রোতের বিরুদ্ধে লিখেছেন । পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে গাড়ি ছেড়ে ইউরোপের বড় বড় শহরের কেন্দ্রস্থলে রিকশা চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস। হাইরিখ বোলের মৃত্যুর পর একমাত্র গ্রাসই যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রতিবাদী বিবেক। তার লেখা বইয়ের সাথে আমাদের পাঠকদের কতটা পরিচয় আছে ? অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের প্রমুখ সাহিত্যিকদের জীবনবোধ ও তাদের সাহিত্যের মূল্যবোধে আমরা স্নাত হই। রবার্ট ফ্রস্টকে অনুবাদ করেছেন কবি শামসুর রহমান। ফ্রস্ট যে এ যুগের জীবন জিজ্ঞাসা তা শামসুর রহমান তার ভাষান্তর প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করেছেন।
অনুবাদ লেখকরা মূল বইয়ের সঙ্গে এবং তার কল্পিত আখ্যানের সঙ্গে মনস্ক পাঠককে সম্পৃক্ত করেন, এবং সত্য, সুন্দর, ও মহতের সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠক কেমনভাবে সম্পর্কিত তা নিয়েও ভাবতে শেখান। পরবর্তী প্রজন্মের লেখক এবং গবেষকরা এসব লেখা থেকে নতুন চিন্তার সূত্র খুঁজে পান।
একথা মেনেও যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় আনতে গেলে মূল সাহিত্যকর্মের আত্মা বাষ্পীভূত হয়ে যায়, আমরা বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্যগুলোর সফল ভাষান্তর পেয়েছি যা সুখপাঠ্য হয়েছে এবং অবিরাম মনের খোরাক জুগিয়েছে।