বই প্রকাশনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন, কিছু বিতর্ক, কিছু মতামত নানা সোসাল মিডিয়ায় দেখছি l বিনা খরচে বা খরচ দিয়ে লেখকদের বই প্রকাশ প্রসঙ্গে কিছু পোষ্ট আসছে l

লেখক ও প্রকাশক দুটি শ্রেণী l আমি শ্রেণীগতভাবে  প্রথম শ্রেণীতে পড়ি l অল্পস্বল্প লেখালেখি করি l নিজ বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকের কাছে যেতে হয় l নানারকম শর্ত/অপশন থাকে l নিজের সামর্থ্য, প্রয়োজন ও বোধ অনুযায়ী একটি শর্তে রাজি হয়ে বই প্রকাশ করি l আমি দেখেছি কয়েকরকম অপসন থাকে l একটিমাত্র নয় l কিছু পোষ্টে দেখেছি এই পুরো বিষয়টিকে স্পষ্ট করা হয় নি l যেভাবে বলা হয়েছে তাতে যেন পুরো সত্যটা উঠে আসে নি l

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বুঝতে হবে প্রকাশন সংস্থাগুলি দানসত্র খুলে বসেন নি l তাঁরা ব্যবসা করতে বসেছেন l সব ব্যবসাতেই ঝুঁকি আছে l বুদ্ধিমত্তা, বিবেচনা ও বাস্তববোধের সঙ্গে এই ঝুঁকিকে কতোটা কমিয়ে আনা যায়, বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবসা করে কি করে ব্যবসায় টিকে থাকা যায়, পুঁজি বিনিয়োগ করে কি করে লাভসহ পুঁজিটাকে তুলে আনা যায়, এই ভাবনা অর্থনীতির নিয়ম মেনেই করা উচিত এবং এটা করা কিছু অন্যায় নয় l
এটা বুঝতে হবে যে এখন সাহিত্যের বই বিক্রি, বিশেষ করে কবিতার বই বিক্রি খুব একটা উৎসাহপ্রদ নয় l ফলে এই ব্যবসায় যাঁরা টাকা ঢালবেন, তাঁদেরও প্রচুর ঝুঁকি থাকে l

দেখেছি মূলত এই শর্তগুলিতে লেখক প্রকাশকের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে বই প্রকাশিত হয় l

১) সব খরচ লেখকের l প্রকাশক সংস্থা চুক্তিমতো টাকা গ্রহণ করে লেখককে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই দিয়ে দেন l গ্রন্থস্বত্ত্ব থাকে লেখকের l লেখক সেই বই নিজের মতো করে বিক্রি করেন বা সৌজন্য সংখ্যা বিলোন - সেটা লেখকের এক্তিয়ার l প্রকাশক সংস্থা কেবল কয়েকটি কপি (৫-১০ টি) রেখে দেন রেফারেন্স হিসাবে l

২) সব খরচ প্রকাশকের l গ্রন্থস্বত্ত্ব লেখকের l লেখক  নির্দিষ্ট সংখ্যক বই প্রকাশের অনুমতি দেন প্রকাশক বা প্রকাশন সংস্থাকে l  লেখককপি হিসাবে লেখক (৫-১০) টি বই পান বিনামূল্যে l এর অতিরিক্ত বই নিতে হলে লেখককে সেটা কিনে নিতে হয় l কারণ আগেই বলেছি প্রকাশন সংস্থা ব্যবসা করতে এসেছে, দানসত্র খুলে বসেন নি l এবার প্রকাশন সংস্থা বই বিক্রি করে যে টাকা পান তার লাভের একটি অংশ লেখককে রয়ালটি হিসাবে দেন l এটি আদৰ্শ ব্যবস্থা l সততার সঙ্গে এটি করা হয় l আমি রয়ালটি পেয়েছি l কোনো প্রকাশক সংস্থা যদি এক্ষেত্রে অসৎ হন, সে দায় তাদের l

৩) তৃতীয় বিকল্প l হয়তো ২০০ কপি বই প্রকাশ হবে l লেখক হয়তো ১০০ কপি নিবেন l বাকি ১০০ কপি প্রকাশক সংস্থার কাছে থাকবে, তারা বিক্রি করবেন l ১০০ কপির জন্য লেখক চুক্তিমতো টাকা দেন l যে কপিগুলো প্রকাশক বিক্রি করবে তার থেকেও লেখক রয়ালটি (বিক্রয়মূল্যের ৭-১০ শতাংশ) পান l গ্রন্থস্বত্ত্ব লেখকের l

মোটামুটি এরকম বা একটু ডাঁয়ে বাঁয়ে চুক্তি হয় l এভাবেই চলছে l এখন যাঁরা লিখছেন, খুব বিখ্যাতদের বাদ দিলে, সাধারণ লেখকেরা খুব চাপে আছেন l অনেক টাকা খরচা করে বই বার করতে হয় l সে বই বিক্রি করে টাকা তুলে আনা কঠিন l আর তিনি বই বিক্রি করতে পথে নামবেন, নাকি নতুন সৃষ্টিকে রুপ দিবেন ?  কোনটা করবেন তিনি ?  

কিন্তু এতো চাপে সঙ্কটেও লেখা কিন্তু বন্ধ হয় না l কারণ লেখার ক্ষমতা এবং লেখার নেশা অদ্ভুত এক বিষয় l এ বিষয়ের আস্বাদ যিনি পেয়েছেন তিনি লেখা ছেড়ে থাকতে পারেন না l লেখার ভূত ভবিষ্যৎ না ভেবে তিনি লিখে যান কারণ এটাই লেখক কবির কাজ l মোট জনসংখ্যার একটি সামান্য অংশই লেখেন, কিন্তু এই সামান্য অংশের লেখাকেই প্রকাশের আলোয় আনা যাচ্ছে না l যেগুলি আসছে তার যথাযথ বিপণন হচ্ছে না l  বেসরকারী প্রকাশন সংস্থাগুলো ক্ষতি স্বীকার করে এই কাজে এগিয়ে আসবেন এটা আশা করাটাই বোকামি l ব্যবসার প্রাথমিক ধারণা তা বলে না l এই সঙ্কটের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে তাঁরা যেটুকু করছেন সেটাই অনেক l তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই l

এক্ষেত্রে সরকারের কিছু দায় আছে বলে মনে করি l সাহিত্য একটি শিল্পকলা l সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশে সাহিত্যের অবদান অপরিসীম l ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার ক্রমবিকাশের জন্য, সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, মানবিক মূল্যবোধের চর্চার জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গতি প্রকৃতির দিক নির্দেশের জন্য নিরন্তর সাহিত্য চর্চার প্রয়োজন আছে l এই চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে l কোনো ক্ষেত্রে এই শিল্পকলার যদি রুগ্নতা থাকে, সেটার দূরকল্পে সরকারের পাশে আসা উচিত l ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকাগুলিকে সহায়তা দান করা যায় l একটা নীতির ভিত্তিতে উদীয়মান লেখক কবিদের বই প্রকাশে সহায়তা দান করা যেতে পারে l বহু শিল্পকলা, লোকশিল্প এরকম সরকারী সহায়তা পেয়ে থাকে l সাহিত্য সরকারের সুনজর পাবে না কেন ?