পর পর দুটি আলোচনা পেলাম আলোচনা পাতায়। একটি ফেসবুকে কবিতা প্রকাশ বিষয়ে এবং আরেকটি কবিতা ও অকবিতা বিষয়ে l যথাক্রমে আলোচনাগুলি করেছেন আসরের কবি শমশের সৈয়দ ও প্রণব মজুমদার l নিঃসন্দেহে বর্তমান দিনে কবিতা চর্চার যে চলন গড়ে উঠেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনাগুলি প্রাসঙ্গিক ও উপযোগী l
এ প্রসঙ্গে নিজের কিশোরকালে কবিতাচর্চার যে অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছি তার সঙ্গে আজকের দিনে ফেসবুকে কবিতাচর্চার যে প্রচলন দেখি এই উভয় ব্যবস্থার মধ্যে এক তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে হয় l আশির দশকে যখন ১৯-২০ বছর বয়স, সবে কবিতার চর্চা শুরু করেছি, কবিতা লেখা হলে সেই কবিতা কোনো সাহিত্য পত্রিকার ঠিকানায় পাঠাতাম l তারপর শুরু হত অপেক্ষা l একমাস দুমাস পর দেখতাম, হয় সেই কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অথবা হয় নি l প্রকাশিত না হলে মনটা খারাপ হত l প্রকাশিত হলে খুশি হতাম l ছাপার অক্ষরে নিজের কবিতা বার কয়েক পড়তাম এবং পত্রিকাটা নাকের কাছে নিয়ে এসে তার গন্ধ শুঁকতাম l একটা গন্ধ পেতাম l এখন বুঝি সেটা নতুন কাগজ ও কালির গন্ধ l কিন্তু তখন ভাবতাম, সেটা কবিতার গন্ধ !
আর এখন ফেসবুকের যুগে কবিতা লেখার পর, অপেক্ষার কোনো ব্যাপার নেই l বাতিল হবারও ব্যাপার নেই l নিজের ফেসবুক পাতায় তা প্রকাশ করে দেয়া যায় l একটা পরিসরের মধ্যে, যার যেমন বন্ধুতালিকা, কবিতাটি পৌঁছে যায় l বেশ কিছু লাইক জুটে যায়, কমেন্ট করেন অনেকে l প্রথম কবিতা চর্চার দিনগুলিতে কবিতা প্রকাশিত না হবার কারণে যে দুঃখবোধের ব্যাপার ছিল, ফেসবুকের যুগে সেটা নেই l আবার প্রকাশিত কবিতার কাগজ ও কালির গন্ধ যেটা ছিল, সেটাও নেই l
তবে অন্য একদিক থেকে ভাবলে পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশের অনেক সদর্থক দিক আছে l এখানে একজন পত্রিকা সম্পাদক বা সম্পাদকমন্ডলী থাকেন l যে কবিতাগুলি জমা হয়, নির্বাচিত হবার পর সেগুলি সম্পাদিত হয় l ফলে লেখার মধ্যে ভুলত্রুটি থাকলে প্রকাশের আগে সেগুলি সংশোধন হয়ে যায় l কিন্তু ফেসবুকের ক্ষেত্রে সেটি হবার সুযোগ নেই l লেখা সম্পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে তা ফেসবুকে পোস্ট হয়ে গেল l তার মধ্যে হয়ত বানান ভুল, বাক্যগঠনের ভুল থেকে গেল l সকলের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই হয় না l কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই যে হচ্ছে তা দেখা যায় l যাঁদের ক্ষেত্রে হচ্ছে, সেগুলি অবশ্যই অকবিতা l আর যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে নিজের লেখা বারংবার পাঠ করে নির্ভুল করে পোস্ট করছেন, তাঁরা কবিতা পোস্ট করার ক্ষেত্রে যে এক কদম এগিয়ে রয়েছেন, সেটা বোঝাই যায় l শুধু বানান শুদ্ধ ও সঠিক বাক্য গঠন হলেই হয় না, কবিতার অনেক মানদণ্ড আছে l সেইসব অতিক্রম করে কালজয়ী কবিতা হতে হয় l
কবি শমশের সৈয়দ এর আলোচনাটির মন্তব্যে লেখাটির সার সংক্ষেপ করেছিলাম মূল বিষয়গুলি উল্লেখ করে l প্রাসঙ্গিক মনে করে এখানে তা উপস্থাপন করলাম :
১) প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলি নতুন কবিদের কবিতা প্রকাশ করে তাদের উৎসাহিত করে না।
২) প্রতিষ্ঠিত কবিরাও তাদের একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা কায়েম রাখতে নতুন কবিদের নিরুৎসাহিত করেন।
৩) নতুন কবিদের নিজেদের প্রতিভার প্রকাশের জন্য অগত্যা ফেসবুকের শরণ নিতে হয় যেখানে অবাধে নিজেদের লেখা প্রকাশ করতে পারেন।
৪) নতুন কবি যাঁরা ফেসবুকে কবিতা প্রকাশ করেন, তাঁদের সকলেই ভালো কবি নন। কিছু ভালো কবিতা প্রকাশিত হলেও অনেক নিম্নমানের এমনকি শূন্যমানের লেখা ফেসবুকে প্রকাশিত হয়।
৫) প্রতিষ্ঠিত কবিরা এই নতুন কবিদের আত্মপ্রকাশে আতঙ্কিত। তাঁরা নতুনদের নিরুৎসাহিত করার জন্য অনুচিত অশোভন মন্তব্য করেন, যা কাঙ্খিত নয়।
৬) আলোচকের মতে সময় বলবে কোন্ কবিতা বা কবি থাকবেন, এবং কে বাতিল হবেন। যিনি বাতিল হবেন তাকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা অর্থহীন। এবং যে নতুন কবির মধ্যে প্রতিভা আছে, তাকে যেহেতু কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব নয়, তাই তাকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টাও হলো পন্ডশ্রম।
৭) দেখা যায়, ফেসবুকে লাইক ও মন্তব্যদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ, কবির সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু অকবিতা প্রচুর লাইক ও অনুকূল মন্তব্য পেয়ে যায়, এবং অনেক ভালো কবিতাও লাইক কম পায় বা বিরূপ মন্তব্যও পেয়ে যেতে পারে। আলোচক বলছেন এটি একটি অপচেষ্টা। শত শত লাইকও একটি অকবিতাকে সময়ের পরীক্ষায় পাশ করাতে পারে না। এবং হাজার বিরূপ সমালোচনাও একটি ভালো কবি বা কবিতাকে কালের অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে পারে না। সময়কে অতিক্রম করে সেই কবিতা মহাকালের আশ্রয় পেয়ে যায় l
এই শেষোক্ত বিষয়টি যুগে যুগে বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে এমন দেখা গেছে l কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সজনীকান্ত দাস "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় কঠোর বিরূপ সমালোচনা করেছেন l কিন্তু জীবনানন্দ দাশকে আটকানো যায় নি l তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন নিজের যোগ্যতায় l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবলতম বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও মাইকেল মধুসূদন দত্তের "মেঘনাদবধ কাব্য" মহাকাব্য হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে l শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল l রবীন্দ্রনাথের "সোনার তরী" কবিতাটির চরমতম বিরুদ্ধ সমালোচনা করেছিলেন নাট্যকার ও কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় l আজ "সোনার তরী" বাংলা ভাষার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে স্বীকৃত l ফলে প্রকৃত প্রতিভাবান কবিকে এবং যথার্থ কবিতাকে কোনো বিরুদ্ধ সমালোচনা রাহুগ্রস্ত করতে পারে না l
তাহলে এই যে বড়ো পত্রিকাগোষ্ঠীরা নতুন কবিদের সুযোগ দেন না বলে অভিযোগ ওঠে, বড়ো প্রতিষ্ঠিত কবিরা নতুন কবির বিকাশের পথে অন্তরায় হন বলে যে অভিযোগ ওঠে, এই অভিযোগ যদি সত্যও হয়, তবু বলা যায়, এরকম কোনো কিছু করেই একজন প্রকৃত প্রতিভাবান কবিকে আটকানো সম্ভব নয় l ফেসবুককে আশ্রয় করেই তিনি এগিয়ে যাবেন এবং একদিন বড়ো পত্রিকাগোষ্ঠীগুলিও সমাদরে তাঁর কবিতা প্রকাশ করে নিজেদের গর্বিত মনে করবেন l আবার এটাও সত্য, ফেসবুকে কবিতা প্রকাশ সহজ বলে, কবিতার নামে যা তা প্রকাশ করে দিলেই পাঠক তা নেবে না l সময়ের দরবারে তা পরিত্যক্ত হবে l
আসরের সকল কবিতাপ্রেমী সদস্যদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।