বাঙ্গালী আড্ডাপ্রিয় - কথাটি বিতর্কের উর্ধ্বে l আমরা আড্ডায় যে বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণত আলোচনা করে থাকি সেগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে l এক, কোনো বিমূর্ত ধারনা, দুই, কোনো ঘটনা, তিন, কোনো পরিচিত ব্যক্তির সম্বন্ধে আলোচনা যা কি না সোজা কথায় পরনিন্দা বা পরচর্চা l সক্রেটিস বলছেন, যাদের চিন্তাশক্তি প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ যারা চিন্তাবিদ তারা ঐ প্রথম জাতীয় অর্থাৎ কোনো বিমূর্ত ধারনা বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন l যারা মধ্যম শ্রেণীর তারা ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে ভিত্তি করে আলোচনা করেন l
আর পরনিন্দা অর্থাৎ ব্যক্তিভিত্তিক আলোচনায় মাতেন তারা যাদের চিন্তাশক্তি একেবারে তলানিতে l
ঠিক এই বিষয়টিকে আমরা কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও ভাবতে পারি l সাধারণত তিন ধরনের কবিতা আমরা প্রত্যক্ষ করি l ভাবনাভিত্তিক, কাহিনীভিত্তিক ও ব্যক্তি ও নির্দিষ্ট ঘটনাভিত্তিক l ভাবনাভিত্তিক কবিতাগুলি অত্যন্ত উন্নতমানের হয়, আকারে সাধারণত ছোট হয়, খুব বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠিত কবিরাই এই ধরনের কবিতা লিখে সফলতা ও সুনাম পেয়ে থাকেন l এই জাতীয় কবিতাগুলি উপভোগ করা একটু কঠিন হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই ধরনের কবিতার স্বতস্ফুর্ত পাঠক কম হয় l বর্ননাধর্মী কবিতাগুলিকেও এই শ্রেণীভুক্ত ভাবা যেতে পারে l বর্ননাধর্মী কবিতায় প্রকৃতির বা অন্য কোন বিষয়ের বর্ণনার অতিরিক্ত কোনো গূঢ় ভাবনা অন্তর্নিহিত থাকে l প্রকৃতির কবি যারা, যেমন ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - তাদের কবিতায় এই বিষয়টা লক্ষ্য করা যায় l
ঘটনা ও কাহিনীভিত্তিক কবিতাগুলি সব ধরনের কবিরাই লিখে থাকেন এবং যেহেতু এই জাতীয় কবিতায় গল্পের ছোঁয়া থাকে, এগুলি পাঠকের খুব প্রিয় হয় l যদিও কবিতায় গল্পের স্পর্শটুকুই থাকে, প্রকৃত গল্পকারের মতো এই গল্পের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি দেবার দায় কবির থাকে না l গল্পের পরশটুকুকে আশ্রয় করে তিনি কবিতার জগতে বিচরণ করেন, সীমার মধ্যে অসীম, রূপের মধ্যে অরূপের অন্বেষণ চলে l
আর তৃতীয় এক শ্রেণীর কবিতা হয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে পারে, তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হতে পারে, এগুলি অত্যন্ত subjective হয়, তাজা অনুভবের প্রকাশে কবিতা লেখা হয়, অত্যন্ত অনুরাগ বা কারও প্রতি বিদ্বেষ কবিতার বিষয় হতে পারে l এই জাতীয় কবিতাগুলি সমসাময়িক কালে জনপ্রিয়তা পেলেও কালের স্রোতে হারিয়ে যায় l ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলছেন, কবিতা অবশ্যই শক্তিশালী অনুভবের প্রকাশ হবে, কিন্তু মনের শান্ত অবস্থায় সেই অনুভবকে স্মরণ করে কবিতায় তা মেলে ধরতে হবে l
এই কথার রেশ ধরে আমরা বলতে পারি, কবিতা রচনার ক্ষেত্রে মূল যে দুটি factor কাজ করে, তা হল পরিস্থিতি এবং ভাবনা l একটা পরিস্থিতির সাপেক্ষে কবির মনে কিছু ভাবনার জন্ম হয় এবং সেই ভাবনাকে তিনি কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন l এখন পরিস্থিতির উদ্ভব ও কবিতার জন্ম - এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান গুরুত্বপূর্ণ l সময় বিষয়টিও আপেক্ষিক l পরিস্থিতির কারণে শক্তিশালী আবেগের যে উত্তেজনা কবি অনুভব করলেন, তা প্রশমিত হওয়ার সময়কাল ব্যক্তিভেদে, পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে l কিন্তু সেই পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কবিকে বিস্মৃত হতে হয় l এই আংশিক বিস্মরণের পর, আবেগের উত্তেজনা প্রশমিত হবার পর মনের শান্ত অবস্থায় ঐ পরিস্থিতিকে স্মরণ করে তিনি যখন কবিতা লিখবেন, তখন ঐ পরিস্থিতির কবিতাযোগ্য বিষয়গুলিই তার কবিতায় আসবে, কবিতাযোগ্য নয় এমন প্রসঙ্গগুলি বাদ যাবে l
আমরা বিষয়টিকে অন্যভাবে, একেবারে ব্যবহারিক উদাহরণ সহযোগে বোঝার চেষ্টা করি l ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বড়ো একটি text-কে summary এবং precis করার অভিজ্ঞতা হয়েছে l কবিতা লেখার ক্ষেত্রে বলা যায়, ঐ text টি হল পরিস্থিতি l পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার পর, সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লিখলে text এর পুরো details কবিতায় চলে আসবে l সেটা reporting হবে, কবিতা হবে না l কিছুদিন পর যখন অনুভবের আবেগ পুরোপুরি প্রশমিত হয় নি, তখন ঐ অনুভবের নিরিখে কবিতা লিখলে সেটা summary হবে, কবিতা হবে না l কবিতাকে হতে হবে precis এর মতো, সারাংশ l অর্থাৎ পরিস্থিতির যা সারবত্তা রয়েছে তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুই হবে কবিতার উপজীব্য l এবং এই অংশের মধ্যেই সমগ্রের দর্শন হবে কিংবা তার চেয়েও বেশি l কিছু ঘটনার একটা চিরকালীন আবেদন থাকে l ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণকে ছাড়িয়ে তার চিরকালীন আবেদনমূল্য কবির চোখে ধরা দেয়, সেটাই কবিতার বিষয় l কবি কোনো reporter নন, তিনি সত্যদ্রষ্টা l কোনো পরিস্থিতি বা ঘটনার মধ্যে যে বহুমাত্রিকতা থাকে তার মধ্যেকার সার সত্য কবি উন্মোচন করেন কবিতার ভাষায় l যে কোনো পরিস্থিতির অসার অংশগুলো ঝেড়ে ফেলে শুধু কবিতায় স্থান পাবার যোগ্য ভাবনাগুলিকে সংহত করে শান্ত সমাহিত চিত্তে তিনি লেখেন চিরায়ত বাণী যাকে আমরা বলি কবিতা l