বিগত ০৭-১১-২০১৭ তারিখ প্রকাশিত শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের আলোচনার সঙ্গে সহমত যে শ্রদ্ধেয়া কবি রিঙ্কু রায়ের সৃষ্টিশীল কাজে মনোনিবেশ মনঃকষ্ট লাঘবের এক প্রাজ্ঞ প্রয়াস l
এই প্রয়াসে কবিতা লেখার যে রীতি আছে তা শোককবিতা বা Elegy নামে পরিচিত l এইজাতীয় কবিতা কোনো খুব প্রিয় আপনজনের বিদায়কে কেন্দ্র করে লেখা হয় l ইংরাজী ভাষায় এরকম অনেক elegy কবিতার নিদর্শন আছে l বিভিন্ন সময়ে প্রিয়জনের বিয়োগে গভীর শোকের বোধ থেকে কবিতাগুলি লেখা হয়েছে l
John Milton-এর "Lycidas" একটি অন্যতম স্মরণীয় Elegy l Cambridge বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধু Edward King এর অকালপ্রয়াণে শোকাহত Milton এই শোকগাথা রচনা করেন l Thomas Gray-এর লেখা "Elegy Written in a Country Churchyard " Stoke-Podges নামে একটি ছোট গ্রামের সমাধিতে শায়িত গ্রামবাসীকে উদ্দেশ্য করে লেখা l Shelley-এর "Adonais" কবিতাটি তাঁর কবিবন্ধু কিটসের মৃত্যুর পর তাঁকে উদ্দেশ্য করে রচিত l Alfred Lord Tennyson-এর "In Memoriam" কবিতাটি Tennyson-এর বন্ধু Arthur Henry Hallam-এর মৃত্যুর পর তাঁকে ঘিরে লেখা l মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁর এই বন্ধুটি মারা যান l এটি একটি দীর্ঘ কবিতা l ১৭ বছর ধরে কবিতাটি লেখা হয়েছিল l ১৮৩৩ সালে লেখা শুরু হয় l ১৮৪৯ সালে কবিতাটি লেখা শেষ হয় l ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয় l অর্থাৎ এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে Tennyson ১৭ বছর ধরে শোকগাথা লিখে গেছিলেন l কবিতাটিতে কবি টেনিসন ব্যক্তিগত শোক এর সীমা ছাড়িয়ে জগত সংসারের চিরন্তন শোক, আধ্যাত্মিকতা, দর্শনচিন্তা, জীবনের রহস্য, ঈশ্বরের কর্মে প্রশ্ন, জাগতিক উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়, ব্যক্তিগত শোক থেকে উত্তরণ এবং সর্বোপরি ঈশ্বরে পরম বিশ্বাস স্তরগুলি ছুঁয়ে গেছেন l ১৭ বছর ব্যাপী রচিত এই কবিতা আসলে অনেকগুলি কবিতার সংকলন, যেগুলির কেন্দ্রীয় বিষয় এক l Prologue ও Epilogue সহ ১৩৩ টি ক্যান্টোতে বিভক্ত l ক্যান্টোগুলিতে সর্বনিম্ন ৩ টি ও সর্বাধিক ৩৬ টি স্তবক আছে l গোটা কবিতায় ৭২৩ টি স্তবক আছে l প্রতিটি স্তবক ৪ পঙক্তিতে লেখা l মোট পঙ্ক্তির সংখ্যা - ৭২৩x৪= ২৮৯২ l
Matthew Arnold-এর "The Scholar Gipsy" যা একজন Oxford scholar-কে ঘিরে রচিত, "Thyrsis" , যা কবির বন্ধু Arthur Clough-কে স্মরণ করে লেখা, WH Auden-এর "In Memory of WB Yeats", বোঝাই যাচ্ছে যা WB Yeats-এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত, Dylan Thomas-এর "After the Funeral", যা কবির অভিভাবকতুল্য Aunt Ann Jones-কে নিয়ে রচিত, Walt Whitman-এর "When Lilacs Last in the Dooryard Bloomed", যা আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-এর মৃত্যুকে ঘিরে রচিত - ইত্যাদি ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত শোকগাথা হিসেবে খ্যাত।
জীবনের অপরাহ্ন বেলায় উপনীত একজন শোকাহত বৃদ্ধ তাঁর পরিবারের পরলোকগত সদস্যদের স্মৃতিচারণ করছেন মর্মস্পর্শী ভাষায় - এমন পটভূমিতে রচিত কবি জসীম উদদীনের "কবর" কবিতা l এই কবিতাটিকে বিশ্বসাহিত্যের অমর শোকগাথারগুলির সাথে তুলনা করা যায় নিঃসন্দেহে l কবিতায় রয়েছে করুণ রস (Pathos)। পারিবারিক সমাধিস্থলে শায়িত আপনজনদের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে কবিতাটি। আবেগতাড়িত বৃ্দ্ধ তার দৌহিত্রের কাছে তুলে ধরছেন তার নস্টালজিয়াকাতর অনুভূতি। মমতামাখা শব্দের মাধ্যমে তিনি বর্ননা করছেন তাঁর স্মৃতি ও অনুভূতি। স্মৃতিকাতরতা ও বিষণ্ন প্রকৃতি যেন একাকার হয়ে মিলে গিয়েছে কবিতাটিতে। সরল-প্রাণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা ও আশাভঙ্গের ব্যাকুলতা চমৎকারভাবে প্রতিভাত।ব্যক্তিগত বিলাপ যেন এখানে সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রতিটি পাঠক যেন বক্তার সাথে একীভূত হয়ে যান। একটি এলিজির শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে করুণ মূর্ছনা তৈরির ওপর। "কবর" কবিতার করুণ রস যেন এদেশের প্রতিটি সংবেদনশীল চিত্তকে দোলা দেয়। কবিতাটিতে দুটি মানব-মনের বিষণ্নতা ও প্রকৃতির বিষণ্নতা যেন একাকার হয়ে মিশে আছে।
পৃথিবীর সকল ভাষার কবিতাতেই শোকগাথা বা এলিজি লেখার উদাহরণ আছে l একটা সাধারণ বিষয় যা এইজাতীয় কবিতায় লক্ষ্য করা যায় তা হলো, ব্যক্তিগত দুঃখ অতিক্রম করে সর্বজনীন দুঃখের অনুভব এবং সর্বজনীন দুঃখের অনুভবের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত দুঃখকে ভুলবার মতো শক্তি অর্জন করা l
এলিজি রচনার মধ্যে দিয়ে কবি তাঁর মনের সান্ত্বনা খুঁজে পান এই কামনা করি l
সকলকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা l