'জল' শিরোনামে কবি রুবেল চন্দ্র দাস এর কবিতাটি বেশ সুখপাঠ্য l রচনাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি মেয়ে l মেয়েটি একদিন হাতে জল পেল এবং তার জীবন সার্থক হয়ে উঠল l কতো ঘাট, কতো কলসি এর পূর্বে দেখা হয়েছে l কিন্তু জল মেলে নি l বারবার সে পিপাসার্ত হয়েছে l জীবিত মানুষের পিপাসা তো থাকবেই ! পিপাসার নিবারণে জল প্রয়োজন l জল না পেলে মৃত্যু অনিবার্য l জলের অভাবে পুঁইশাক মরেছে, কচুরিপানার শিকড় শুকিয়েছে l মেঘের কোলে দিবানিশি যে চাতকপাখি ডাকে, সেও জলের অভাবে মারা গেছে l কিন্তু মেয়েটি মরে নি l মনে আশা নিয়ে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে সে বেঁচে ছিল l শেষ পর্যন্ত তার আশা, স্বপ্ন পূরণ হয়েছে l জল পেয়েছে সে l হয়তো বিরাট আকারে নয়, কিন্তু যে পরিমাণে তৃষ্ণা মেটে, মন আনন্দে ভরে যায়, জীবন অর্থময় হয়ে ওঠে, সেই পরিমাণ সুপেয় জল সে হাতে পেয়েছে l
কবিতার সরল এই পাঠ দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ের "হাতে জল পাওয়া" শব্দবন্ধের অর্থ কি হতে পারে তার ওপর l কতকগুলি বিকল্প অর্থ এখানে মাথায় আসে l এর যে কোনোটি, অথবা সবগুলি একত্রে, কিংবা ভিন্ন কোনো অর্থ হতে পারে l সেই অর্থের ওপর কবিতাটির সঠিক পাঠোদ্ধার নির্ভর করে l
মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজব্যবস্থায় একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেবার পর তাকে অনেকগুলি স্তরের মধ্যে দিয়ে বড়ো হতে হয় l প্রতিটি স্তর তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ l সমাজব্যবস্থার নানা বিবর্তনে এই স্তরগুলোর কিছু ক্ষেত্রে মাপকাঠির পরিবর্তন হয়েছে l কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হয় নি l দেশ কাল ভেদে আবার বিভিন্ন রীতি থাকে l এই সব কিছুর মধ্যে সাধারণ কতকগুলি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি মেয়ের হাতে জল পাওয়ার কি অর্থ হতে পারে সেটা জানার প্রয়াস করব l
কন্যা হয়ে জন্ম নেবার পর একটি মেয়ের সঠিক বয়সে নারী হয়ে ওঠার বিষয় থাকে l শারীরিক কিছু কাঙ্খিত পরিবর্তন l সঠিক সময়ে তা না হলে মেয়েটির বাবা মা চিন্তায় পড়েন l তখন ডাক্তার, কবিরাজ দেখানোর প্রয়োজন হয় l চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলতে হয় l যেন বহু ঘাট, কলসির খোঁজ করা হলো l সমস্যার নিরসন হলে বলা যায় মেয়েটির নারীজীবন সার্থক হলো, সে হাতে জল পেল l
মেয়েদের নিয়ে সব বাবামায়ের বিশেষ ভাবনা থাকে তাকে কি করে সুপাত্রস্থ করা যায় l কোনো কোনো সমাজব্যবস্থায় মেয়েকে যতক্ষণ পাত্রস্থ করা না যাচ্ছে, বাবা মায়ের যেন চিন্তার শেষ থাকে না l হয়তো তাঁদের মেয়ের বয়সী অন্য মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে l এতে তাঁরা আরো চাপে পড়ে যান l বার বার ঘটা করে পাত্রপক্ষকে তাঁরা মেয়েকে দেখানোর ব্যবস্থা করেন l যেন কতো ঘাট, কতো কলসিতে জলের খোঁজ করা হচ্ছে l মেয়েটির মনের অবস্থাও অনুমেয় l নারীজাতি এমনিতে খুব সহনশীল এবং আশাবাদী l সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে তার নিজের একটি সংসারের l এত বিভ্রান্তির মধ্যেও সেই মেয়েটি সেই আশা এবং স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে l তারপর একদিন তারও বিয়ে হয় l নারীজীবন সার্থক হয়ে ওঠে তার l যেন হাতে জল পায় সে l
নারীজীবনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মা হয়ে ওঠা l নারীজীবনের এটি নাকি চরম সার্থকতা l অধিকাংশ নারী বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই মা হয়ে ওঠেন l তাদের জীবন, সংসার সুখে ভরে ওঠে l কিন্তু অল্প কিছু পরিবারে সুখ অত সহজে ধরা দেয় না l যে সকল বিবাহিতা মহিলার সন্তান হয় না, তাঁরা খুব মানসিক কষ্টে থাকেন l এর জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে l পুরুষ বা নারী - যে কারুর কারণে এটা হতে পারে l কিন্তু কোনো কোনো সমাজব্যবস্থায় এর জন্য নারীকেই শুধু দোষী মানা হয় l সন্তানলাভের জন্য বহু প্রচেষ্টা চলে l এখানেও সেই ডাক্তার, কবিরাজদের শরণ নিতে হয় l কিছু পরিবার ধর্মগুরু, ঝাড়ফুঁক, পূজা, যজ্ঞ, মানত - এই পথেও যায় l সব সাধনার শেষে কারো কারো মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় l কারো হয় না l এত কিছুর পর যে নারী মাতৃত্বের সম্মান লাভ করে, তার যেন নারী জীবন সার্থক হয়ে ওঠে l হাতে জল পায় সে l
নারীর হাতে জল পাওয়ার - এই বিভিন্ন অর্থের যে কোনোটি অথবা সবটি একত্রে মিলে কবিতার অর্থ বোঝা যেতে পারে l বিকল্প অর্থেরও অবকাশ আছে l
কবিকে জানাই শুভকামনা !!