যুগে যুগে কবিতা রচনার কতো স্তর পেরিয়ে এসেছেন কবিসমাজ l প্রথমে শ্রুতি, তারপর পুঁথিলেখার অনেক মাধ্যম পেরিয়ে কবিতা মুদ্রণ l পত্র পত্রিকায় কবিতা প্রেরণ l সম্পাদিত হয়ে তার প্রকাশ l কাব্যগ্রন্থ l এখন সোশাল মিডিয়ায় সম্পাদনা নেই l নিজেই লেখো l নিজেই প্রকাশ করো l আছে মন্তব্যের অবকাশ l
কবিতা যাপিত জীবনের নির্যাস l কিন্তু এই নির্যাস ইচেছমতো বার করে আনা যায় না l বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কবিতা লেখার প্রেরণা আসে l এই প্রেরণা সকলের কাছেই আসে l মাথার মধ্যে কাব্যিক ভাবগুলি কিলবিল করে ওঠে l যাঁরা এই ভাবগুলিকে শব্দে বাক্যে রূপান্তর করে নিতে পারেন এবং সেই রচনাকে পাঠকসমাজের কাছে কবিতা আকারে উপস্থাপিত করেন তাঁরাই কবি বলে পরিচিতি পান l
কবিতার ভাব যখন মাথায় আসে তখন কবি উত্তেজিত থাকেন l সেই উত্তেজনার বিষয় শব্দে বাক্যে লেখা হয় l কবিতা একটা দাঁড়িয়ে যায় l কিন্তু সেই রচনা সম্পাদনার প্রয়োজন থাকে l কারণ কবিতা শুধু inspiration নয়, perspiration ও বটে l কবির উত্তেজনা যখন কমে আসে তখন মনের শান্ত অবস্থায় একজন পাঠকের চোখে যখন কবি তাঁর রচনাটি পাঠ করেন, তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনুভব করেন কবি l
কবিতার সম্পাদনা করার প্রয়োজন আছে কি নেই, থাকলে সেই সম্পাদনা করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি কে ? স্বয়ং কবি, নাকি অন্য একজন ব্যক্তি ? সেই অন্য ব্যক্তিটিও অবশ্যই একজন কবি হবেন, উন্নত শ্রেণীর কবি l হতে পারে তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন l সম্পাদকের অধিকারেই কবিতা সম্পাদনা করেন তিনি l
'সম্পাদনা' কবিতায় কবি রীনা তালুকদার এই প্রশ্নটিই তুলেছেন l সভ্যতার নিদর্শন কবিতা l কবি-প্রেরণার ফসল l সেই কবিতা পত্রিকার দপ্তরে এসে পৌঁছয় l বিভিন্ন ভাবের বিভিন্ন রচনা যা জীবনকে নানারূপে উপস্থাপিত করে, জনগোষ্ঠী, সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, সমাজের অন্যায়কে চিনিয়ে দেয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত করে - শৈল্পিক প্রাণোচ্ছল কবিতার রূপে সম্পাদকের দপ্তরে তা জমা হয় l পত্রিকার মালিকানা যাঁর হাতে, সম্পাদনার দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি এই কবিতাগুলি সম্পাদনা করেন l সম্পাদনার প্রয়োজন আছে নিঃসন্দেহে l কিন্তু তার জন্য সম্পাদককে যোগ্য হতে হবে l কবিতা একটি উচ্চতর মানের শিল্প l সুতরাং তার সম্পাদনা যিনি করবেন, তাঁকে হতে হবে এই শিল্পের একজন যথার্থ কারিগর l যোগ্য সম্পাদকের সম্পাদনায় কবিতা প্রাণ পায় l
কবি হওয়া সহজ l নিজের কবিতা সম্পাদনা করাও সহজ l কারন কবি কবিতার ভাবের শরিক, সহযাত্রী l কিন্তু অন্যের কবিতা সম্পাদনা কাজটি কঠিন l সেখানে ভাবের ধোঁয়াশা থাকে l তাই সম্পাদকের কাজ অনেক জটিল l দুষ্টুমি করার জায়গা নয় এটি l শুধু সম্পাদনার অধিকারে ইচ্ছেমতো কবিতার মধ্যে পরিবর্তন করে দিতে পারেন না তিনি l অযোগ্য সম্পাদকের সম্পাদনায় কবিতার ক্ষতি হয়ে যায় l
আসরের জনপ্রিয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের লেখায় এক জায়গায় পেয়েছিলাম, তিনি বলেছেন, কবিতার সমগ্র অংশে কবিতা থাকে না l অধিকাংশ অংশ জুড়ে থাকে আবহ নির্মাণের কাজ l তারপর কোনো এক স্থানে, প্রধানত কবিতার শেষ অংশে, কবি টুপ করে কবিতার মূল বিষয়টি স্থাপন করে দেন l এই কারণেই কবিতাকে শেষ দিক থেকে পাঠ করার পক্ষপাতী অনেকে l কবিতা যখন দুর্বোধ্য মনে হয়, তখন কবিতার এই বিশেষ অংশটি খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি হয় l
কবিতা সম্পাদনার নামে কোনো সম্পাদক কবিতার সেই বিশেষ অংশটিকেই যদি বাদ দেন, তাহলে সেই কবিতাটির মৃত্যু হয় l কবিতার ক্ষেত্রে এমন সম্পাদনা কখনোই কাম্য নয় l
প্রাসঙ্গিক মনে করে ২০/১২/২০১৭ তারিখ আলোচনা পাতায় "বিপদে আছি" শিরোনামে এক স্থানে কবি রীনা তালুকদার স্বয়ং যা বলেছেন, তা উদ্ধৃত করলাম l
"কবিতা সম্পাদনা সহজ নয়। সহজ যে কবিতার স্রষ্টা তার l নিজের কবিতা নিজের কাছে সহজ সম্পাদনা করা। নিজের কবিতা নিজের যত খুশী প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত সম্পাদনা করা ভাল। তবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কখনো কখনো একজন ভাল পরামর্শক। যিনি জ্ঞানে তার চেয়ে অধিক, অন্তত কবিতা বিষয়ে। তা না হলে আনাড়ি সম্পাদক কবিতার এ্যানাটমি এমন বদলে দিবে যে কবিতা তার বাপের নাম ভুলে যাবে। অনেকে অবশ্য কবিতা সম্পাদনার পক্ষে নয়। কিন্তু আমি পক্ষে প্রথমত নিজে। তারপর একজন বিশ্বস্ত, জ্ঞানে আমার চেয়ে অধিক কবিতা বিষয়ে পারঙ্গম এমন পরামর্শকের সাহায্য নিয়ে সম্পাদনা পছন্দ করি। একজন দায়িত্বশীল লেখক অনেক বিষয় চিন্তা চেতনায় রেখে লেখেন। ব্যক্তিগত, সংসার, সমাজ, রাস্ট্র, ধর্ম, বৈশ্বিক পরিস্থিতি সব মাথায় রেখে। অনেকে মনে করেন যা লিখেছি কারো সাধ্য নেই একটি শব্দ উল্টে দেয়। যা লিখেছি ওতো স্রষ্টার বাণী। এই যেন কবিতার শেষ কথা। কিন্তু স্রষ্টার অমোঘ বাণীর পরে নিজের যে কিছু পরিশ্রম করে বন জঙ্গল সাফ করে বাসযোগ্য করতে হবে সেটা অার অনেকেই করতে চান না।"
কবি রীনা তালুকদারকে জানাই অশেষ শুভকামনা !!