কবিতায় কবিরা কি অন্বেষণ করেন ? কি লিপিবদ্ধ করে যান ? পাঠক কিসের আকর্ষণে কবিতামুখী হন ? কবিতা কিভাবে একটি যুগকে অমর করে রাখে ? সমাজ সভ্যতার পথ চলায়, তার প্রতিটি মহৎ পদক্ষেপে কবিতা কিভাবে শরিক হয় ? সহযাত্রী হয় ? সভ্যতার ইতিহাস কবিদের প্রেরণার ইতিহাস l যুগে যুগে দেশে দেশে কবিতা আন্দোলনকে প্রাণিত করেছে l শৃঙ্খল মোচনে, কুসংস্কারমুক্ত হতে, উন্নত জীবনযাপনে দিশারী হয়েছে l
"কবিতা'রা ভালো নেই" কবিতায় কবি আনোয়ার মজিদ সেই কবিতাকে খুঁজে না পাবার ব্যথা ব্যক্ত করেছেন l আজকের কবিতা শব্দের জঞ্জালে ভরে গেছে l কিন্তু যৌবনের প্রাণশক্তি নেই সেখানে l কবিগুরুর সেই পঙ্ক্তি,
"ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা
আধমরাদের ঘা মেরে তুঁই বাঁচা l"
এই আহ্বান নেই l কবিতা এখন জীবনের গানে সিক্ত নয় l প্রাণচঞ্চল উচ্ছলতা কবিতায় অনুপস্থিত l কবি নজরুলের সেই অমর পঙ্ক্তি,
"আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।"
আজকের কবিতায় ছন্দের যে দোলা সেখানে নির্মল ভালবাসার বোধের বড়ো অভাব l জীবনানন্দের বনলতা সেন যে ভালবাসার জগতের, শান্তির সন্ধান দিয়েছিল l
"আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।"
আজকের কবিতায় পঙক্তিতে পঙক্তিতে মানুষের সংগ্রামকে উদ্দীপিত করে তোলার মতো বারুদের ঘ্রাণ নেই, যেমনটা ছিল নজরুল, সুকান্ত প্রমুখের রচনায় l
"মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!"
কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখায়,
বিদ্রোহের গান / সুকান্ত ভট্টাচার্য
বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে
ভীরুরা থাক।
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি
রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,
সাধ্য কার?
রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন?
এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন?
চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য
ধারি না ধার।
খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,
গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,
ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,
মৃত্যুপণ।
দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,
বসে থাকবার বেলা নেই মোটে,
রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে
পূর্বকোণ।
ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি,
বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি
খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,
কোথায় প্রাণ!
দেখব, ওপারে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াব দান।
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান।।
কবি আনোয়ার মজিদ আজকের কবিতায় যৌবনের গান, ভালোবাসার টান ও বারুদের ঘ্রাণ খুঁজে চলেন l মনমতো খুঁজে পান না l তাই তাঁর দৃষ্টিতে আজকের কবিতা সুস্থ নয় l কবিতারা ভালো নেই l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা l